ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

‘গল্পকার’ এর গল্প

হাইকেল হাশমী
🕐 ২:৩৭ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ০১, ২০১৯

একসময় মানুষের চিত্তবিনোদেনের অন্যতম মাধ্যম ছিল ‘বই’। জ্যোৎস্না রাতে বাড়ির আঙিনায় পুঁথি পাঠের আসরে আবালবৃদ্ধবনিতা বিমোহিত হতো। পাঠাগারে ছিল বইপ্রেমীদের নিত্য যাতায়াত। কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান সময়ে আমরা প্রচণ্ডরকম ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের অনেকেরই বই পড়ার মতো সময় নেই। আকাশ-সংস্কৃতি, মোবাইল গেমস, ফেসবুক মানুষের বই পড়ার সময় কেড়ে নিয়েছে। প্রযুক্তির বিস্ময়কর বিপ্লবের কারণে এখন বই না পড়েই পড়া হয়ে যায়। কম্পিউটার নিজে বইয়ের লেখা পড়ে শুনিয়ে দেয়। আজকাল কেউ কেউ তথ্যসম্ভারে ডুবে ব্যস্ত জীবনের একটু অবসরে ট্যাব অথবা মোবাইলে ই-বুক পড়েন। ইলেকট্রনিক যত মাধ্যমেই আমরা বই পড়ি বা আমাদের পড়ে শোনাক না কেন বিছানায় শুয়ে অথবা বারান্দায় বসে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে বই পড়ার মজা কখনো পাব না।

প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান সময়ে শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে নিয়মিত বই পড়তে হয়। আমার নিয়মিত পাঠাভ্যাসে যে বইটি গতির সঞ্চার করেছে তার নাম ‘গল্পকার’। দুই বাংলার একমাত্র গল্পবিষয়ক মাসিক পত্রিকা। এটি যাত্রা শুরু করেছে জানুয়ারি ২০১৫ সালে। তবে আমার সাথে ‘গল্পকার’ এর পরিচয় ঘটে গত বছর কোন এক সময়ে। রিডার্স ডাইজেস্ট আদলের স্বল্প মূল্যের এই মাসিক পত্রিকাটি প্রথমেই আমার নজর কাড়ে।

শিল্পকলা ও সাহিত্য বিনোদন ক্ষেত্রে বিষয়-ভিত্তিক পত্রপত্রিকা রয়েছে। কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, সাহিত্য সমালোচনা, ভ্রমণ, নৃত্য, সংগীত, ভাস্কর্য, নাটকসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে পৃথক পত্রপত্রিকার সাথে আমাদের কম-বেশি পরিচয় ঘটেছে। শুধু গল্প ও গল্পবিষয়ক বিষয়াদি নিয়ে সংকলনও আমাদের চোখে পড়েছে। ষাট দশকে কামাল বিন মাহতাব সম্পাদিত ‘ছোট গল্প’ নামে একটি পত্রিকা অনিয়মিত প্রকাশ হতো। শুনেছি এটি বেশি দিন টিকতে পারেনি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘গল্পকার’ই একমাত্র গল্পবিষয়ক মাসিক পত্রিকা যেটি প্রতিমাসের প্রথম সপ্তাহে নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। ‘গল্পকার’ শুধু ছোটগল্প দিয়ে একটি মাসিক পত্রিকা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি। সবার অলক্ষে ‘গল্পকার’ নবীন-প্রবীণ সব শ্রেণির লেখকের জন্য একটি প্লাটফর্ম হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এখানে শুধু আমরা গল্প পড়ি না, গল্প জগতের জানা-অজানা বিষয়, বিশ্বসাহিত্যের অনেক চমকপ্রদ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, সাহিত্যিকদের জীবনী, সাক্ষাৎকার, গল্পের কলকব্জা, গল্পবিষয়ক প্রবন্ধ, বিভিন্ন ভাষা থেকে অনূদিত গল্প ও বিশ্বে ঘটে যাওয়া সাহিত্য সম্পর্কিত বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, কথাসাহিত্যের বই আলোচনাসহ নানান বিষয় জানতে পারি।

উভয় বাংলার সাহিত্যাঙ্গন চষে ফিরেও শুধু গল্প নিয়ে নিয়মিত মাসিক পত্রিকা এর আগে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। সাহিত্যের এই একটি অত্যন্ত শক্তিশালী শাখায় মুহাম্মদ মহিউদ্দিনের এই প্রয়াস, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন শুধু একটি চমক ভাবলে ভুল ও অবমূল্যায়ন করা হবে। এটি সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে এক সৃষ্টিশীল অগ্রযাত্রা ও দুঃসাহসিক সফল পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে হবে। এবং সাহিত্য ক্ষেত্রে তার এই একক প্রচেষ্টাকে শুধু মৌখিক ও আপ্তবাক্যে প্রশংসায় আমাদের দায়িত্ব শেষ করলে চলবে না। চতুর্থ বর্ষে পদার্পণ করতে যাওয়া ‘গল্পকার’-এর প্রকাশনা যাতে নিরবচ্ছিন্ন থাকে এবং ব্যাপক প্রচার-প্রসার পায় সেদিকে দেশ-বিদেশের সব গল্পপ্রিয় লেখক পাঠকদের কার্যকর দৃষ্টি রাখতে হবে।

নবীন লেখকদের জন্য ‘গল্পকার’ এ একটি আলাদা বিভাগ ‘নবকেতন’ রয়েছে। যেখানে দেশের তরুণ লেখকরা কোন প্রকার যোগাযোগ ছাড়াই লেখা পাঠাতে পারছেন। নির্বাচিত হলেই গল্প ছাপা হয়ে যাচ্ছে। এবং তরুণ নির্বাচিত লেখকের ঠিকানায় পৌঁছে যাচ্ছে পুরস্কার। দেশের তরুণদের হাতে অস্ত্রের পরিবর্তে কলম তুলে নেওয়ার এবং গল্প লিখার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য ‘গল্পকার’ এর এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তাছাড়া মনোজগতের রহস্য নিয়ে ‘বিপথগামিতার গল্প’ আমাদের যুবসমাজকে বিপথে যাওয়ার ফাঁদ থেকে সুপথে ফিরে আসার জন্য একটি প্রেরণা বলা যেতে পারে।

‘গল্পকার’ পত্রিকার শুরুতে বাংলা সাহিত্যের ক্লাসিক একটি গল্প থাকে ‘চিরায়ত গল্প’ নামে। প্রায় একশ-দেড়শ বছর আগের গল্প এবং গল্পের লেখকের সাথে বর্তমান সময়ের পাঠকদের সংযোগ করে দেয় ‘গল্পকার’। এতে শুধু নিরেট একটি গল্প জানা যায় না। বরং জানা যায় সেই সময়ের সমাজ-সংস্কৃতি ও ইতিহাস। বিভিন্ন ভাষা থেকে অনূদিত গল্পগুলো আমাদের বাংলা ভাষার গল্পগুলোকে আরো বেশি ঋদ্ধ এবং সমৃদ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।

বর্তমান সময়ে বাস্তবিক অর্থে এক ধরনের মানবিক বিপর্যয়ে আছে পরিবার ও সমাজ। বিনে সুতোর মালাটি যেন গ্রন্থিহীন হয়ে পড়ছে। নষ্ট হচ্ছে মনের সুকুমার বৃত্তির লালন ও রুচির শুদ্ধতা। গল্প শোনা বা বলার সময়গুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে যন্ত্র সভ্যতা, তারপরও জাতি হিসেবে আমরা গল্প শুনতে এবং পড়তে ভালোবাসি। গল্পপ্রেমীদের পুনরায় গল্পের জগতে ফিরিয়ে আনতে ‘গল্পকার’ পত্রিকার নিয়মিত প্রকাশের উদ্যোগ সত্যিই মহৎ।

 

 

 

 

 
Electronic Paper