একজন মননশীল চিত্রকর
ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
🕐 ১২:৫৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৫, ২০১৯
একজন শিল্পীর চিত্রকর্মের চরিত্র কেবল তার প্রতিভার দ্বারা নির্দিষ্ট হয় না, তার চিন্তা-স্বপ্নও নির্দেশ করে তার তুলির গতিপথ। যার চিন্তা নেই, স্বপ্ন নেই, তার শিল্পকর্ম গতানুগতিকতার দীনতায় আবিষ্ট থেকে যায়। হয় বাস্তব, নয় প্রকৃতি কিংবা উভয়ই তার শিল্পকর্মকে বৃত্তাবদ্ধ করে রাখে। দূর বা কাছের কোনো পূর্বজের অনুগত শিষ্যত্বই তার প্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। কালিদাস কর্মকার শুরু থেকেই ব্যতিক্রম।
১৯৮০-তে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এক চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের সূত্রে ব্যাংকক পোস্ট পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে চিত্রশিল্পী কালিদাস কর্মকার বলেছিলেন, ‘আকাশের দিকে তাকিয়ে, চাঁদের দিকে তাকিয়ে, তাদের রূপবৈচিত্র্য ধারণের মতো ছবি আঁকা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। সত্যি বলতে কি- একজন আধুনিক শিল্পীর পক্ষে প্রকৃতির রূপ ফুটিয়ে তোলার দিন শেষ হয়ে গেছে।’ হয়তো সকলেই এই বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করবেন না, তবে কালিদাস কর্মকারের ক্ষেত্রে একথা সর্বতোভাবে প্রযোজ্য যে, তিনি তার চিত্রকর্মে বাস্তবতার পুনর্জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করেননি। ছবি আঁকতে গিয়ে তিনি বহির্জগত থেকে উপাদান আহরণের চিরাচরিত রীতি সম্পূর্ণাংশে বর্জন করেছিলেন। তার চিত্রকলা আমাদের চেতনার মতোই বিমূর্ত অথচ প্রবলভাবে কর্তৃত্বময়।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে কালিদাস কর্মকারের জন্ম ফরিদপুরে। ষাটের দশকে তিনি আর্ট স্কুলে যাওয়া শুরু করেন। ’৭০ দশকেই তিনি চিত্রপ্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে স্বীয় চিত্রকর্মকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে শুরু করেন। যৌবনের আদিপর্বেই শিল্পকলা তার চৈতন্যে একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। সারা জীবন তিনি সাধনা করেছেন কী করে অন্তর্গত ভাবচেতনাকে ক্যানভাসের পর্দায় ফুটিয়ে তোলা যায়। প্রায় চার দশক তিনি দর্শকের জন্য ‘দৃষ্টিগ্রাহ্য অভিজ্ঞতা’ (ভিজুয়াল এক্সপিরিয়েন্স) তৈরির চেষ্টা করেছেন। দৃষ্টিগ্রাহ্য অভিজ্ঞতার মধ্যে আমাদের চেনা পৃথিবী, পরিচিত প্রকৃতি ও পরিপাশ্ব এবং মানুষের জীবনযাপনের প্রতিফলন অনুপস্থিত। তার চিত্রকলা সর্বাংশে প্রতীকতাময়, তবে এমনকি পণ্ডিত চিত্রবোদ্ধাদের কাছেও, সে সবের প্রতীকার্থ অনধিগম্য থেকে যায়। তার চিত্রকলা যে অর্থময়তার ধারক ও বাহক, তা অনতিক্রম্যভাবে ব্যক্তিগত বলেই মনে হয়।
তার একটি ছবিতে প্রত্যক্ষ হয় চৌকো পটভূমিতে দূরাগত এক আলোকবর্ণচ্ছটার একটি উজ্জ্বল বৃত্ত, যার চারপাশে গাঢ় বর্ণের প্রেক্ষাপটে সুতার মতো কিছু ঝুলে আছে। দর্শক যদি সৌভাগ্যবান হন, তাহলে হয়তো শিল্পীকে পাশে পাবেন এবং কালিদাস কর্মকার সুন্দর করে বুঝিয়ে দেবেন ওই বৃত্তের কেন্দ্রীয় এলাকাটি আর কিছুই না, মাতৃজরায়ু আর চতুষ্পাশ্বের ওই সুতার মতো ঝুলে থাকা বস্তুগুলো হচ্ছে শুক্রাণুমালা, যা ধাবিত হচ্ছে অদূরবর্তী ডিম্বাণুপুঞ্জের দিকে। কার্যত, ছবি ব্যাখ্যার জন্য শিল্পী সচরাচর উপস্থিত থাকেন না।
এমন বলা অন্যায্য নয় যে, কালিদাস কর্মকারের ছবি যে কোনো দর্শককে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ছবির দৃশ্যময়তা নিয়েই দর্শককে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
এমনকি ছবির নিচে সচরাচর কোনো শিরোনাম থাকে না, যা থেকে একজন দর্শক ছবির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে পারে। অন্যদিকে শিল্পী মনে করেন বাস্তবতা থেকে বিমূর্ত চিত্রকলার দিকে যে অভিযাত্রা তা মানুষের অভিজ্ঞতাকে গাঢ়তর প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম।
২০১৬ খ্রিস্টাব্দের শুরুতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে কালিদাস কর্মকার মাসব্যাপী একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এ সময় একাধিক অনুষ্ঠানে কালিদাস কর্মকার দর্শকের উপস্থিতিতে ছবি এঁকেছিলেন, যা ছিল সবার জন্য এক তুলনারহিত অভিজ্ঞতা। তার চিত্রাংকন কৌশলে অন্যতম হলো রঙের এক পলেস্তারার ওপর আরেক পলেস্তারা চাপিয়ে যাওয়া- আর এই পুনঃক্রমিক অনুশীলনের মধ্য দিয়েই বিচিত্র বর্ণচ্ছ্বটার সৃষ্টি হয়। তার ওপর সরু-মোটা তুলির টানে ও ইঙ্গিতময় নকশা বুনট ফুটে ওঠে।
শেষাবধি একটি দ্বিমাত্রিক পটভূমিতে রঙ এবং রেখায় আভাসিত হয় প্রতীকমর্মী দৃশ্যপট, যেমন কি-না জোয়ারের পানি নেমে যাওয়ার পর নদী-তীরে বালিকাভূমিতে ফুটে ওঠে অসংখ্য রেখার অনবদ্য বাক্সময় অস্তিত্ব।
এভাবেই কালিদাস কর্মকার তার শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চিত্রকলাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন যে বাংলাদেশের চিত্রকলা বৈশ্বিক আধুনিকতার মাত্রা স্পর্শ করবে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশে, ঢাকা শহরে, একটি মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট হবে। তিনি ভাবতে ভালোবাসতেন, কেবল তার নয়, সারা পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত চিত্রপ্রদর্শনীতে বাংলাদেশের অনেক শিল্পীর ছবি প্রদর্শন করা হচ্ছে; সংগ্রহ করে রাখা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক শিল্পকলা জাদুঘরে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশের চিত্রকর্ম নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হচ্ছে পৃথিবীজুড়ে এবং নতুন প্রজন্মের শিল্পচিন্তার দৃশ্যমান দিগন্ত ভেদ করে অন্য পৃথিবীর সন্ধান করছে।
অতি সম্প্রতি তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। এ সময় যাওয়ার জন্য তিনি মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। আরও অনেক কিছু করবার কথা ভাবছিলেন; তার দুই চোখজুড়ে আরও অনেক স্বপ্নের ঝিলিক ছিল। দেশের চিত্রকলা নিয়ে আরও অনেক চিন্তা ও পরিকল্পনা ছিল। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ তার প্রয়াণে এমন একজন অগ্রজকে হারালো, যিনি সমস্ত মানবিক সংকীর্ণতা এবং দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠে কেবল চিত্র সাধনায় জীবন ও মনন উৎসর্গ করেছিলেন।