ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

৪৯ বছরেই বিস্মৃত জ্ঞানতাপস

সাইদ রহমান
🕐 ১০:৩৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ১২, ২০১৮

১৯৬৯ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুর একদিন কি দুদিন আগে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার শেষের পাতায় হেদায়েত হোসেন মোর্শেদের একটি লেখা বেরিয়েছিল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে দেখা করার অভিজ্ঞতা থেকে সেটা লেখা। সেখানে ড. শহীদুল্লাহকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি কি জাতির উদ্দেশে কিছু বলতে চান। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে যে কথাটি বলেছিলেন, তা তার আজীবনের সাধনা বাংলা ভাষায় নয়, ইংরেজিতে- ‘I will be forgotten very soon.’

মহামানবরা নাকি দিব্য দৃষ্টিতে ভাবিকাল দেখতে পান। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শুধু দুদিন পরে তার অন্তর্ধানই দেখতে পাননি, দেখেছিলেন যে সেই আগাম যে সময়, যখন তার রক্তে-শ্রমে-ঘামে-মেধায় গঠিত জাতি তাকে ভুলে যাবে, তিনি বিস্মৃত হয়ে যাবেন অতি দ্রুত। তার মৃত্যুর ৪৯ বছরের মধ্যেই সত্যে পরিণত হয়েছে তার বাণী। আমরা বিস্মৃত হতে বসেছি জ্ঞানতাপসকে।
আজ বাংলার শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, ভাষাসৈনিক, ধ্বনিতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, গবেষক, শিক্ষক, সাহিত্যিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী। এর মাত্র দুদিন আগে অর্থাৎ ১০ জুলাই ছিল তার জন্মবার্ষিকী। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত চব্বিশ পরগণা জেলার পেয়ারা গ্রামে ১০ জুলাই ১৮৮৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ঢাকায়, ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে সমাহিত করা হয়। ভাষাক্ষেত্রে তার অমর অবদানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার গোটা জীবনব্যাপী বাংলাভাষা, ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে একে একটি মজবুত ভীতের ওপর দাঁড় করার চেষ্টা করে গেছেন। ‘মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি সব মানুষের পরম প্রিয় ও শ্রদ্ধার বস্তু’-এ অমর বাণীর যিনি উদ্গাতা তিনি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ ও পণ্ডিত জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
১৯৪৮ সালে পূর্বপাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে তা মালা-তিলক-টিকে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো টি নেই।’
বাংলা একাডেমি স্থাপন ও সংগঠনের চিন্তা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহই প্রথম করেন। ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৮-এ পূর্বপাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ভাষা সংক্রান্ত একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি করেন তিনি। এ ছাড়া বাংলা বর্ষপঞ্জিকার সংস্কারে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অবদান অসামান্য। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক গঠিত বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়।
এই মহামানবকে আমরা ভুলে গেছি। শুধু কি তাই, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অনড় ধর্মবিশ্বাসকে এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতা রূপে চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে নানা সময়। তার কনিষ্ঠ পুত্র মুর্তজা বশীর মনে করেন, এসব ধারণার কারণ হলো তার দাড়ি, তিনি নামাজ পড়তেন। এটাই হলো তার মূল কারণ। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সুনন্দন কুমার সেন রচিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জীবনীগ্রন্থেও ওই ভুল ধারণার প্রতিধ্বনি দেখতে পাই। সেখানে উল্লিখিত হয়েছে, তার ধর্মীয় গোঁড়ামির জন্য আমাকে চিত্রশিল্পচর্চায় সম্মতি দিতে পারেননি, আসলে তা ঠিক নয়। তার অনড় ধর্মবিশ্বাসকে এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতা রূপে চিত্রিত করা হয়েছে যা শহীদুল্লাহ-চরিত্রে কালিমালেপন ছাড়া আর কিছু নয়।’
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে বিস্মৃতির সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, তার নামে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তার নামকরণ করা হলেও সবাই মিলে সেটিকে ভুলে যাওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে হলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি নামফলক-‘জ্ঞানতাপস ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সড়ক’। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ১০ জুলাই ২০০৭ তার জন্মদিনে যৌথভাবে ফলকটি উদ্বোধন করেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ।
কিন্তু এই ফলকের ব্যাপারে আশপাশের কেউ-ই কিছু জানেন না। জানতে চাইলে রাস্তার উল্টো পাশের দোকানিরাও ফলকটির সন্ধান দিতে পারেননি। এমনকি পাশ ঘেঁষে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের একাধিক ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করা হলে তারাও কিছু বলতে পারেননি। হলের পাশেই আছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বাবুপুরা পুলিশ ফাঁড়ি। তারা সাফ জানিয়ে দিলেন, আমরা কিছুই জানি না। ওই সড়ক ধরে আরেকটু এগুলেই খ্যাতনামা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি’।
অন্তত ঐতিহ্য সন্ধানী এই প্রতিষ্ঠানটি তাদের ঠিকানায় সড়টির সঠিক নাম লিখবে- এমনটা আশা করে ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, তাদের সব ঠিকানা এমনকি সব প্রকাশনায়ও সবার মতো করে লেখা, ৫, পুরাতন সচিবালয় রোড, রমনা, ঢাকা। এ বিষয়ে খোলা কাগজের পক্ষ থেকে এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক, যিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, ড. সাব্বীর আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি অবাক হয়ে বলেন, ‘ও আচ্ছা, এমনটা আছে নাকি! আমি দ্রুত এ ব্যাপারে স্টেপ নেব। তবে সিটি করপোরেশনের উচিত ছিল, বিষয়টি আমাদের জানানো।’
নিচতলায় বসা এশিয়াটিক সোসাইটির সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের কর্মকর্তা জুলফিকার জানালেন, ‘শুধু আমরা না, সরকারের সব নথিপত্রেও এশিয়াটিক সোসাইটির ঠিকানা হিসেবে ৫, পুরাতন সচিবালয় রোড লেখা হয়।’ প্রমাণ হিসেবে তিনি এই প্রতিবেদককে সংস্কৃত মন্ত্রণালয় থেকে আসা কিছু চিঠিও খুলে দেখালেন।
এ বিষয়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে শিল্পী মুর্তজা বশীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি খোলা কাগজকে বলেন, ‘এ নিয়ে আমি নিজেও এশিয়াটিক সোসাইটিকে বলেছি, তারা আমাকে একই উত্তর দিয়েছে। সিটি করপোরেশনকে বলেছিলাম, কোনো কাজ হয়নি। শুধু নামফলক বসালেই তো আর কাজ শেষ হয়ে যায় না। করপোরেশনের উচিত এশিয়াটিক সোসাইটিকে এই প্রশ্ন করা, কেন তারা সড়কের সঠিক নামটা ব্যবহার করছে না। তারা রাস্তার দোকানগুলোর সঙ্গেও বসতে পারে, তাদের এ ব্যাপারে জানাতে পারে। দোকানগুলো এখনো লিখছে, ৫নং ওল্ড সেক্রেটারিয়েট রোড। ব্যাপারটা দুঃখজনক তো বটেই!’
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে কি আমরা ভুলে গেছি, এমন প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী মুর্তজা বশীর বলেন, ‘তা নিয়ে আমার আর কী বলার থাকতে পারে, সেটা আব্বা নিজেই বলে গেছেন মৃত্যুর দুদিন আগে। আমরা তো তা সত্য প্রমাণ করে যাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার জানা মতে, এ দেশে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে নিয়ে কেউ গবেষণা করেনি। কোনো পিএইচডির কথাও আমার জানা নেই। তবে পশ্চিমবঙ্গের দুজন শহীদুল্লাহ সম্পর্কে গবেষণা করছেন। তারা আকিকুল ইসলাম এবং অনিরুদ্ধ আলি আক্তার। এরা দুজন করছে, একজন করছে শহীদুল্লাহর ধর্মীয় দিকটা। আরেকজন করছে বাংলা সাহিত্য নিয়ে। দুজনই আমার দেশের বাড়ি ২৪ পরগণার চন্দ্রকেতুগড় শহীদুল্লাহ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক।’


 
Electronic Paper