ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পুঁথি সংগ্রহের প্রবাদপুরুষ

আসমাউল হুসনা
🕐 ২:৫২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১১, ২০১৯

পুরাতন পুঁথি কঙ্কালেরই মতো। কিন্তু আমি তাহার ভিতর যুগযুগান্তের রক্তধমন ও নিঃশ্বাসের প্রবাহধ্বনি শুনিয়াছি।

বাঙালির ঐতিহ্যচর্চার নিরলস সাধক ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। তার অনুসন্ধিৎসা ও আগ্রহ ছিল বহুমুখী ও বৈচিত্র্যমণ্ডত। স্বচ্ছ ও গভীর ছিল তার দৃষ্টি। এই জ্ঞানতাপস জীবিতকালেই বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগ চর্চার প্রবাদপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। তবে মধ্যযুগের ধূসর পাণ্ডুলিপির অভ্যন্তরেই কেবল তার মনোযোগ নিবন্ধ ছিল না, স্বদেশসমাজ ও সংস্কৃতিসাধনা ছিল তার জীবনচর্চারই নামান্তর। সুদীর্ঘ কালের নিরলস সাধনার দ্বারা তিনি একাই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন। তিনি প্রাচীন বাংলা পুঁথি সংগ্রহ করেন, পুথির পাঠোদ্ধার করেন, পুঁথির পরিচিতি নিয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেন, প্রাচীন পুঁথি সম্পাদনা করেন এবং পুস্তক রচনা ও প্রকাশ করেন। সাধারণভাবে বলতে গেলে এই-ই ছিল তার কাজ। উচ্চশিক্ষা বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই তিনি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য আবিষ্কার করে এমন এক স্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন, যা অন্য কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই জন্যই তিনি অর্জন করেছেন সাহিত্যবিশারদ এবং সাহিত্য সাগর উপাধি।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে যাদের আগ্রহ, তাদের কাছে সাহিত্যবিশারদ আবদুল করিম অবশ্যই সুপরিচিত নাম। কিন্তু তারা যদি আবদুল করিম সাহেবকে গাছ ঝাঁকি দিয়ে বরই কুড়ানোর মতো করে খুব সহজেই ‘পুঁথি সংগ্রাহক’ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন, তাহলে বলব আরেকটু গভীরে ভাবুন। তার এসব পুঁথির বিপুল সংগ্রহ বাঙালির সাহিত্য-ইতিহাসে আর জাতীয়তাবোধে কী ভূমিকা রেখেছে তা অনুভব করুন। ওই পুঁথি সংগ্রহ করে পাঠোদ্ধার না হলে আজ আমরা বাংলার ঐতিহ্য সম্পর্কে মূর্খই থেকে যেতাম। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের সাহিত্যের পিঠে ভর করেই আমাদের আজকের সাহিত্যযাত্রা। আর সে সাহিত্যকে আমাদের সামনে এনে দিয়েছেন এই সাহিত্যবিশারদ। আমরা তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারি, তাকে চর্চা করতে পারি। কিন্তু তাকে অস্বীকার করা বা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা নিতান্তই মূর্খতা। কারণ, তাহলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকেই অস্বীকার করা হয়।

‘বঙ্গ-সাহিত্যের জন্য আমি এমন কিছু করি নাই, যাহা লইয়া আমি গর্ব করিতে পারি। আমাদের পূর্বপুরুষের প্রচুর সাহিত্য-সম্পদ (যাহাকে রত্নসদৃশ মনে করা যাইতে পারে) ভূগর্ভে প্রোথিত হইয়া গিয়াছিল। সে সকল রত্ন ভূগর্ভ উৎখাত করিয়া আমি লোকলোচনের গোচরীভূত করিয়াছি। তজ্জন্য আমাকে অনেকে কতকগুলি পুঁথির সংগ্রাহক মাত্র মনে করেন এবং আমিও নিজেকে তদধিক কিছু মনে করি না।’

বাংলা সাহিত্যের এই বটবৃক্ষ একের পর এক পুঁথির পাঠোদ্ধার করার সময়ই তা প্রকাশের গুরুত্ব অনুভব করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও সেগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে না পারার বেদনা তাকে মুক্তি দেয়নি। আবদুল হক চৌধুরীকে ১৯৪৭-এ লেখা এক চিঠিতে সেই বেদনার কথা কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই বলেছিলেন,
‘আমি মোস্লেম রচিত প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় নাম দিয়া প্রাচীন পুঁথির বিবরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে কয়জন ধনীর কাছে সাহায্য ভিক্ষা চাহিয়াছি। কিন্তু ধনীরা যতই ধনবান হউক, সাহিত্যের মর্যাদা বুঝে না। তাই তাদের কাছে কিছু পাইবার আশা করি না। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানের মারফত সাধারণের কাছে ভিক্ষার ঝুলি ধরিয়াছি। সকলে ২-৪ টাকা করিয়া দিলে আমার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে।’

আবদুল করিম ১৮৭১ সালের ১০ অক্টোবর তারিখে বৃহত্তর চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদণ্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৯৩ সালে ২২ বছর বয়সে তিনি পটিয়া স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন, মুসলিম ছাত্র হলেও এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তার অন্যতম বিষয় ছিল সংস্কৃত। সংস্কৃত জ্ঞান পরবর্তী জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসে তার সাহিত্য চর্চায়। ড. শহীদুল্লাহর মতে, সম্ভবত গোটা বাংলাদেশে আধুনিক যুগে তিনিই প্রথম সংস্কৃত পড়ুয়া মুসলমান। এর পর চট্টগ্রাম কলেজে এফ এ ক্লাসে দুই বছর অধ্যয়ন করেন, পরীক্ষার কিছু সময় আগে তিনি টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হলে পরীক্ষা দেওয়া আর হয়নি এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার এখানেই সমাপ্তি ঘটে।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ নিজেই তার পুঁথি সংগ্রহের বিবরণ প্রকাশ করেন, দুই খণ্ডে এই বিবরণ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। প্রথম খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যায় ৪৩৪ থেকে ৫০০ সংখ্যক পুঁথির বিবরণ প্রকাশিত হয় ১৩২০ বঙ্গাব্দে এবং প্রথম খণ্ড প্রথম সংখ্যায় ১ থকে ৪৩৩ সংখ্যক পুঁথির বিবরণ প্রকাশিত হয় ১৩২১ বঙ্গাব্দে। এই বিবরণ প্রকাশিত হওয়ার পরও তিনি পুঁথি সংগ্রহ করেন। তার জীবিতাবস্থায় ১৯৫০ সালে তিনি সংগৃহীত মুসলমান রচিত পুঁথিগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন, তার সংখ্যা ৬৯৫, এবং তার মৃত্যুর পরে ১৯৫৩ সালে হিন্দু রচিত পুঁথিগুলো ড. আহমদ শরীফ রাজশাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে দান করেন, যার সংখ্যা ৩৮১টি। পুঁথি পরিচিতি এবং বাংলা প্রাচীন পুঁথির বিবরণ ছাড়াও সাহিত্য বিশারদ নিজে ৯টি প্রাচীন বাংলা কাব্য সম্পাদন করেন। এছাড়া সাহিত্যবিশারদ এবং ড. এনামুল হক যৌথভাবে ১৯৩৫ সালে ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। সাহিত্যবিশারদের শ্রেষ্ঠ কীর্তি আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার ও তার সম্পাদনা করা। কিন্তু এর পুস্তকাকারে প্রকাশিত রূপ তিনি দেখে যেতে পারেননি।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক ধ্যাননিমগ্ন যোগী, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রিধারী না হলেও তিনি নিজের সাধনায় প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের বিস্মৃত বা উপেক্ষিত এমন রত্নভাণ্ডার উদ্ধার করেন এবং জনসমক্ষে প্রচার করেন যে, তিনি উপরোক্ত সম্মান অর্জনের উপযুক্ত বিবেচিত হন। ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ পরলোক গমন করেন।

 
Electronic Paper