মাংস
সাঈদ আজাদ
🕐 ১২:৪২ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৯
আম্মা, কতদিন মাংস খাই না। আহ্লাদী গলায় বলে রুবি। আউজকা ভাতের সাথে খাসির মাংস নিয়া আইস।
-খাসির মাংস! ফক্কিন্যির ঘরের ফক্কিন্যি, খালি ভাতই খাইতে পাস না, আবার লগে চাস মাংস, তাও খাসির । তর কোন নাং বইসা আছে খাসির মাংস লইয়া!
পেঁয়াজ কুচাতে কুচাতে রাহেলার চোখ পানিতে ভরে উঠে, পেঁয়াজের ঝাঁজেই বোধহয়। আহা, জ্বোরো মেয়েটা, না হয় সাধ করে খাসির মাংস খেতে চেয়েছে, অমন বকাটা না দিলেও হতো। ক’দিন জ্বরে ভুগে মেয়েটার মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে, তার ওপর মায়ের অমন মুখঝামটা। মলিন মুখে বড় বড় চোখে দিশেহারা হয়ে তাকিয়ে ছিল শুধু, মুখে আর কিছু বলেনি। ...ভেবে একটু যেন আনমনা হয়েছিল রাহেলা, চোখ মুছে ফের কাজে মন দেয়।
গেণ্ডারিয়া রেলস্টেশনের কাছে ছোট একটা হোটেলে কাজ করে রাহেলা। দৈনিক মজুরি পায় আড়াইশ’ টাকা। সঙ্গে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার। কাজ শেষে বিকেলের দিকে দুপুরের খাবার খেয়ে চলে যায়। তবে বেশিরভাগ দিনই না খেয়ে, খাবার সাথে নিয়ে যায়। যেদিন কাজে আসতে পারে না, সেদিন টাকা নেই। খাবারও নেই। এমনই চুক্তি।
হোটেলটা ছোটই। রেল লাইনের পাশে ঝুপড়িমতো ছোট একটা ঘর। দু’দিকে লম্বা দু’টা টেবিল, সাথে বসার জন্য মাপমতো লম্বা বেঞ্চ। খায়, রিকশাওয়ালা ঠেলাওয়ালা দিনমুজুর কি ভাসমান মানুষ সব। মালিক হাসমত টাকা-পয়সার হিসাব রাখে। একটা অল্পবয়সী ছেলে আছে, রফিক। সে হাসমতের সাথে বাজারে যায়, খেতে আসা লোকদের খাবার পরিবেশন করে।
অসুস্থ মেয়েটা একা রয়েছে ঘরে, ভেবে একটু শঙ্কিত হয় রাহেলা। আসলে শুধুতো অসুস্থই নয়। জন্মের পর থেকেই রুবির দু’ পা হাঁটুর নিচ থেকে শুকনো। ছোটবেলা যেখানে বসিয়ে রাখত সেখানেই বসে থাকত, সারাদিন। এখন অবশ্য নড়তে চড়তে জানে। মাটিতে পাছা টেনে টেনে চলে। ...তা হোক খোঁড়া, তাই বলে বয়সতো আর বসে নেই। আসল ভয়টা সেখানেই। পা দু’টা শুকনো হলে কী হবে, শরীরটা তো আর শুকনো নয়। মেয়ের দিকে তাকালে ভয়ই লাগে রাহেলার। ষোল বছরেই রূপ কেমন ঝকমক করে। রূপটা মেয়ে পেয়েছে রাহেলারই। বয়সকালে রাহেলাকে যে দেখত, কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত। এত সুন্দর মানুষ হয়! যেমন ছিল গায়ের রঙ, তেমনই মুখের ডৌল। খাড়া নাক। বড় বড় চোখ। গোছা গোছা চুল। শরীরের গড়নও ছিল দেখার মতো। লম্বা ছিপছিপে রাহেলাকে দেখতও পুরুষরা! ...মেয়ে যেন সেই রূপই পেয়েছে। বাইরে গিয়ে বসলে বস্তির পুরুষরা চোখ দিয়ে গিলে। ভয়ের কথা হলো, মেয়েটাও যেন একটু আশকারা দেয় বয়সী ছেলেদের। রাহেলা সারাদিন থাকে বাইরে, কোনদিন না আবার অঘটন ঘটে!
-খালা ধর, বাজারের ব্যাগ। রফিক হাসমতের সাথে বাজারে গিয়েছিল, ফিরে রাহেলার হাতে বাজার ধরিয়ে দেয়।
-আইজকা মনে লয় একটু দেরী হইল তগ?
-কাপ্তান বাজারে গেছিলাম খালা। হাসমত মামায় আইজ খাসির মাংস আনছে। আর গজার মাছও।
অভাগী মেয়েটা সকালে খাসির মাংস খেতে চেয়েছে, আর আজই কি-না প্রথম হাসমত খাসির মাংস নিয়ে এলো হোটেলে! ভেবে একটু অবাক হয় রাহেলা। মনে হয়, কপালে ছিল খোঁড়া মেয়েটার!
-হ রাহেলা, কাস্টমার ত দিন দিন বাড়তাছে। এখন মানুয়ের হাতে পয়সা আছে। ভালো কিছু খাইতে চায়। তাই নতুন বাজার করলাম। রান্নাটা ভালা কইরা কইরো। তোমার হাতের রান্না অবশ্য ভালাই। তার রান্না যে ভালো রাহেলা নিজেও জানে। তা হাত কি এমনি এমনি পেকেছে! সারা জীবন তো রান্না ঘরেই গেল। যৌথ সংসারে বিয়ে হয়েছিল রাহেলার। ছিল বাড়ির বড় বউ। সে অবশ্য সম্পর্কের বড়, বয়সের নয়। রাহেলার স্বামী তেজবর। কী কারণে আগের বউদের সাথে বনিবনা হয়নি কে জানে! শেষ বয়সে বিয়ে করেছে রাহেলাকে। প্রায় রাহেলার বাপের বয়সী। কী রূপ ছিল রাহেলার। সবাই বলত, বড় ঘরে বিয়ে হবে। ভালো বর পাবে। ...কাজেকামের ফাঁকে ফাঁকে রাহেলার মনে হতো, সব ছেড়ে ছুড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে দেরী হয়ে গেছে। কোলে পিঠে তিন তিনটা মেয়ে তখন রাহেলার। রাহেলা চলে গেলে তাদের কী হবে! তাছাড়া বাপের অভাবের সংসার, সেখানে ফিরলে খাওয়ার মুখ একটা বাড়বে। আর যাই হোক, স্বামীর সংসারে দু’বেলা দু’টা ভাততো পায়।...সব ভেবে রয়ে গেল।
খ.
আদা রসুন বাটার গন্ধে জায়গাটা ম’ ম’ করে। ...রাহেলা জিরা বাটে। গরম মসলা বাটে। বাটা শেষ হলে, সব মসলা মাংসের সাথে মিশায়। হলুদ মরিচ লবণ তেল মেখে রেখে দেয় মাংসটা। মাছ কুটেছে আগেই। পরিষ্কার টুকরাগুলো একটা ঝাঁজরিতে রেখেছিল। পানি ঝরে গেলে ভাজতে সুবিধা। সবজিও আগেই কুটে রেখেছে। তাহলেও আজ সবকিছু গোছাতে গোছাতে দেরী হয়েই গেল। খেতে এখনই আসতে শুরু করবে লোকজন। তোড়জোড় করে দ্রুত রান্না বসায় রাহেলা।
-খালা, রান্না কদ্দুর তোমার? কাস্টমার তো আসা শুরু করছে। রফিক এসে রাহেলার কাছে বসে।
-এই হইয়্যা আইল রে রফিক। মাংসটা নামলেই দিতে পারি।
-মাংসের কী গন্ধ বাইর হইছে খালা! আইজ দেখবা লোকজন বেশি ভাত খাইব।
-খাসির মাংস একটু যত্ন কইরাই রানতে হয়। যেন ছাগল ছাগল গন্ধটা না থাকে। লোকজনের ভালা না লাগালে হইব ক।
-খালা, তুমি কি জান, তোমার হাতের রান্নার কারণে আমগ হোটেলে কাস্টমার বাইরা গেছে? আশপাশের সব হোটেল বাদ দিয়া লোকজন এই হোটেলে আসে। মামায়ত কইল, হোটেলটা বড় করব।
-তাইলে তো ভালাই। আমগই সুবিধা। ...কীরে অমন কইরা আমার মুখের দিকে চাইয়্যা রইছস ক্যান!
রফিক থতমত খায়। যেন একট লজ্জাও পায়। আসলেই ও রাহেলার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে বলল, তুমি যখন কথা কও, আমার মায়ের মতো লাগে। ঠিক মায়ের মতো মুখ নিচু কইরা, একটু একটু হাসো।
-তর কি মা নাইরে রফিক?
-না খালা। কবে মরছে! মায়ের চেহারা ভুইল্যা গেছিলাম। তোমারে পরথম যেদিন দেখলাম, মনে হইছিল, মায়ের লগে কই য্যান মিল আছে। পরে বুঝছি, কথা কওয়ার সময় তোমারে মায়ের মতো লাগে।...তোমার লাইগ্যাই আমি এই হোটেলে কাম ছাইড়া যাই নাই। না হইলে আমি এক জাগায় এতদিন কাম করি না।
রাহেলা মনে মনে একটু লজ্জিত হয়। আহারে, কত আর হবে ছেলেটার বয়স! বার কি তের। মাছ ছ’য়েক ধরে ছেলেটা এক সাথে কাজ করে, প্রায়ই কাজের ফাঁকে ফাঁকে কাছে বসে কত কথাবার্তা বলে। মা নেই ছেলেটার। জানতেও পারেনি।
-তুই থাকস কার লগে?
-আমি তো এই হোটেলেই থাকি!
-হোটেলে! তর বাপের লগে থাকস না?
-সৎ মায়ে জাগা দেয় না। খালা, কাস্টামাররা আসতাছে, আমি যাই। তুমি তাড়াতাড়ি তরকারি নামাও।
খাসির মাংসের ঝোলটা শুকিয়ে থকথকে হয়ে এসেছে, বেশ গন্ধও ছড়িয়েছে। রাহেলা নামায়।
দুপুর গড়িয়েছে, খদ্দের আসা কমেছে এখন। এঁটো বসন বাটি সব ধুতে বসে যায় রাহেলা। ঘষে ঘষে চকচকে করে সব।
রাহেলা আর রফিক খেতে বসে। খায় রফিক একাই। রাহেলা নিজের ভাগের খাবার পলিথিনে ভরে। ঢকঢক করে পানি খায় দুই গ্লাস। রফিক জানে, রাহেলা খালার মেয়ে আছে। দুপুরের খাবার খালা মেয়ের সাথে খাবে। নিজের খাবার না খেয়ে প্রায়ই অমন সাথে নিয়ে যায় খালা।
ভাতের পুটলিটা ভালমত আঁচলের তলে লুকায় রাহেলা। জায়গাটা যেন একটু ফুলে থাকে। অবশ্য লুকানোর দরকার ছিল না। হাসমত জানে, রাহেলা দুপুরের খাবার না খেয়ে নিয়ে যায় প্রায়ই। তবু রাহেলা সংকোচ বোধ করে। আজ যে...
-রাহেলা, আইজ মাইয়্যার লাইগ্যা খাওন নিলা না? রাহেলা একবার হাসমতের দিকে তাকায়। চোখ নামিয়ে বলে, খাওন নিছি।
-মাংস নিছ, মাংস? আইজ আমার হোটেলে পরথম খাসির মাংস রানলা! মাইয়্যার লাইগ্যা একটু নিবা না।
রাহেলা কথা বলে না। চুপ করে থাকে। রফিক আর রাহেলার মাছ তরকারি ডাল খাওয়ার কথা। কোনোদিন মাংস খায়নি ওরা। আজ রাহেলা যে খাসির মাংসের ঝোল নিয়েছে, হাসমত কি জেনে গেল? -কী, কথা কও না যে। দেখি তোমার পুটলিটা দেখি।...এই কী, খালি ঝোল আর চর্বি!
-আমি আসলে হাসমত ভাই...দুই তিন জন কাস্টমার খাওনের পর যে ঝোল আছিল...সেই ঝোলটুক নিছি।...বিশ্বাস কর, হাড়িতে হাত দেই নাই।
-তোমারে কি না করছি নাকি মাংস নিতে! আইজ পরথম খাসির মাংস রানলা, মাইয়্যাটারে একটু খাওয়াইবা না।...এই রফিক, দেখত মাংস আছে কেমন।
-মামা, ভালাই আছে। আরও পাঁচ ছয় জন খাইতে পারব।
-হারামজাদা তাড়াতাড়ি একবাটি মাংস লইয়্যা আয়। আইন্যা রাহেলারে দে।
রফিক একটু যেন অবাক। তবে, দ্রুতই বাটি ভর্তি মাংস এনে রাহেলাকে দেয়। রাহেলা মাংসটুকু নিয়ে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসে।...পা কেমন আটকে আটকে যায় তার। মেয়ের ওপর রাগে শরীর জ্বলতে থাকে।...এত খাঁই মেয়ের! জীবনভর এত অভাব দেখেও কেমন করে এত সাধ আহ্লাদ থাকে। শরীর যেমন হোক, বয়স তো আর কম না!
গ.
ধীর পায়ে রেললাইন ধরে হাঁটছে রাহেলা। কোথায় যে চলে গেছে রেললাইনটা! ...একদিন রাতের বেলা রাহেলা রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর গিয়েছিল। অনেক দূর! দেখতে চেয়েছিল, রেলের লাইন দু’টা কোথায় গিয়ে মিলেছে। হেঁটেছে অনেক পথ। দেখেছে, কোথাও মিলেনি লাইন দু’টা! ...একবারতো মনে হয়েছিল, হাঁটতে হাঁটতে চলেই যায়। হোটেলের কাজ ছেড়ে, রেল বস্তির ঝুপড়ি ছেড়ে। যেতই, খোঁড়া মেয়ের জন্যই ফিরে এসেছে। রাহেলা চলে গেলে রাত না পোহাতেই হয়তো পশুরা ছিঁড়ে খাবে সোমত্ত মেয়েটাকে। ...সেদিন রাতেই প্রথম রাহেলার ঝুপড়িতে এসেছিল হাসমত। ...বয়স তো কম হলো না রাহেলার। চল্লিশের বেশিই। এখনো কী আকর্ষণ আছে তার শরীরে! হয়তো আজ রাতেও আসবে হাসমত। মাংস দিল যে! ...হাঁটতে হাঁটতে রাহেলার মনে হয়, রেলের লাইন দু’টা যেন সুখ আর তার কপাল। কখনো একসাথে মিলে না। হয়তো কোনো একদিন ঠিকই রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে এই শহর ছেড়ে চলে যাবে রাহেলা।