জীবনানন্দের ‘জলপাইহাটি’
ড. মনামী বসু ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৯

কবি জীবনানন্দ এক যন্ত্রণাবিদ্ধ, বহুস্তরীয় সমাজ-সময় পর্বের আখ্যান রচনা করেন ‘জলপাইহাটি’-তে। ‘জীবনানন্দ’ স্মরণ উচ্চারণে এক গভীরতর নৈঃশব্দপ্রেম-অপ্রেম, অনুরাগ-বীতরাগ, জীবন ও মৃত্যুস্পর্দ্ধার দ্বন্দ্বময় অভিজ্ঞান-দর্শন আমাদের স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎকে উদ্বেল করে। পাঠকচিত্ত এক অনতিক্রম্য বিষাদ-নৈঃশব্দ্য মৃত্যুশীতলতায় এক দূরতর নির্জন আশ্রয়দ্বীপের সন্ধান পায় যেন। আধুনিক যন্ত্রণাময় জটিল জীবনে মধ্যবিত্তের আত্মসংকট, তার যন্ত্রণা, তার নির্বেদ, তার মুক্তি এমন চরম ভাষ্যরূপ বোধহয় পায়নি কখনও।
‘জলপাইহাটি’ চল্লিশের দশকের উপন্যাস। দেশ স্বাধীনতার প্রেক্ষিত, দাঙ্গার রক্তাক্ত সত্য বাস্তবতা; দেশভাগ এর ছিন্নমূল, বিপর্যস্ত আত্মসত্তার কাহিনী ‘সেকেন্ড ক্লাস’ পাওয়া ইংরেজির অধ্যাপকের ব্যক্তিগত লড়াই, তার সামাজিক স্থানাঙ্কের বিনির্মাণ- এই সমস্তই ধরা থাকে এই আখ্যানের বুনোটে-বুনোটে। চল্লিশের দশক-স্বাধীনতা, দেশভাগ, দাঙ্গা, ছিন্নমূল আত্মসত্তার বিনির্মাণের ইতিহাস বহন করে চলেছি আজও আমরা। আমাদের স্মৃতিতে, আমাদের সত্তায়, ভবিষ্যতে নিস্তার নেই; যে আহত, রক্তাক্ত স্মৃতিবীজ উপ্ত হয়েছিল এক সময়পর্ব ধরে, সেই সংকট মুহূর্ত আজও আমাদের ব্যথাতুর করে তোলে। ‘জলপাইহাটি’-তে আমরা এই দেশভাগের যন্ত্রণাকে অনুভব করি। আমরা প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করি ‘জলপাইহাটি’র নিশীথ বড় বেশি ‘জীবনানন্দীয়’।
জীবনানন্দের কবি জীবনচর্যা কম বেশি সকলেরই জানা। তাই এই উপন্যাসে নিশীথের সংকটের সেই কাব্যভুবনের আত্মগত অংশীদার, একথা মনে হয়। নিশীথের আর্থিক সংকট, কর্মজীবনের যে রৈখিক উপস্থাপনা এই উপন্যাসে রয়েছে তা যে কোনো সময়পর্বের সঙ্গে সহজেই তার সম্পর্কায়নটি তৈরি করে নিতে পারে। শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত শ্রেণিসম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত নিশীথের সংগ্রাম, তার অভিযোজনের আকাক্সক্ষা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘টিচার’ গল্পটি মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু গল্পের ‘টিচার’ একটি চরিত্র, আত্মকেন্দ্রিক; কিন্তু নিশীথ আত্মমগ্ন, তার ভাবনার বৃত্ত-পরিধি বহুব্যাপ্ত। তাই কলেজের চাকরি না বলে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত, কলকাতায় সম্ভাবনাময় জীবনের দিকে অভিযাত্রা, সেই অস্থির সময়কে শুধু নয় সমস্ত যুগে-কালে অন্তঃশীল, অভিমানী আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষাকে মনে করিয়ে দেয়।
সমগ্র উপন্যাসজুড়ে ক্ষয়িষ্ণু সময়, মায়ামেদুর প্রকৃতির সান্নিধ্য, নারীর সহাবস্থান চিত্রকল্প, আত্মবিদের নির্বেদ মনন নিশীথের আত্মবিশ্বকে এক বহুমাত্রিক বহুস্বরিকতা দান করেছে। অভিজ্ঞান-দর্শনের আলোক-বিচ্ছুরণে সেই বহুধাবিচিত্র বর্ণসম্পাতে উপন্যাসটি আজও প্রাসঙ্গিক।
‘জলপাইহাটি ‘শিলাদিত্য’ পত্রিকায় ১৯৮১-৮২ সালে প্রথম মুদ্রণে আমাদের সামনে আসে। এই উপন্যাস ১৯৪৮ এর সময়কে ধারণ করেছে। ১৯৪৮-এর খণ্ডিত বাংলা, স্বাধীন ভারত, কলকাতার নাগরিক জীবন, রাজনৈতিক আন্দোলনের বহুস্তরীয় আত্মপ্রকাশ, শিক্ষাস্তরে চাপা রাজনীতি- এসব তার উপন্যাসে কথা বলে উঠতে চেয়েছে। যুক্তি থেকেও ‘যুক্তিহীনতার যুক্তি বিতর্ক ভাবী সময়কে যে চিন্তার রসদ জোগান দিতে পারে তার নির্বেদ দৃষ্টি আমাদের তাই-ই উপহার দিয়েছে। ১৯৪৮-এর ৮ এপ্রিল থেকে ওই সালেরই ৯ মে- একমাসে ৫১৭ পাতার একটা উপন্যাস, যার প্রতিটা শব্দের ভেতর জীবনানন্দের অনুভবের রক্তস্পন্দন ধ্বনিত হয়।
সদ্য দ্বিখণ্ডিত বাংলার পূর্বভাগে, ‘জলপাইহাটি’ গঞ্জে নিশীথ, অসুস্থ মৃতপ্রায় স্ত্রী সুমনাকে রেখে কলকাতায় আসে। কারণ জলপাইহাটি কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে যে মাইনে দেয়, তাতে বাঁচা সম্ভব নয়। নিশীথের একটি কন্যা রাণু নিরুদ্দেশ (কে বা কারা বা কীভাবে যে সে হারিয়ে যায় তার স্থির বয়ান নেই, কেবলই মনে হয় স্বাধীনতা-উত্তরকালে যেমন করে ‘পৃথিবীর অনির্বচনীয় হুণ্ডি’ একজন দুজনের হাতে থাকার ফলে ‘নারীকেও নিয়ে যায়’ ‘সব নিয়ে যায়’ এর সঙ্গে রানু সেইভাবেই বা রানুরা সেইভাবেই হারিয়ে যায়)।
ভানু, নিশীথের অপর কন্যা যক্ষ্মায় আক্রান্ত। কাঁচরাপাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য মামার বাড়িতে অবহেলায় দিন গুনছে মৃত্যুর। তার খবরও পিতা নিশীথ রাখে না। কলকাতায় ধনী বন্ধু জিতেন দাশগুপ্তের বাড়িতে সে জানতে পারে তার কন্যার অবস্থান। নিশীথের ছেলে হারীত। সে বহু আত্মত্যাগ, রক্তপ্লাবী অন্তঃসারশূন্য স্বাধীনতায় বিভ্রান্ত মানুষের পক্ষে কিছু করতে চায়- সৃষ্টি হয় তার আত্মত্যাগ বিভ্রান্তির ক্লান্ত পদক্ষেপ সময়ের আঙিনায়। সামাজিক অর্থে নিশীথ সেনের ব্যক্তিগত জীবন-বিপর্যয়ের কাহিনী যেন এক সামাজিক ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। সমাজ, সময়, দেশ-এর সংকট-সংক্রান্তিলগ্নে এক মগ্নচৈতন্যের বিষাদ-আখ্যান।
অনুপম গদ্যে কাব্যিক চেতনার মায়াময় চিত্রণ ‘জলপাইহাটি’। আমাদের তা আবিষ্ট করে। সময়কে অতিক্রম করে যাওয়া সেই কথামুহূর্ত আমাদের আত্মচেতনাকে স্তব্ধ করে। ডা. সুবল মুখার্জীর আকস্মিক আবির্ভাব ভানুকে বাঁচায়নি। সেই উপন্যাসিকের হাত ধরে এক স্বপ্ন সম্ভবকে বাঁচার আকাক্সক্ষা করেছিল পাঠক। সুমনার মৃত্যুর দিন নিশীথ জলপাইহাটি ফিরল ভানুর মৃত্যু সংবাদ নিয়ে- এ যেন শীতের সন্ধ্যেয় বসন্তের দুপুরের গল্প। স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের পাঠ ‘জলপাইহাটি’ দেশভাগ প্রেক্ষিত কিন্তু ‘সুসময়ের সাধ’ বড় বেশি ঘন হয়ে আছে এই উপন্যাসে।