রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পত্রালাপ
শ্রীচরণকমলেষু,
🕐 ২:০২ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯
আপনাকে কোনোদিন পত্র লিখিনি, এজন্য প্রথম পত্র লিখতে কেমন একটু ভয় ভয় করে। এবারে ভেবেছিলাম আপনার সঙ্গে আরেকবার দেখা করি; কিন্তু দার্জেলিং ফেরার কোনো সংবাদ পাইনি। আশা করি আপনার স্বাস্থ্য পূর্বাপেক্ষা ভালো। গত শ্রাবণ মাসে একবার জোড়া সাঁকো বাড়িতে গিয়ে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সে সময় আমার ‘পথের পাঁচালী’ সম্পর্কে কিছু লিখতে আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তখন আপনার শরীর ভালো ছিল না বলে তারপর এই নিয়ে আর কোনো কথা ওঠাইনি।
আরেকখানা ছোটগল্পের বই বের করেছি। বইখানাতে আগের লেখা গোটা দশেক গল্প আছে। দুটো ছাড়া বাকিগুলো প্রবাসীতে বের হয়েছিল। সব গল্পই পথের পাঁচালী লেখার আগে লেখা। অনেক ক্ষেত্রে ছ-সাত বছর আগেও লেখা। উপেক্ষিতা গল্পটি বইয়ে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ওটা আমার সাহিত্য জীবনের প্রথম গল্প। সে হিসেবে ওর প্রতি একটা মায়া আছে। শুধু এই জন্যই ওটা দিয়েছি।
আপনাকে একখানা পথের পাঁচালী ও একখানা মেঘমল্লার পাঠালাম। আপনার সময়মতো যদি কিছু লেখেন তবে সৌভাগ্যবান বিবেচনা করব। লেখাটা যদি কৃপা করে বিচিত্রাতে পাঠান তবে ভালো হয়। কেননা বইখানা বিচিত্রাতে প্রথম বের হয়েছিল।
আপনাকে আরেকবার দেখতে ইচ্ছে হয়। এর মধ্যে আর বোধহয় কলকাতায় আসবেন না। পথের পাঁচালীর অনুবৃত্তি ‘অপরাজিত’ উপন্যাসখানা সম্প্রতি প্রবাসীতে শেষ হয়েছে। বড়দিনের আগেই প্রকাশিত হবে। আপনি মাসিকের পাতায় উপন্যাস পড়েন না জানি, বইখানা বেরুলেই আপনাকে পাঠিয়ে দেব। তবে সেবার সমালোচনা লিখবার জন্য আপনাকে বিরক্ত করব না।
প্রণত
শ্রী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুনশ্চ : পথের পাঁচালির আরেক ভলিউম এর পরে লিখব। একটা শিশুমন বিশে^র আলোয় তার পাপড়িগুলো কী রূপে ধীরে ধীরে মেলছে, এই বিপুল রহস্যের প্রতি সচেতন হয়ে উঠছি। এই বইগুলোতে সেটাই বক্তব্য। খুব তুচ্ছ দৈনন্দিন ঘটনাগুলোও দিয়েছি। এই জন্য, যে গোটা জীবনের স্মৃতির ভা-ারে তাদের দান অমূল্য ও অক্ষয়। আপনার একটুও যদি ভালো লাগে তবে আমি রচনা সার্থক বিবেচনা করব।
রবীন্দ্রনাথের অভিমত...
পথের পাঁচালী আখ্যানটি অত্যন্ত দেশি। কাছের জিনিসেরও অনেক পরিচয় বাকি থাকে। যেখানে আজন্মকাল আছি, সেখানেও সব জায়গায়, সব মানুষের প্রবেশ ঘটে না। পথের পাঁচালী যে বাঙলার পাড়াগাঁয়ের কথা, সেই অজানা রাস্তায় নতুন করে দেখতে হয়। লেখার গুণেই যে নতুন জিনিস ঝাপসা হয়নি। মনে হয়, খুব খাঁটি, উঁচু দরের কথায় মন ভুলানোর জন্য সস্তা দরের রাংতার সাজ পরানোর চেষ্টা নেই।
বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন শক্তির জোরে। এই বইখানিতে পেয়েছি, যথার্থ গল্পের স্বাদ। এর থেকে শিক্ষা হয়নি কিছুই। দেখা হয়েছে অনেক, যা আগে এমন করে দেখিনি।
এই গল্পে গাছপালা, পথঘাট, মেয়েপুরুষ, সুখ-দুঃখ- সমস্তকে আমাদের আধুনিক অভিজ্ঞতার প্রত্যহিক পরিবেষ্টন থেকে দূরে প্রক্ষিপ্ত করে দেখানো হয়েছে। সাহিত্যে একটা নতুন জিনিস পাওয়া গেল। অথচ পুরাতন পরিচিত জিনিসের মতো সে সুস্পষ্ট।
পরিচয় পত্রিকা : বৈশাখ আষাঢ়, ১৩৪০