ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ধারাবাহিক গল্প

মায়ের মুখ

রকিবুল হাসান
🕐 ১:৫৫ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯

আমার চোখে ঝিঙে গাছ, পুঁইশাকের গাছ আর চালকুমড়োর গাছগুলো এখনো কি সতেজ ও সবুজ। আমার নিজের হাতের লাগানো গাছগুলো দেখে মায়ের চোখ যে কি খুশি হতো- সেই আনন্দে উপচেপড়া চোখ লেগে আছে আমার চোখে। মা বলতেন, তুই গাছ লাগালেই গাছভরা ফল হয়। দেখিস একদিন তোর ঘরভরা বাচ্চা হবে। তখন এ কথার মানে বুঝিনি। না বুঝেই হেসেছি। সেই ঘরগুলোর চাল আর জাংলাভরা সবুজ সবজি এখনো চোখে লেগে আছে। সেই গাছগুলো কী দারুণ সতেজ এখনো আমার চোখে- আমি আমার ঘরে যেন এক নিশ্চুপ পাখি হয়ে উঠি। অথচ মা যখন রান্না করত, তখন রান্না ঘরে চড়ুইয়ের উৎসব থাকত। সেসব চড়ুই কোথায় হারালো! মায়ের সাথে কি তারাও চলে গেছে!

এক জীবন দুঃখকে আসন বানিয়ে তার ওপর বসে থাকি, দুঃখগুলো সমুদ্রের গোপন গভীর ঢেউয়ের মতো আমার ভেতর বয়ে চলে। আমার বাইরের আনন্দ দেখে সবাই খুশি হয়, মুগ্ধতায় ডোবে। আমার ভেতরপুরের শ্যাওলাজমা নদীতে কেউ ডুব দেয় না। মা, আমি যতবার বাড়ি যাই, তোমার সেই কান্নাটা ততবারই আমার বুকের ভেতর এক বেদনা নদী হয়ে যায়। তুমি কেন অমন শব্দ করে, আর্তনাদ করে, বুক চাপড়িয়ে পাগলের মতো কেঁদেছিলে? তুমি তো আর কোনোদিন অমন শব্দ করে কাঁদোনি। 

আমি স্কুল থেকে ফিরতেই তোমার কান্না শুনে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম- মা কাঁদছে! আমি আজও তোমার সেই কান্না বুকের ভেতর ঝড়ের মতো বয়ে বেড়াচ্ছি। আমার ভেতর পোড়ামাটির কষ্টের রঙ হয়ে চিরকালের মতো সেই কান্না গেঁথে আছে। তুমি সেদিন কেন অমন পাগলির মতো কেঁদেছিলে জানিনে।

স্কুলপড়ুয়া ছোট্ট আমি সেদিন এ কান্না যে সমুদ্র সমুদ্র বেদনা- এর কিছুই বুঝিনি, মা। তারপর আমি যখন একটু একটু করে বড় হয়েছি, তোমার সেই কান্না ক্রমেই গভীর হয়ে বিদ্ধ হয়ে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে। অসহায় এক আর্তনাদ আমাকে আছড়ে ফেলে, ছিন্নভিন্ন করে আজও আমার ভেতর পদ্মার বুকভাঙা ঢেউয়ের মতো এক প্রশ্ন, মা তুমি সেদিন অমন করে কেন কেঁদেছিলে? কোন বেদনা তোমাকে বিদ্ধ করেছিল? কোন কষ্ট ও যন্ত্রণা বিষাক্ত তীরের মতো তোমাকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল? তোমার সেই কান্নাভরা মুখ সমুদ্র সমুদ্র কষ্ট হয়ে এখনো আমার বুকে আছড়ে পড়ে। জানি এই প্রশ্নের উত্তর জানা হবে না কোনোদিন আমার।

আমাদের সেই সাদাসিধে বাড়িটা এখন পুরোটাই প্রায় বদলে গেছে। আমি যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে যাব, তুমি তখন একবারই শুধু বলেছিলে, ‘আমি যেন ম্যাট্রিকটা পাস করি।’ তোমার এই কথা শুনে ছোট্ট সেই আমি খুব হেসেছিলাম। জানতাম মা, কেন তুমি এই সামান্যকে অসামান্য করে চেয়েছিলে। পড়ালেখার চেয়ে খেলাধুলা পাগল ছিলাম আমি। তারপর অগ্রজের অকৃতকার্যতা। তুমি খুব মন খারাপ করেছিলে। কষ্টে তোমার বুকটা নদীর পাড় ভেঙে পড়ার মতো ভেঙে পড়েছিল। আমি তো তোমাকে কথা দিয়েছিলাম মা, ‘আমি শুধু পাসই না ফার্স্ট ডিভিশন পাব, লেটারমার্ক পাব।’

তুমি খুব মন খারাপ করে বলেছিলে, ‘ওসব বুঝিনি বাপ, আমি শুধু চাই, তুই ম্যাট্রিকটা পাস কর।’ আমি আর কথা বাড়াইনি তোমার সাথে। আমি তো কতগুলো লেটারমার্ক নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাস করলাম। তুমি তো তার আগেই চলে গেলে নক্ষত্র হয়ে আকাশের গায়ে।

মা, আমি তো কথা রেখেছি। তুমি তো কথা রাখোনি। এভাবে তো তোমার যাওয়ার কথা ছিল না। ভয়ঙ্কর এক কঠিন জীবনের ভেতর আমাকে ফেলে হারিয়ে গেলে তুমি। বাড়িতে পা দিতেই এখনো মনে হয়, মা, আমি তো ম্যাট্রিক পাস করেছি।

তুমি তো এগিয়ে এসে দু’হাত বাড়িয়ে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে আনন্দাশ্রুতে চোখ ছলছল করে আমার দিকে তাকাও না। আমার কপালে তো তোমার স্নেহের চুমুর দাগ পড়ে না। মা, তুমি তো জানো না, আমি কতদিন কত অনাহারে পুড়ে, কত কষ্টের সিঁড়ি ভেঙে, কত অবজ্ঞা অবহেলার বিষকে সুধা মনে করে আমাকে গড়েছি, শুধু তোমার জন্য। শুধু ম্যাট্রিক নয় মা, সব ডিগ্রিই তো আমি নিয়েছি তোমার জন্য- তোমার মুখ ঈশ^রের আলোর মতো উজ্জ্বল হবে বলে। এ তো আমার ইস্পাতকঠিন জেদ ছিল মা, সর্বোচ্চ ডিগ্রিটা আমি নেবোই নেবো এবং এটা তোমাকেই দেবো বলে। বাড়িতে পা ফেলতেই মা তোমাকে খুব মনে পড়ে। বাড়িটা খুব শ্মশান লাগে। আগুনটা জ্বলে ওঠে আমার বুকের ভেতর। কেউ দেখে না সেই আগুন, সে আগুনের কোনো রঙ নেই, কোনো রঙ থাকে না।

তোমার সাদাসিধে সেই বাড়িতে উৎসবের কত রঙ এখন। সেই উৎসবের ভেতর নীরবে নিভৃতে আমি তোমাকেই খুঁজে ফিরি নিরন্তর। এক বিবর্ণ বাতাসে জেগে থাকি, উৎসবের রঙ আমাকে ছোঁয় না। তবুও সমুদ্রের উপরের নান্দনিক ঢেউয়ের মতো আনন্দের এক ছবি করে নিজেকে সবার সামনে টানিয়ে রাখি।

আর জবাফুলের গাছটা দেখি, সত্যি মা জবাফুলের গাছটা অনেক বড় হয়েছে, তার ডালপালা থেকে নতুন নতুন গাছ হয়েছে- পুরো বাড়িটাই তো জবাফুলে ছেয়ে আছে। মা, তোমাকে আমি একটুও ভুলিনি, একটি নিঃশ্বাসও না। আমি বারবার ফিরে আসি কয়া গ্রামে- আমার বাড়িতে, মাকে পাবো বলে। আমার গ্রামের ধূলিবালি-লতাপাতা-পথের আঁকাবাঁকা রেখা, গড়াই নদী, পাখিদের গান-ফুলের শোভা ও ঘ্রাণ-আমার মায়ের অবিকল মুখ হয়ে ওঠে; বলে, এই তো আমি তোর মা। আমি আনন্দে-আবেগে ঝড়োকান্নায় কয়া গ্রামকে বুকে জড়িয়ে ধরি। অগ্নিতৃষ্ণায় ডেকে উঠি, মা, মা আমার! [শেষ পর্ব]

 
Electronic Paper