বং থেকে বাংলা
নৃতাত্ত্বিক অন্বেষণ
মহীবুল আজিজ
🕐 ৪:৪১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৩, ২০১৯
বং থেকে বাংলা রিজিয়া রহমানের ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, ইতিহাসসম্মত উপন্যাস। আড়াই হাজার বছরের কাল-পরিপ্রেক্ষিতে বিবর্তিত একটি জাতির নৃ-বৃত্তান্ত উপন্যাসটির বিষয়বস্তু। ভারতবর্ষের মানচিত্রে বাঙালি জনগোষ্ঠী এবং তার স্থানিকতা বঙ্গ বা বাংলা’র ক্রমবিকাশ ইতিহাসের কাঠামোয় বর্ণনশিল্পের নানা মাত্রিকতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে উপন্যাসটিতে। প্রচলিত উপন্যাসের শিল্পতাত্ত্বিক আঙ্গিক দিয়ে এ-উপন্যাসের সমালোচনা খানিকটা দুরূহ।
কোনো বিশেষ কালগ্রন্থি বা কালসীমা এতে অনুসৃত হয়নি। আড়াই হাজার বছরের ক্রম ঔপন্যাসিকের স্ব-কল্পিত কাহিনীর পরিক্রমায়, স্ব-সৃষ্ট চরিত্রাদির আশ্রয়ে, বিচিত্র ঘটনাধারার পরিণতিতে এমন একটা অন্তিমতায় এসে ঠেকে যেখানে দাঁড়িয়ে পাঠক আর নিজেকে একা দেখেন না, এক বিশাল মানবমণ্ডলীর মধ্যে পাঠক নিজেকে আবিষ্কার করেন। ‘বং’-এর সুদীর্ঘ যাত্রা বলা যায় তখন ‘বাংলা’য় এসে নিষ্পন্ন কিন্তু এই নিষ্পন্নতা সমাপ্তি নয় বিরতি- পরবর্তী যাত্রাপথের একটি পূর্বনির্ধারক।
শুরুটা বং থেকে। প্রচলিত ঐতিহাসিক ধারণার বরাত দিয়ে ঔপন্যাসিক জানান, “অনেকে মনে করেন দ্রাবিড় বং গোত্রের নাম থেকেই ‘বংগ’ বঙ্গদেশ ও বংআল নামের উৎপত্তি।” অবশ্য একমাত্র বং-ই নয়, একটিমাত্র গোত্রের মাধ্যমে এত বহুমাত্রিক জনবৈচিত্র্য সম্ভব নয়। জলসংলগ্ন ‘বেদে’ বা ‘বাইদ্যা’ও যে স্থলের বং-গোষ্ঠীর সমান্তরালে বিকশিত অপর জনগোষ্ঠী সেটাও মনে রাখতে হয়। এই দুটি প্রধান গোত্র ছাড়াও অন্যতর গোত্রের সম্ভাব্যতাকে অস্বীকার করা চলে না।
উপন্যাসটির পাঠপ্রাক্কালিক যে-নৃতাত্ত্বিক মনোযোগ প্রাসঙ্গিক তার আলোকে বলা যায়, অপেক্ষাকৃত নবীন জাতি বাঙালি’র মধ্যে এসে মিশেছে সুপ্রাচীন বিভিন্ন জাতিসত্তার উপাদান যেসব উপাদান বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি-জীবনাচার প্রভৃতিকে বিশ্লেষণ করলে আভাসিত হয়ে ওঠে। ভেড্ডা বা ভেদ্দা নামক ভারতবর্ষের আদি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে পরবর্তীকালের বেদে বা বাইদ্যা নামের কোনো যোগসূত্র থাকা সম্ভব কিনা সেটি নৃতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় কিন্তু কখনো কখনো শব্দের অবস্থান বা রূপের মধ্যেও নিহিত থাকে তার ব্যবহৃত-সম্পর্কিত কার্যকারণ। ভেদ্দা-পরবর্তী মালয়, ডামিল (দামিল/তামিল), কন্নড়, তেলেগু প্রভৃতি প্রাচীন জাতিসত্তার উত্তরাধিকার এক ক্রম-অভিযোজন ও সংমিশ্রণ প্রক্রিয়ার পরিণামে উপনীত হয় বাঙালিত্বে। আবার সিন্ধু-সভ্যতার আদি-ভারতীয় গর্ভেও রয়েছে বাঙালিত্বের সূত্র। কাজেই বাঙালির বৈচিত্র্য তার নৃতাত্ত্বিক উত্তরাধিকারেরই ফল।
বং থেকে বঙ্গ, বঙ্গাল, বঙ্গালি, বাঙালি প্রভৃতি উদ্ভব সম্ভব বলে অনেকের ধারণা। এখানে কিছু নাম-শব্দের উৎসাহব্যঞ্জক সংশ্লেষ উত্থাপন করা যাক। বাংলা ভাষায় এমন কিছু শব্দ রয়েছে যেগুলোর অভ্যন্তরস্থিত ধ্বনি বিশেষ-বিশেষ অবস্থান ও পরিপ্রেক্ষিতের নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে। যেমন: টঙ্, চোঙ্ বা চোঙ্গা, প্রাঙ্গণ, অঙ্গন, ব্যাঙ্, চাঙ্গারি, বংশ (বাঁশ), জঙ্গল- এইসব শব্দের সঙ্গে কোন না কোন ভাবে শূন্য, ফাঁপা, বিস্তীর্ণ প্রভৃতি অবস্থান সংশ্লিষ্ট। তাই বঙ্গ শব্দটিও সেরকম একটি অবস্থানের নির্দেশক হওয়া সম্ভব।
দক্ষিণ-উত্তর থেকে অভিযোজনকারী জনগোষ্ঠীর সামনে পূর্বপ্রান্তের বিস্তীর্ণ ভূমি (যা মূলত জলাকীর্ণ, আচষা, জনহীন প্রান্তর) হয়তোবা অভিহিত হয় ‘বং’ নামেই। বাঙালির ভাষায় পরিগৃহীত দক্ষিণের ট-বর্গীয় (ট, ঠ, ড, ঢ, ণ) বর্ণ বাঙালির দক্ষিণী আদি অবস্থানকেই চিহ্নিত করে। মালয়, তামিল, তেলেগু, কন্নড়- দক্ষিণের এই চারটি অপেক্ষাকৃত প্রাচীন জাতির নিকট থেকে বাঙালি তার ট-বর্গীয় ধ্বনিসমূহ লাভ করে। শব্দের ব্যুৎপত্তি থেকেও আমরা সেটা দেখতে পাই। যেসব খাঁটি বাংলা শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করা কঠিন সেগুলো মূলত দক্ষিণাগত শব্দ।
যেমন ধরা যাক, ঘোমটা, ঘুড়ি, বুড়ি, বড়ি, বেড়াল, ডাল, ডাব, কড়ি, ঢাক, ঢোল, হাডুডু, গণ্ডা, কাড়া, ফাঁড়া, খাঁড়ি, খাঁড়া, ষ-, পাষ-, লড়াই এরকম শব্দাবলী। এসব শব্দে ট-বর্গীয় ধ্বনির সংযুক্তি শব্দগুলোর দক্ষিণী উৎসকে নির্দেশ করে। অর্থাৎ ট-বর্গীয় শব্দ যেমন দক্ষিণাগত, তাই প্রাচীনতর এবং ‘ঙ’ বা ‘ঙ্গ’-যুক্ত শব্দাবলী পূর্বমুখী অভিযোজন-প্রক্রিয়ার পরে উদ্ভূত, তাই নবাগত। আবার প্রাচীন-নবীনের মিশ্রণও দুর্লক্ষ্য নয়- রং, ঢং, টং, সং ইত্যাদি।
বাঙালির সিন্ধু-উৎসকেও তার বৈশিষ্ট্যাদি থেকে নিরূপণ করা যায়। শিব-দুর্গার পূজো, প্রধান খাদ্য হিসেবে ধান/ভাত ও মাছের ব্যবহার বাঙালির নৃতত্ত্বে সিন্ধুত্বের উপস্থিতির প্রমাণ। প্রাচীন গ্রিসের ম্লেস্ট (ভ্রাম্যমাণ বা যাযাবর), সিন্ধুর ম্লেহ/ মেলুহ এবং বাংলা অঞ্চলের ম্লেচ্ছ (আর্য-কথিত ‘ম্লেচ্ছ’-জাতি বাঙালি) এই তিনটি সূত্রের মধ্যকার পারম্পর্যকে অস্বীকার করা যাবে না।
খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার সালে সিন্ধু সভ্যতা অজ্ঞাত মারী-মড়কে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে সিন্ধুর জনগোষ্ঠী মৃত্যু থেকে বাঁচবার জন্য পূর্বমুখী অনিবার্য অভিযোজন ঘটায় এবং সেই জনগোষ্ঠী থেকে কালক্রমে জল ও স্থলনির্ভর ধারাগুলোর উদ্ভব হওয়া সম্ভব। সিন্ধুর দুর্গা বা নারী দেবীর আদি-স্বরূপের অনুকরণে পরবর্তীতে জীবন-রক্ষার প্রয়োজনে পূর্বদিকে অগ্রসরমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে মনসা বা সর্পদেবী বা পদ্মদেবীর আবির্ভাব ঘটে। পদ্মপুরাণ ভারতবর্ষে একমাত্র বাঙালিরই পুরাণ।
ভারতবর্ষের উত্তর ও দক্ষিণ হতে আসা প্রাচীন জনগোষ্ঠী কালের পরিক্রমায় পূর্বদিকে যে-মিশ্র বা সঙ্কর জাতিসত্তার জন্ম দেয় সেটি বাংলা অঞ্চলের বিশেষত্ব নিয়েই অবধারিতভাবে বিবর্তিত হতে থাকে। সেই জাতিসত্তায় এককভাবে প্রাচীনতর জনগোষ্ঠীগুলোর বিশেষত্ব আর বজায় থাকে না, এর পরিবর্তে সকল জনগোষ্ঠী থেকে লাভ করা বৈশিষ্ট্যাদি ক্রিয়মান থাকে। রিজিয়া রহমান তাঁর বং থেকে বাংলা উপন্যাসে বাঙালির সেই নৃতাত্ত্বিক সত্যের কথা বিশেষ ভাবে স্মরণে রাখেন। তাই গ্রন্থের ভূমিকায় বাঙালির জাতিগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জওহরলাল নেহরুর বিখ্যাত মন্তব্যটিকে তিনি মনে করিয়ে দেন- ‘বাংলাদেশ ভারতের অংশ নয়। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে এটা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ আলাদা দেশ।
এর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, জলবায়ু, গাছপালা প্রমাণ করে দেয় যে সে ভারত নয়।’ অবশ্য নেহরুর মন্তব্যটি খানিকটা সম্প্রসারণযোগ্য। বাঙালি তার প্রকৃতির মতো স্বাধীন অবস্থানকে আত্তীকৃত করে জীবনের উদযাপনকে বরণ করতে চেয়েছে কিন্তু তার সেই স্বাধীনতার স্পৃহা পদে-পদে, নানাভাবে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মার খেয়েছে তার দিকে বৈরিতায় আগুয়ান শক্তিসমূহের কারণে।
বাঙালির বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে যুগে-যুগে এখানে হানা দিয়েছে বিভিন্ন জনজাতির মানুষ। নিজেদের উন্নত উপায় ও উদ্ভাবনা দিয়ে তারা কেবলমাত্র স্বাধীনচিত্ততার শক্তিতে বলীয়ান বাঙালিকে গ্রাস করেছে সহজেই। কিন্তু বাঙালি তাকে গ্রাস করা অপশক্তিসমূহকে পরাজিত করবার শক্তি একসময়ে নিজেদের মধ্যে ঠিকই পুঞ্জীভূত করতে সক্ষম হয় এবং সুদীর্ঘকালের বিরুদ্ধতাকে প্রতিহত করে একদিন নিজের আত্মতাকে প্রতিষ্ঠিত করতেও সমর্থ হয় সে। এভাবেই বাঙালি জাতির আড়াই হাজার বছরের পরিক্রমার ঘটে পরিসমাপ্তি। রিজিয়া রহমানের বং থেকে বাংলা বাঙালির সেই জাতিগত পরিক্রমার উপাখ্যান।
শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসের শ্যামাঙ্গর কথা মনে পড়ে। মাটির পুতুলের নির্মিতির মধ্যে ফুটে উঠেছিল তার পূর্বপুরুষের সিন্ধুবাহিত মৃৎ-উত্তরাধিকার। বস্তুত নানাবিধ কৃষিকাজের সূত্রেই বাংলায় সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে যেটি সিন্ধু-সভ্যতার মতো এককেন্দ্রিক নয়। সিন্ধু-পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের সর্বত্র এবং বাংলায়ও গড়ে ওঠে কেন্দ্রিকতাবিহীন সমষ্টিনির্ভর সমাজ যেটি দীর্ঘদিন কৌম-কাঠামোভুক্ত থাকে। পরে সৃষ্টি হয় কৌমমুক্ত সামাজিকতা কিন্তু তাতে আদি-কৌমের বৈশিষ্ট্যসমূহও বর্তমান থাকে। আর্য-পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে কর্মকেন্দ্রিক পেশাভিত্তিক যে-সমাজ গঠিত হয় তার সমান্তরালে বাংলায় আরও আগে থেকেই সামাজিক বিন্যাস গড়ে উঠেছিল যা ছিল স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অপিচ কেন্দ্রিকতার প্রভাবমুক্ত।
যেজন্যে নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে (বাঙালীর ইতিহাস : আদি পর্ব) বলেছিলেন- “রাজা ও রাষ্ট্র ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় কখনো একান্ত হইয়া থাকে নাই। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষের সর্বত্র আমাদের জীবন ছিল একান্তই সমাজকেন্দ্রিক, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবন, আমাদের যাহা কিছু কর্মকৃতি সমস্তই আবর্তিত হইত সমাজকে ঘিরিয়া।” দ্বাদশ শতকে বাংলায় বল্লাল সেনের শাসনামলে প্রশাসনিকভাবে এ-অঞ্চলের যে শ্রেণিবিন্যাস করা হয় তাতে দেখা যায় তিনটি সংকর (উত্তম, মধ্যম ও অধম) এবং দুটি শূদ্র (সৎ ও অসৎ) শ্রেণির সবাই বিস্তীর্ণ বাংলায় সেনাগমনের বহুকাল আগে থেকেই অলিখিত এক শ্রেণিবিন্যাস সৃষ্টি করে রেখেছিল। খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকে মহাভারতের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তখন পাণ্ডব ভীমের যেসব সহযোদ্ধা ম্লেচ্ছাঞ্চল তথা বাংলায় আসে প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করার জন্য তাদের অনেকেই আর ভীমের সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে যায় না। তাদেরই একজন বং থেকে বাংলা’র নীলাক্ষ।
বং থেকে বাংলা উপন্যাসে বাঙালি জনজাতির আঁধার-বাস্তব শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের ক্রম মেনেই আলোকের দেখা পায়। যদিও তার দুর্দিন যেন সহজে ফুরোবার নয়। সহ্যের শেষ সীমা পেরিয়ে তবেই বাঙালি বিস্ফোরিত হয় সমস্ত শক্তি নিয়ে। তার সমস্ত বৈচিত্র্য, সমস্ত মিশ্রণ ও সংকরত্ব, সমস্ত অনৈক্য এক অখণ্ড একত্বে রূপ নেয়- “বং আর এলা নামে দুই আড়াই হাজার বছর আগে দুই তরুণ-তরুণী সব হারিয়ে এই পাখি ডাকা নীল জল টলটল শাপলা ফোটা বিলের ধারে, এই নদীর পাড়ে আল বেঁধে ঘর গড়েছিল। সেই বং আল আজ হাজার হাজার বছরের বঞ্চনা লাঞ্ছনা আর যন্ত্রণার আবর্তনের মধ্য দিয়ে অনেক রক্তের বিনিময়ে হলো বাংলাদেশ।” উপন্যাস শুরু হয়েছিল হারানোর নিঃস্বতা দিয়ে, শেষ হয় প্রাপ্তির পূর্ণতায়।