অগ্নিস্বাক্ষরা
কথাশিল্পীর শুভযাত্রা
কুমার দীপ
🕐 ৪:১৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৩, ২০১৯
রিজিয়া রহমানের প্রথম গ্রন্থ ‘অগ্নিস্বাক্ষরা’ প্রকাশিত হয়েছিল আশ্বিন ১৩৭৪ বঙ্গাব্দে (১৯৬৭ খ্রি.)। বইটিতে মোট গল্প আছে ১০টি। তারমধ্যে নাম শিরোনামে শুরুর গল্পটিই পাঠককে ধাক্কা দিতে পারে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তৈরি গল্প। পলাশীযুদ্ধের পর বাংলার মুসলমানদের যে দুরবস্থা হয়েছিল, তারও কিছুটা নমুনা আছে।
ইংরেজদের সহযোগী হিসেবে এ দেশের জমিদাররা, বিশেষত হিন্দু জমিদারদের অনেকেই প্রচণ্ড অত্যাচারী হয়ে উঠেছিল-তার ছবিও এ গল্পে আছে। কিন্তু যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব নিয়ে আছে- তার হলো একটি সাধারণ মুসলিম রমণীর ঘরে-বাইরে বিদ্রোহী হয়ে ওঠা, বিদ্রোহী হয়ে অত্যাচারী জমিদার ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করে; সংগ্রাম করতে করতেই আত্মাহুতি দেওয়া। কিন্তু গল্প পড়তে পড়তে, এর বিস্তৃত পরিসর, মূল গল্পের সাথে শিথিল সম্পর্কযুক্ত বিবিধ ও বিচিত্র ঘটনার উপস্থাপন আর বয়াররীতি দেখে ‘অগ্নি-স্বাক্ষরা’ গল্পটি কি ছোটগল্পের শৈল্পিক পরিমিতিবোধ ঠিকমতো ধারণ করতে পেরেছে কিনা এমন প্রশ্নও উঠতে পারে।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র গুলনাহার। জমিদার কৃষ্ণকান্তের নায়েব মেসের আলীর স্ত্রী। পিতার গুরুতর অসুস্থতার খবরে মেহেরপুর থেকে বাঁশবাড়ীতে যাওয়ার পথে বিশ^স্ত গাড়োয়ন নাজীব লোচনের আন্তরিকতায় নীলকুঠির সাহেবের লোকজনদের লাঞ্ছনার হাত থেকে রেহাই পেলেও বাড়ি পৌঁছে পিতাকে সে আর জীবিত পায় না। ইংরেজ সাহেবের হুকুম মতো নীলচাষে রাজি না হওয়ায় কুঠির লাঠিয়ালরা গুলনাহারের পিতা সৈয়দ আক্কাসকে এমনই প্রহার করে যে, কয়েকদিনের ভেতরে তার মৃত্যু হয়।
পিতার এই করুণ মৃত্যুই গুলনাহারকে আমূল পাল্টে দেয়। সে কেবল ইংরেজদের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহী হয় না, এই পাশবিকতার প্রতিশোধ না নিয়ে স্বামীর বাড়িতে না ফেরার মতো ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞা করে বসে। প্রতিশোধ পরিকল্পনায় সঙ্গে পায় বাল্যবন্ধু হায়দারকে।
হায়দারের ওস্তাদ বিখ্যাত সংগ্রামী তিতুমীরেরও পরোক্ষ পরামর্শ আসে তার কাছে। সঙ্গে নিতে সমর্থ হয় গ্রামের সাধারণ নারী-পুরুষকেও। এদিকে মেসের আলীর অর্থ ও ক্ষমতার লোভের সুযোগ নিয়ে জমিদার কৃষ্ণকান্তও গুলবাহারকে নিয়ে ফূর্তি করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। তারা দুজনেই গুলনাহারকে সাহায্য করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাতের অন্ধকারে নিরীহ জনতার ওপর লেলিয়ে দেয় সশস্ত্র ইংরেজ বাহিনীকে। অসংখ্য গ্রাম জনতার সঙ্গে গুলনাহারের সবচাইতে বিশ্বস্ত বন্ধু, যাকে সে একসময় ভালোবাসত, সেই হায়দার নিহত হয়। ধৃত গুলনাহারকে কৃষ্ণকান্তের লোলুপ আক্রমণের শিকার হওয়া গুলনাহার নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে সেই আগুনেই পুড়িয়ে মারে কৃষ্ণকান্তকেও। বাংলার কৃষকবিদ্রোহের এক অগ্নি-স্বাক্ষর বহন করে বলেই গুলনাহারের এই আগুনঝরা সংগ্রামকে ‘অগ্নি-স্বাক্ষর’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন গল্পকার।
এমন একটা প্রতিশোধের আগুনে শেষ হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি হয়তো লাগে, কিন্তু ছোটগল্প না কি কোনো ক্ষুদ্র উপন্যাস পড়েছি, এমন অস্বস্তিও সুপ্ত থাকে না। পরিধি দীর্ঘ; এটা মেনে নিলেও ঘটনা-অনুঘটনার বৈচিত্র্য, অপ্রাসঙ্গিক বা অনিবার্য নয় এমন ঘটনার বর্ণনা, এবং বর্ণনারীতির পরিমিতিবোধের অভাব কিছুটা পীড়িত করে বৈকি। তবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনায় রিজিয়া রহমানের কুশলতার পরিচয় নজর কাড়ে। যেমন :
গ্রাম ছাড়িয়ে ক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে জমিদারের পালকী চলছে। পালকীর দরজা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেলে রেখেছেন কৃষ্ণকান্ত রায়। হলুদ বৃন্ত চৈতী শস্যেও প্রান্তরে রৌদ্রোজ্জ্বল অপরাহ্ণ সুরাপাত্রের মত গাড় নেশার রঙ ছড়িয়েছে।
গল্পের আরও একাধিক স্থানে লেখকের ভাষায় বাংলার প্রকৃতি শব্দমূর্তি লাভ করেছে। তবু এ গল্পের ইতিহাস সচেতনতাই পাঠককে হয়তো অধিক আকৃষ্ট করে।
ব্রিটিশ বাংলায় কৃষিজীবী মানুষ পরাধীনতার নাগপাশে কীভাবে পর্যুদস্ত হতো, তাদের জীবনে কীভাবে পর্যুদস্ত হতো, তাদের জীবনে কীভাবে নেমে আসতো নীলকর সাহেবদের অত্যাচার; তার গল্পায়ন করতে গিয়ে নর-নারীর প্রেম, সংসার প্রভৃতি বাঙালি মুসলমানের সেসময়কার সাধারণ যাপিত জীবনও তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন রিজিয়া রহমান।