ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

এমন ঘনঘোর বরিষায়

আনোয়ারা সৈয়দ হক
🕐 ১২:২৩ অপরাহ্ণ, আগস্ট ০২, ২০১৯

শ্রাবণের অঝোর ধারায় আমরা হারিয়ে যাই। হারিয়ে যাওয়া শৈশব আমাদের ভেতরে ক্রন্দন করে ওঠে। এই বর্ষাবিধুর সন্ধ্যাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় একদিন আমাদের সব ছিল। মা-বাবা ভাইবোন স্বামী সন্তান, প্রাণের বন্ধুরা স-ব। অতীত হানা দেয় আমাদের স্মৃতির দরজায়। আজ আমাদের কেউ নেই। আমার মতো বয়সের মানুষদের কেউ নেই। তবু তার ভেতরেই শ্রাবণ তার বার্তা বয়ে আনে। অতীত বয়ে আনে। অতীতের সুখ স্মৃতির কথা বয়ে আনে। সেসব দিন, যখন বর্ষাবন্দি আমরা ঘরের ভেতরে বিছানায় পা তুলে বসে বা জানালার ধারে আসন নিয়ে তাকিয়ে দেখছি শ্রাবণের ধারা, আর আমাদের মা আমাদের জন্য তৈরি করছেন গরম ভুনা খিচুড়ি, ইলিশ মাছের মচমচে ভাজা, ডিম বা চিংড়ি মাছের দোপেয়াজা।

আর আমি জানালার ধারে বসে পড়ে চলেছি বিভূতিভূষণ বা প্রবোধ কুমার সান্যাল। তখন পৃথিবীটাকে মনে হতো হাতের মুঠোয় ধরা। মনে হত জগৎ সংসার বুঝি আমার পেছনেই ঘুরছে! আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে চাঁদও আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে।

মা আমার জন্য বিশেষ করে মিষ্টি জবদানা তৈরি করে রাখেন। মনে হয়, বুঝি আমার জন্যই বাড়ির সবচেয়ে বড় মাছের পেটিটি রাখা থাকে। কারণ আমি লেখাপড়ায় সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে সরেস!

শ্রাবণের গভীর রাতে আকাশ যখন ঝকঝকে পরিষ্কার আর মাথার ওপরে বিশাল এক চাঁদ, আমি ঘুম ভেঙে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। বাড়ির উঠোন চাঁদের আলোয় বেসুমারভাবে প্লাবিত, চারপাশ নিস্তব্ধ, আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি, আমার বয়স মাত্র এখন তের, আমি অনেক, অনেক দিন বাঁচব, অনেক অনেক কিছু চোখে দেখব, অনেক অনেক দেশ ঘুরব, আর আমি কোনো দিনও এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে যাব না! এই বর্ষার ঝরঝর, শ্রাবণের এই চাঁদ সারাটা জীবন আমি চোখ চেয়ে দেখব!

যে বাড়িটির ভেতরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি এই স্বপ্ন একদিন দেখেছিলাম, সেই বাড়িটি চোখের সামনে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, সেই বাবা-মা ভাই স্বামী বন্ধুরা পৃথিবীর ধুলায় মিশে গেছে, আমারও দিন শেষ, অধিকাংশ স্বপ্ন পূরণ না হলেও আমার দিন শেষ, কিন্তু আমার শ্রাবণ এখনো রয়ে গেছে।

শ্রাবণের মুষলধারা আজও অম্লান, সে এখন আমার স্মৃতি জাগানিয়া শ্রাবণ, তবু আমার প্রাণ তাকে ঝরতে দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়। মনে হয় মানুষের বেঁচে থাকাটাই একটা আনন্দ। বেঁচে থেকে পৃথিবীর পথে হেঁটে যাওয়াটাই আনন্দ। আমি চলে গেলেও আমার শ্রাবণ তার স্মৃতির ভেতরে, আমাদের এই বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সকল শ্রাবণ-কাতর, শ্রাবণের স্মৃতি-কাতর বাঙালিকে তার পক্ষপুটে ভরে রাখবে। আরও বেশি করে ধরে রাখবে আমাদের কবিগুরু শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।

শ্রাবণের অঝোর ধারার ভেতরেই আমরা থেকে যাব। আমরা বাঙালিরা আবহমান কাল ধরে বেঁচে থাকব। শ্রাবণের ঝরঝর প্লাবনের ভেতরেই আমরা বেঁচে থাকব। কারণ আমার মনে হয় শ্রাবণ আর বাঙালি একে অপরের সম্পূরক!

 
Electronic Paper