ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অপ্রকাশিত আত্মজীবনী

লাভ লোকসান

রমাপদ চৌধুরী
🕐 ১:০১ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৬, ২০১৯

মৃত্যুর আগে রমাপদ চৌধুরীর শেষ লেখা এটি। উনি ঠিক করেছিলেন, ছিয়ানব্বই বছর বয়সে এসে অকপটে আত্মজীবনী লিখবেন। তার সবচেয়ে কাছের মানুষ, কবি ও কথাসাহিত্যিক সিদ্ধার্থ সিংহকে তিনি প্রতিদিন তার কাহিনী বলে যেতেন আর সিদ্ধার্থ সিংহ সেটা লিখে নিতেন। অতিকষ্টে এইটুকু বলার পরই তাকে বেলভিউ নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হয়। আত্মজীবনীর এই অংশটির নামকরণ তিনি নিজে করে যান। শিমুল জাবালি

নব্বই বছর বয়সে সব কিছু ঠিকঠাক মনে পড়ে না। অথচ হঠাৎ হঠাৎ কত তুচ্ছ জিনিস, যা কোনো দিনই মনে পড়েনি, তা এই বয়সে এসে কেন যে হঠাৎ এক-একদিন নিজেকেই ভাবিয়ে তোলে বুঝতে পারি না। যেমন, হঠাৎ মনে পড়ে গেল, যখন খুব ছোট ছিলাম তখনকার দশ টাকার নোটগুলো এ কালের তুলনায় বেশ বড় ছিল। আর সেই দশ টাকার নোট যে কাগজে ছাপা হতো, সে কাগজগুলোও এ কালের তুলনায় ছিল বেশ টেকসই আর দামি। তাতে কী-ই এসে গেল। আসলে মনে পড়ল, অন্য একটি বিষয়। যদ্দুর মনে পড়ছে, প্রথম যে দশ টাকার নোটটা দেখেছিলাম, তখন পড়তে শিখেছি ইংরেজি অক্ষর। স্পষ্ট মনে আছে, বড় বড় করে লেখা ছিল গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যান্ড বার্মা। এখন ভাবছি, হঠাৎ এর মধ্যে আবার বার্মা ঢুকে গেল কী করে!

তখন কি দু’দেশেই ওই একই নোট চালু ছিল? স্মৃতি প্রবঞ্চনা করছে কি না তা একবার ঝালাই করে দেখে নিতে হবে। আসল ব্যাপারটা হলো, এই যে নিত্যদিন আমরা শুনি, বাঙালি কলকাতা ছেড়ে বাইরে যেতে চায় না। এখন লাখ লাখ বাঙালি ইউরোপ আমেরিকা থেকে জার্মানি কিংবা এ দিকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়া কোথায় না পাড়ি দিয়েছে! তার পরেও অনুযোগ শুনি, বাঙালি বাইরে যেতে চায় না। সবাই কলকাতায় থাকতে চায়।

সেটা যদি বা সত্যি হয়, তা হলেও অন্যায় নয়। এই যে মেকলে আমাদের জোর করে ইংরেজি শিখিয়ে সকলের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, এখন তো মনে হচ্ছে, তিনি আমাদের উপকারই করে গেছেন। অন্তত একটি ভাষার মৈত্রী বন্ধনে। সারা ভারতবর্ষকে তিনি অন্তত এমন একটি ভাষা দিয়ে গেছেন, শিক্ষিত ভারতবাসীরা যার মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ করতে পারে। এমনকি দুরূহ বিজ্ঞান চর্চায়, অর্থনীতিতে অথবা রাজনীতির ভাষাতেও। আমরা ওই মৈত্রীটুকুও অগ্রাহ্য করে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে যোগাযোগটুকুও নষ্ট করে ফেলছি। ইংল্যান্ড আমেরিকার কথা বাদ দিই। সেখানে তো নতুন প্রজন্মের যেসব শিশু জন্মাচ্ছে, তারা দু’দিন পরে দাদু-দিদিমার সঙ্গে দেখা হলে বাংলায় দু-চারটে কথা বলতে পারবে কি না আমার তো ঘোর সন্দেহ। কারণ, আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখছি, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, স্পষ্ট করেই বলি, মহারাষ্ট্র স্কুলে ভর্তি হয়ে আমার নাতনি যেটুকু বাংলা জানত, লিখতে এবং পড়তে, তাও ভুলে গেছে। টেলিফোনে কথাবার্তা বলতে গিয়েও, ফাঁকে-ফোকরে মারাঠি বেরিয়ে পড়ে। কারণ, চার-চারটি ভাষা তাকে রপ্ত করতে হয়। সঙ্গে গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদি ইত্যাদি। ইংরেজি হিন্দি (কেন জানি না ফরাসি) এবং অবশ্য অবশ্যই পাঠ্য মারাটি ভাষা। সে এক আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে তাকে দশটা বছর কাটাতে হয়েছে। যার ফলে অন্যান্য বিষয়ে সে যতখানি ভালো ফল করতে পারত, মারাঠির চাপে নিশ্চয়ই অন্য। বিষয়ে তত ভালো ফল হয়তো হয়নি। সব রাজ্যেই এখন এই একটা রোগ দেখা দিয়েছে। নিজের রাজ্যের ভাষাটাকে জোর করে ঘাড়ে চাপিয়ে দাও। তা হলেই দেশাত্মবোধ জেগে উঠবে।

অথচ এ সবের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। যে যার নিজের মাতৃভাষায় পরীক্ষা দিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত! আমাদের কলকাতায় অ্যান্ট্রোপলজি একটা বিষয়। পড়ে খুবই কম ছাত্র। অবশ্য উচ্চমাধ্যমিকে। কিন্তু তাদের খাতা দেখার জন্য পরীক্ষকের অভাব হয় না। আর পড়ুয়াদেরও বই পেতে অসুবিধে হয় না। তা হলে সারা ভারতবর্ষে যে যার মাতৃভাষায় একটা পেপার পড়তে পেলে যদি তেমন কোনো অসুবিধে হয়, সরকার তো তার ব্যবস্থাও করতে পারেন অতি অনায়াসে। তার বদলে সারা মহারাষ্ট্রে এবং নিশ্চয়ই অন্যান্য বহু রাষ্ট্রে বাধ্যতামূলক ভাবে সে রাজ্যের ভাষা ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার কি প্রয়োজন হয়?

যারা কলকাতা ছেড়ে যেতে চায় না বলে অভিযোগ, তার মূলে কিন্তু এই বাংলা ভাষাকেই ছেড়ে যাওয়ার আতঙ্ক। এ সব কথা এখন থাক। আসল ব্যাপারটা শুরু করেছিলাম, বাঙালি বাইরে যেতে চায় না কেন? কে বলল, যেতে চায় না? একটু খবর নিলেই দেখতে পাবেন, ভারতবর্ষে রেলওয়ে আসার আগেও বহু বাঙালি কলকাতা শহর তো দূরের কথা, বিভিন্ন গ্রাম থেকে জীবনে উন্নতি করবার জন্য কিংবা স্রেফ জীবিকার জন্য সারা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে পড়েছিল। রেলওয়ে হয়নি তখনো। হাজার হাজার বাঙালি বার্মায় জীবিকার প্রয়োজনে চলে যেত স্রেফ গ্রাম থেকে। মনে রাখতে হবে, এরা ঠিক তেমন অর্থাভাবগ্রস্ত ছিলেন না। দিব্যি সচ্ছল পরিবারের সন্তান। শিক্ষিত হয়েছিলেন এবং জীবনে উন্নতি করার জন্য কেউ গিয়েছেন ডাক্তার হয়ে, কেউ উকিল হয়ে, কেউ ব্রিটিশ শাসকের অধিনস্থ’ উচ্চপর্যায়ের কর্মী হিসেবে। আবার আর একদল গিয়েছেন ব্যবসার লোভে।

শরৎচন্দ্রের উপন্যাস যারা পড়েছেন, তারা তো এই সব বার্মাগামীদের নানা দৃষ্টান্ত জানেনই। আমি নিজে জানি, তারও আগের প্রজন্মের কিছু বার্মাবাসীকে। যারা ব্যবসা করে বিরাট বড়লোক হয়ে দেশে ফিরে এসে কলকাতা শহরে বিশাল বিশাল বাড়ি হাঁকিয়েছিলেন।

এরা আদপে ছিলেন সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি। অনেকেই হয়তো জানেন না, বার্মার জঙ্গল একদা অর্থাৎ রেল স্থাপনের প্রথম পর্ব থেকে সারা ভারতকে বার্মাটিক নামে বিখ্যাত সেগুন কাঠ জুগিয়ে এসেছিল ভারতের রেল বিস্তারের সময় থেকে। সেগুলোর ওপর খোদাই করে সাল লেখা থাকত এবং দু-তিন বছর অন্তর সেগুলো নিলামে বিক্রি করে দিয়ে আবার নতুন ‘ঝবধংড়হবফ ঞবধশ’ (সিজিনড টিক) বসানো হতো। তার ফলে বাড়ির আসবাবপত্র থেকে সব কিছুই তৈরি হতো ওই সব কাঠে। শুধু বার্মাটিকের দৌলতেই ভারতবর্ষে কত যে অর্থাগম হতো, তার ইয়ত্তা নেই। তার চেয়েও বড় কথা, ওই কাঠের কারিগরও সেকালে যথেষ্ট পরিমাণে কাজ পেত। এবং উন্নত ধরনের যেসব নকশা বা কারুকার্য থাকত, তার কিছু কিছু হাস্যকর নিদর্শন আমরা আজও সিনেমায় দেখতে পাই। এর ফলে, সেকালে সারা ভারতেই কাঠের মিস্ত্রিরা বেশ দু’পয়সা রোজগার করতে পারতেন। এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকেও দেখেছি, তারা সারা দিন ওয়াগানশপে কাঠের কাজ করেও অবসর সময়টুকুতে বিভিন্ন বাবুদের বাড়ির ফার্নিচার সামান্য অর্থের বিনিময়ে কত যত্ন সহকারেই না করে দিত।

এই বার্মা ছেড়ে একদিন সকলকেই চলে আসতে হয়েছিল। সে তো বাধ্য হয়ে। অতএব বাঙালি বাইরে যেতে চায় না, এই অপবাদটা সত্যি নয়। একটা কথা ভেবে দেখলেই বোঝা যায়, ওড়িশায় তখন ভুবনেশ্বর রাজধানী হয়নি। কটকে কত বাঙালি থাকতেন। র‌্যাভেনশা কলেজটা তো সে সময় বলতে গেলে বাঙালিদের কলেজ। বিহারের যত্রতত্র যে কোনো চাকরিতে অজস্র বাঙালিকে দেখা যেত। সায়েন্সে এম এসসি পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া ছাত্র চলে গেলেন বিহারে। গিয়ে অভ্রখনি কিনে মাইকা কিং হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। পূর্ণিয়া, মজফ্ফরপুর, ভাগলপুর- এ তো বাঙালিদের জন্যই বিখ্যাত। নামিদের কথা বলছি যখন, তখন মনে রাখতে হবে, এই সব জায়গায় অনামি বাঙালির সংখ্যা কিন্তু নিতান্ত কম ছিল না। আসামে তো কথাই নেই। প্রচুর বাঙালি এখনো আছেন। এবং এরা যেসব সাহেব-সুবোদের তল্পিবাহক হয়ে। গিয়েছিলেন, যখন কলকাতা রাজধানী ছিল, তখন। এই ধারণাটাও কিন্তু সম্পূর্ণ মিথ্যে। লক্ষ্মৌতে তো নিজে দেখে এসেছি, এক সময় আধখানা শহরের নামই ছিল বাঙালি টোলা। দিল্লির দিকে যাচ্ছি না ইচ্ছে করেই। এর পর যে কথাটি বলব, সেটা শুনে অবাক হতে হবে। ভারতবর্ষে ইংরেজরা তো বহু কাল ধরেই রাজত্ব করে যাচ্ছিল। শাসন-শোষণ যতই করে যাক, আর বাংলার রায়তদের নিয়ে আমাদের প্রাচীন ঐতিহাসিকরা এবং অর্থনীতিবিদরা যতই অশ্রু বিসর্জন করেন না কেন, আসল ব্যাপারটা কিন্তু কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। তা হলো, ভারতবর্ষের রেল পত্তন। এর চেয়ে বড় বিপ্লব ভারতবর্ষে আজও হয়নি। মেনে নিতেই হবে যে, যারা রেল লাইন নিয়ে এসেছিলেন, তারা সবাই ব্রিটিশ পুঁজিপতি, শোষণ করার জন্যই এসেছিলেন। কিন্তু নিজেরাও কি জানতেন যে, তলে তলে একটা বিরাট বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে।

সারা ভারতবর্ষজুড়ে একে একে রেল লাইন পাতা হলো। তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় কারখানা স্থাপিত হলো। যেসব গ্রামে লোকে চাষবাস করত, হঠাৎ একদিন দেখা গেল, ক্রমে ক্রমে সেখানে বহু রেল শহর জেগে উঠল। গ্রামের চাষি। হাতের কাছে হাট-বাজার পেল, এটা কোনো বড় কথা নয়, আসলে শিক্ষিত ভারতবাসী, যার মধ্যে তখন বাঙালিদেরই সংখ্যাধিক্য, তারা ভারতবর্ষজুড়ে নানা ধাপের নানা ধাঁচের চাকরি পেয়ে বর্তে গেল। আর তাদের ছোঁয়া পেয়ে বাঙালিদের মধ্যে, অবশ্যই অন্যান্য প্রদেশেও উচ্চশিক্ষার একটা হাওয়া সমন্ত দেশটাকেই বদলে দিল।

বেশ বড় বড় রেল শহর গড়ে উঠল বহু জায়গায়। তার একটি হলো, কলকাতা থেকে মাত্র বাহাত্তর মাইল দূরে বিখ্যাত রেল শহর খড়গপুর। যার আশপাশে প্রচুর শিল্পকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। আই আই টি কলেজের মতো প্রথম প্রতিষ্ঠান এখানেই গড়ে উঠেছিল। যার উদ্বোধন করতে এসে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বিস্ময়ে অবিভূত হয়ে বলে উঠেছিলেন - দিস ইজ মিনি ইন্ডিয়া।

কথাটা মিথ্যে বলেননি। উনি তো বলেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতবর্ষের প্রথম আই আই টি কলেজ উদ্বোধন করতে এসে। আমি তো দেখেছি, তার অনেক কাল আগে, জন্মের পর থেকে। তখনই তো মনে হতো, যেন এমনটি আর কোথাও নেই। কী বিশাল কারখানা। জেলখানার চেয়েও উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা। সেই কারখানা দেখার যথচিত অনুমতি বাবার মাধ্যমে আদায় করে গাইডকে অনুসরণ করে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় বলতে হয়েছে, আজ থাক। আর নয়।

সেই কারখানায় কী না তৈরি হতো। প্রায় সবই। কিন্তু ওই যে প্রথমেই বলেছি, ব্রিটিশরা রেল পত্তন করেছিল শুধুই শোষণ করার জন্য। বিপ্লব আনার জন্য নয়। সেটুকুও বলে দিই, ইঞ্জিন থেকে শুরু করে রেল গাড়ির বগি, চাকা, এমনকি। রেল লাইন- সবই আসত বিদেশ থেকে। তা সত্ত্বেও ভারতবর্ষ যে কত বেশি লাভবান হয়েছিল, ওই বিদেশি পুঁজিপতিরা সে দিন বুঝতেই পারেনি।

একটা কথা এখানে আগেই বলে নিই, অনেকে হয়তো ভাববেন, এই রেলওয়েগুলো ইংরেজ সরকারের মালিকানায় ছিল। এগুলো ইংরেজ সরকারের সম্পত্তি। তা কিন্তু নয়। অনেকগুলো বড় বড় কোম্পানি এই রেলওয়েগুলোর মালিক ছিল এবং লাভের গুড় তারাই পেত। তাদের প্রত্যেকের নাম ছিল বিভিন্ন। কিন্তু বহু জয়েন্ট স্টেশনের মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ ছিল। দেনা-পাওয়ার হিসেবও হতো। আর এদের চালাত প্রত্যেক রেলওয়ের একটি করে রেলওয়ে বোর্ড। তারা বিদেশেই থাকত। কখনো সখনো নিজেদের মনোমত লোককে বা লোকদের সর্বোচ্চ পদে বসিয়ে পাঠিয়ে দিত। তারাই ছিল সর্বেসর্বা। শোষণ করতেই তো তারা এসেছিল। কিন্তু ফল হলো অন্য দিকে। শিল্পক্ষেত্রে যা সব সময় ঘটে। এখানেও তাই ঘটল। অতিরিক্ত শোষণের ফলে সব রেলওয়েতে একটি করে লেবার ইউনিয়ন গড়ে উঠল।

 
Electronic Paper