ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

পতঙ্গ বিষয়ে ১০০ নাম্বারের রচনা

জাহেদ সরওয়ার
🕐 ১২:৪০ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৬, ২০১৯

অফিসের মাসিক মিটিংয়ে এই একবারই ঝলসে উঠেছিল কেরানি আবদুল হাকিম। একেবারে অতর্কিতে, অন্যের কথা বলার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যেন এই তার জীবনে শেষ প্রতিবাদ, মৃত্যুর আগে যেন এই তার জীবনে শেষ চাওয়া।

আমি কিছু বলতে চাই বলে শুরু করেছিল সে ‘আজ সকালে চাল কিনেছি ৫৫ টাকা দিয়ে। আপনারা জানেন কি না জানি না। জানি না আপনারা কেউ বাজারে যান কি না। সয়াবিন তেলের দাম ১২০ টাকার ওপরে। এদেশে সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে, যাচ্ছে ক্রমশ। এদিকে দিনের পর দিন অফিসে কাজ বেড়ে যাচ্ছে। মাত্র চার হাজার টাকা বেতনে আর কারও চলে কিনা জানি না, আমার চলে না। তাই বেতনের ব্যাপারটা আমি চেয়ারম্যানকে ভেবে দেখতে বলি’।

এটুকুই তার কথা। কখনই জীবনে কোনো মিটিংয়ে দাঁড়িয়ে কোনো কথা বলেনি হাকিম। তার কথার শেষে গমগম করতে থাকে মিটিংরুম। প্রথমত, হাকিম অতি নিরীহ প্রকৃতির কেরানি। দ্বিতীয়ত, সবার মনের আসল কথাটা সেই বলেছে। তাই ব্যাপারটা একেবারে আনকোরা, বিসদৃশ হয়ে দাঁড়াল। চেয়ারম্যানের থুঁতনি দিয়ে ঘাম ঝরল।

চেয়ারম্যানরা হচ্ছে সম্রাট নীরুর মতো, কাজের পর কাজ চান। বেতন বাড়াতে বললে অপমানিত বোধ করেন। কারণ এদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কোটির ওপরে। তিন বেলা খাবার বিনিময়েও অনেকে কাজ করতে রাজি। এ অবস্থায় হাকিমের এ দাবি রীতিমতো অগ্নিকাণ্ডের মতো ব্যাপার। ব্যাপারটা শুধু হাকিমের ব্যক্তিগত হলে চেয়ারম্যানের কথা ছিল না। এটা যে পুরা অফিসের সবারই অঘোষিত দাবি। চেয়ারম্যানের কি একটা পুরস্কার নেওয়ার জন্য বিলেত যাওয়ার কথা। তিনি নাকি কারও সঙ্গে কথাবার্তা কইছেন না।

এর ঠিক দুদিন পর আব্দুল হাকিমকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়। বলা হয় যেন সে নিজ থেকেই পদত্যাগ পত্র দিয়ে যায়। হাকিম হঠাৎ করে ইন্তেকাল করে যেন আবার বেঁচে ওঠে। অন্ধকার কবরের ভেতর শুয়ে থাকা একটা শেয়ালের মতো মনে হতে থাকে তার নিজেকে। দিলে তার মুহুর্মুহু মোচড় দিতে থাকে। অফিসে তার অন্য সহকর্মীরা যারা তাকে প্ররোচিত করেছিল, বলেছিল তোমার কিচ্ছু হলে লগে আছি। ওরা আর তার লগে কথা কয় না। সে অফিসের এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে ইঁদুরের বাচ্চার মতো। একবার ব্যবস্থাপকের ঘরে উঁকি মারে। ব্যবস্থাপকের রক্তচক্ষু তার বুকে ছেল মারে। সব সম্ভাবনা শেষে যখন সে দেখতে পায় মুহূর্তের মধ্যে এ অফিস তার অচেনা কোনো স্থানে পরিণত হলো। যেন সে সম্পূর্ণ অচেনা কোনো জায়গায় এসেছে। তখন তার বউ আর সদ্যপ্রসূত বাচ্চাটার কথা মনে পড়ল সাই করে। ইতোমধ্যে বউয়ের কাছে তুলেছিল সে কথাটা। আঁতকে উঠলেও হাসনাহেনা ব্যাপারটা যে এত গুরুতর আকার নেবে ভাবতেও পারে নাই। হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেয় হাকিম। এ অফিস তার কাছে লাশঘরের মতো। একটা ভয়াবহ মানসিক অবস্থার মধ্যে সে পদত্যাগ পত্র দস্তখত করে পিওনকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয় চেয়ারম্যানের ঘরে। নিজেকে একেবারে মুক্ত মানুষ মনে হয় তার। যেন এতদিন ধরে তার হাতে পায়ে দাসত্বের শৃঙ্খল বাঁধা ছিল।

কিন্তু একটু পরেই বাসার পাশে মুদি দোকানদার আর শিশুটার দৈনিক ওষুধ পথ্য আর দুধ-টুদের কথা মনে পড়তেই তার মনে হলো আসলে সে পা দিয়ে হাঁটে না হাঁটু দিয়ে হাঁটে। বাসায় ফেরার পর হাসনাহেনা কথাটা শোনার পর পাগলের মতো আচরণ করে।

‘দেশের এমন একটা সময়ে তুমি চাকরি ছাইরা দিলা’ আর মা-বাপ তুলে অফিস চেয়ারম্যান টেন সবাইকে গালাগালি করে। তারপর এক্কেবারে চুপ মেরে যায়। বাচ্চাটা ট্যা ট্যা করতে থাকে বিরামহীন।

পরদিন অফিসে গিয়ে চলতি মাসের ১৫ দিনের মানে আধামাসের বেতন তুলে আনে।

ঐ কয়টা টাকা দিয়া কয়দিন যাইব’ হাসনাহেনা বলে। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়া তার একটা আছাড় মারতে ইচ্ছা করে। পুরা জীবনটা অন্য কোথাও শুরু করার অবাস্তব স্বপ্ন জাগে তার। কাল থেইকা আমি নতুন চাকরির জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু কইরা দিমু- হাকিম আশ্বস্ত করে। সংসারের প্রতি মোটেই উদাসীন নয় হাকিম। পরদিন থেকে সত্যায়িত কাগজপত্রের ফটোকপি নিয়ে পছন্দের কয়েকটা অফিসে, কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের কাছে হানা দেয় হাকিম।

খুব দ্রুত জমানো টাকা শেষ হয়ে আসে। শেষে হাকিমের হাতে বাসা ভাড়াটাও থাকে না। না খেয়ে আধাপেট খেয়ে হাসনাহেনা আরো ১৩ দিন সহ্য করে শেষে শিশুর কান্না সইতে না পেরে বলে ‘আমি গেলাম’।

কই যাও- হাকিম জিগায়। দোযখে- হাসনাহেনা বেরিয়ে যায়।

হাকিম কিছুই বলে না। সে জানে হাসনাহেনা তার মার কাছে চলে গেছে। ওরাও তেমন সুবিধেয় নেই সে জানে। যেমন তেমন অবস্থা। হাসনাহেনা চলে গেছে দুই দিন।
গত এক দিন ধরে সে প্রায় কিছুই খায়নি। পাশের মুদি দোকান থেকে আলু কিনতে গিয়েছিল বাকিতে। কিন্তু চাকরি চলে যাওয়ার খবর বুলেটের চাইতেও গতিশীল। দোকানদার পষ্ট করে বলে দেয় সে দানছত্র খুলে বসে নাই।

আমাকেও এই দোকান কইরাই বউ-পোলার মুখে খাওন দিতে হয়, বলে দোকানদার। ঘরে ফিরে দেখে কাজের মেয়েটা কি যেন হাতড়াচ্ছে। তাকে দেখে বলে কিছুই তো নাই কি রান্ধুম?

হাকিম দেখে প্লাস্টিকের জারের মধ্যে সামান্য চাল অবশিষ্ট আছে। সেটা সে বার করে নেয়। দুইটা কাচা পিয়াজের খোসা ছড়ায়। চালটা মুঠোয় নিয়ে মুখে পুরে। এক কামড়ে পিয়াজের অর্ধেকটা মুখের মধ্যে ফেলে চিবোতে থাকে। তার অবস্থা দেখে বুয়া মুখে আঁচল চাপা দেয়। ইয়াছিন ছুরা পড়ে বুকে ফুঁ দেয়। ভয়ে সাবধানে দরজা খুলে চিরদিনের মতো পালিয়ে বাঁচে। মানুষের ক্ষুধা ভয়ঙ্কর সে জানে।

পরদিন সকালে প্রচ- ক্ষুধা ঘুম থেকে টেনে তোলে হাকিমকে। সে দেখে ঘরে আর কিছু অবশিষ্ট নাই। মুদি দোকানদারের কাছে গিয়ে কিছু লাভ হবে না সে জানে। পাশের দেয়ালে তার চোখ চলে যায়। একটা ক্ষুদ্র পোকাকে তাড়া করছে একটা টিকটিকি। শাদার ওপর আবছা লাল কেকের মতো মনে হলো তার টিকটিকিটার পিঠ। পাশে রাখা একটা ম্যাগাজিন তুলে সে ছুড়ে মারে টিকটিকিটার দিকে। লেজটা আগে খসে পড়ে বিছানার ওপর লিরলির করতে থাকে। আধ-মরা প্রাণিটা কাত হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। একটু ঘেন্না করে উঠল তার। দুহাতে জিনিসটা ধরল। কেমন যেন কেঁপে উঠল একটু। উল্টেপাল্টে দেখল। তারপর মুখের ভেতর ফেলে দিয়ে চোখনাক বন্ধ করে দিল এক কামড়। ঘ্যাঁচ করে একটা শব্দ হয়। একটা তরল পদার্থ মুখগহ্বরটা আটালো করে তোলে। ঢোক গিলে জিনিসটাকে সে ভেতরে পাঠিয়ে দিল। ক্ষুধাপেঠে খুব একটা খারাপ লাগল না তার। এরপর পর্যায়ক্রমে তেলাপোকা গিরগিটি চামচিকা ইঁদুর ইত্যাদি খুঁজে খুঁজে সে উদরপুর্তি করতে থাকে। কয়েকদিনের মধ্যেই তার বাসস্থান পোকামাকড়হীন এলাকায় পরিণত হয়। সপ্তাহ খানেকের মতো হবে সে দাঁড়ি কাটে নাই। যে দিন কোনো পোকামাকড় সে পেল না আর। সে দিন তার সম্মুখে একটা সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেল। স্বপ্নে স্বর্ণের ডেকসি পাওয়া লোকদের মতো টেবিলে কিল মেরে উঠে দাঁড়ায় সে। ইয়াহু! ইয়াহু! পেয়ে গেছি। সে ভাবতে লাগলো আমি তো পোকামাকড় খেয়ে থাকতে পারি। তাহলে আমার আর এ অসভ্য জগতে কাজ কি। জঙ্গলে চলে যাব, এখনি। সেখানে অনেক পোকামাকড়, অনেক। সে হবে শুধু আমার একার রাজ্য।

সেদিনই কেরানি আব্দুল হাকিম জঙ্গলের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে একটা বোস্কা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এরপর তাকে আর কেউ লোকালয়ে দেখে নাই।

 
Electronic Paper