ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জনপ্রিয়তার উচ্চ আসনে

তুহিন ওয়াদুদ
🕐 ২:৫২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৯, ২০১৯

মায়ূন আহমেদ বাংলা শিল্পসাহিত্যের আঙিনায় স্বতন্ত্র পরিচিতির বলয় নির্মাণ করেছেন। বহুধা মাত্রায় বিকশিত তার শিল্পকর্ম। বাংলা উপন্যাস-ছোটগল্প-নাটক-চলচ্চিত্রের ধারাকে তিনি অনেক ক্ষেত্রে নবতর রঙের স্পর্শে ফুটিয়ে তুলেছেন। মানুষ হিসেবে তিনি নিজস্ব রুচির একটি পথরেখা বিনির্মাণ করেছেন। এটাকে হুমায়ূনীয় ঢঙ বললেও অত্যুক্তি হয় না। মানুষের সরল ভাবনার এক নিটোল উপস্থাপন কৌশল তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। হুমায়ূন আহমেদের গদ্য অন্য যে কারও গদ্যের থেকে আলাদা। একজন বড় লেখক হিসেবে এ রকম অনবদ্য গদ্যের নির্মিতি সাফল্যের অনেক বড় সূচক।

হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। তারপর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্রমে ক্রমে তিনি উপন্যাসকার থেকে ছোটগল্পকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার হয়ে ওঠেন। এভাবে তার পরিধি বাড়তে থাকে শিল্পের আঙ্গিনায়। তার পরিচিতিও তাই ভিন্ন ভিন্ন মানদণ্ডে। তার শিল্পকর্মের ভুবন পড়া-দেখা-শোনা ত্রিধা স্রোতে বহমান। ‘কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ’ এই পরিচয় অন্য সব পরিচয়কে পেছনে ফেলেছে। 

তার অর্থ এমন নয় যে, তার অন্য শিল্পকর্মগুলো কম উজ্জ্বল কিংবা অনুজ্জ্বল। বরং তিনি যে কটি শাখায় সৃষ্টির কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন সবকটিতেই তিনি ঈর্ষণীয় পাঠকপ্রিয়তা-দর্শকপ্রিয়তা এবং শ্রোতাপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের সমকালে তার চেয়ে কেউ অধিক প্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি।

হুমায়ূন আহমেদের লেখনি শক্তি একই সঙ্গে সব শ্রেণির পাঠককেই আকৃষ্ট করতে সক্ষম। তার লেখার সৌন্দর্য হচ্ছে তার লেখার অন্তর্নিহিত গতি। একজন পাঠক অবসর সময়ে বসেও তার বই একটানা পড়ে শেষ করতে পারেন। আবার একজন রোগী হাসপাতালে বসে বসে তার বই পাঠ করতে পারেন। ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও ক্লান্তিবিহীন তার বই পড়ে শেষ করা সম্ভব। তার গদ্যশৈলীই মূলত তাকে পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেছে। বিষয়বৈচিত্র্য তাকে ততখানি বিশেষ মর্যাদায় উন্নীত করেনি যতখানি করেছে শিল্পগুণ।

হুমায়ূন আহমেদ যা লিখেছেন তাতেই পাঠকের আগ্রহ ছিল। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকে ছাড়িয়ে গেছে তার নাটক-চলচ্চিত্রের দর্শকিপ্রিয়তা। নিজের লেখা-নির্দেশনার চলচ্চিত্র সম্পর্কে তিনি বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন ‘আমার নিজের আনন্দের জন্য সিনেমা বানিয়েছি। যদি কারও ভালো লাগে তা আমার জন্য অতিরিক্ত পাওয়া।’ বাংলাদেশে এমন একটি সময় গেছে সারা দেশের মানুষ হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখার জন্য দিন-ঘণ্টা-মিনিট হিসাব করেছে। দেশে যখন বিদ্যুৎ সর্বত্র ছড়িয়ে যায়নি, যখন সবার ঘরে ঘরে টেলিভিশন হয়নি এমন সময়েও হুমায়ূন আহমেদ নামটি ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় নাম। একটি গ্রামে হয়তো একটি টেলিভিশন আছে ব্যাটারিচালিত সেই টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখার জন্য সমস্ত গ্রামের মানুষ এসে ওই বাড়িতে ভিড় করতেন। তারপর সম্পূর্ণ সপ্তাহ ধরে চলত সেই নাটকের আলোচনা। এখনো হুমায়ূন আহমেদের নাটকের সংলাপ-চরিত্র মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় ধারার প্রধানতম লেখক হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে বলা হয়, শরৎ-সাহিত্য বিক্রি হতো অনেক পরিমাণে। তার একেকটি শব্দ কত টাকায় বিক্রি হচ্ছে তা বের করা যেত। অর্থাৎ বিক্রি এত বেশি ছিল যে শব্দ দিয়ে টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল। কাজী নজরুল ইসলামেরও জনপ্রিয়তা ছিল। তার লেখা পড়ার জন্য এক শ্রেণির পাঠক অপেক্ষা করে থাকতেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের মতো আর কেউ নন। আমাদের দেশে শুধু লেখাকেই পেশা হিসেবে নির্বাচন করার মতো অবস্থা আসেনি। সব লেখককেই কোনো কোনো জীবিকার উৎস বজায় রেখেই লিখতে হয়। হুমায়ূন আহমেদ লেখাকেই জীবনের পেশা বানিয়েছিলেন। তার জীবনের দিকে তাকালেই বোঝা যায় তিনি সারা জীবনের সবটুকু সময় বিনিয়োগ করেছেন শিল্প-সাহিত্যের জন্য। আমরা বলতে পারি হুমায়ূন আহমেদের ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা ছিল শিল্প-সাহিত্য। লেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনাও ছেড়েছেন। তবে তিনি যেসব কিছু ছেড়ে শিল্পসাহিত্যেই থেকেছেন তা বৃথা যায়নি।

হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় ধারার লেখক বলে যে তিনি সিরিয়াস ধারার কিছুই লেখেননি তা নয়। তার লেখার মধ্যে ইতিহাস-সমাজ সবকিছুই বিধৃত হয়েছে। মধ্যবিত্তের জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তিনি পৌঁছেছিলেন। তিনি যেন মধ্যবিত্তের সংকট পাঠ করতে পারতেন। ফলে তার লেখায় সেসব উঠে এসেছে অত্যন্ত সাবলিলভাবেই। হুমায়ূন আহমেদের কাছে এক শ্রেণির পাঠকের দাবি ছিল তিনি আরও এমন কিছু লিখুন যা বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবে। তিনি হয়তো লিখতে পারতেন যদি তার জীবনাবসান না হতো। এ কথা তো ঠিক হুমায়ূন আহমেদের গদ্য অত্যন্ত সরল এবং ঝরঝরে। সেই ব্যঞ্জনাই পাঠক চিত্ত জয় করেছে। তার কালজয়ী রচনা শঙ্খনীল কারাগার, নন্দিত নরকে।

হুমায়ূন আহমেদের স্বতন্ত্র শক্তি তার গদ্যরীতি। ঝরঝরে এক গদ্য আর অনুপম শব্দ বিন্যাসে তিনি তার শিল্পভুবন গড়ে তুলেছেন। তার নির্মেদ গদ্য সতত সুখপাঠ্য। সাহিত্য রচনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাহিত্যে তিনি গদ্য রচনায় পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গদ্য যে পর্যায়ের, সেখানে সাধারণ পাঠক অনেকটাই বাধাগ্রস্ত। কমলকুমার মজুমদারের গদ্য তো রীতিমতো নিরীক্ষাধর্মিতার শীর্ষে। শহীদুল জহিরের গদ্যের ধরনও সর্বসাধারণের বোধগম্য নয়। বাংলা সাহিত্যে আমাদের উল্লেখযোগ্য লেখকদের গদ্যরীতি থেকে হুমায়ূন আহমেদের গদ্যরীতি একেবারেই আলাদা।

আমাদের যে পাঠক কমলকুমার মজুমদারের গদ্য পাঠে ক্লান্ত হন না, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গদ্যের গভীরে প্রবিষ্ট হন অনায়াসে, তিনিও হুমায়ূনীয় গদ্যে অবগাহন করতে পারেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের গদ্যে যিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তিনি অন্যান্য গদ্য পাঠে স্বচ্ছন্দ না-ও হতে পারেন। ফলে শিল্পবিচারে কমলকুমার মজুমদার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির যে দৃষ্টিকোণ থেকে অনন্য, সেখানে হয়তো হুমায়ূন আহমেদ অন্য দৃষ্টিতে অনন্য।

 
Electronic Paper