ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

হুমায়ূন আহমেদের বিলেতবাড়ি

মিলটন রহমান
🕐 ২:৪৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৯, ২০১৯

আমি লন্ডনে অনাবাসী হয়ে আছি ২০০৬ সাল থেকে। এর মধ্যে আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ কখনো লন্ডনে এসেছিলেন বলে মনে পড়ে না। অথচ আমরা যারা বাংলা বইয়ের পাঠক বিলেতে বসবাস করছি, তাদের কোনো না কোনো আলোচনায় তিনি উপস্থাপিত হয়েছেন প্রসঙ্গক্রমেই। বিলেতে বসবাসরত বেশির ভাগ বাংলাদেশিই মধ্যবিত্ত। যাদের পাঠাভ্যাসের সূচনাই করেছে হুমায়ূন আহমেদের বই। ‘নন্দিত নরকে’ কিংবা ‘অন্ধকারের গান’ তার প্রথম ও দ্বিতীয় উপন্যাস। যা মধ্যবিত্ত পাঠকের মনে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিতে শুরু করে। শুধু এ দুটি উপন্যাসই নয়, ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘অয়োময়’, ‘বহুব্রীহি’, ‘এইসব দিনরাত্রি’ বা ‘হিমু’ কিংবা ‘মিসির আলী’ বইয়ের পাতা ছাড়াও পর্দায় দৃশ্যায়ন করেছে বাংলাদেশ, তার মধ্যবিত্ত নাগরিক এবং নানান টানাপড়েনের গল্প। এসব গল্প ভুলতে পারেনি বিলেতে বসবাসরত বাংলা পাঠকরা। তার প্রচণ্ড রকম ছাপ দেখলাম লন্ডনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে।

কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখেছিলাম পাঠকদের জন্য সংগৃহীত বইয়ের বড় একটি অংশ হুমায়ূন আহমেদের। প্রতি বছর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এখানে বৈশাখী লিটারেসার ফ্যাস্টিভাল আয়োজন করে। এ অনুষ্ঠানের বই ক্রেতাদের বেশির ভাগই হুমায়ূনভক্ত। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার প্রথম কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ ১৯৯৫ সালে। তখন আমরা শহর থেকে গিয়ে সীতাকুণ্ডে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বইপাঠ কর্মসূচি পরিচালনা করি। এর সমন্বয়কারী ছিলেন কথাসাহিত্যিক মনওয়ার সাগর। হঠাৎ জানলাম মনওয়ার ভাইয়ের একমাত্র সন্তান স্বপ্নিল থেলাসেমিয়ায় আক্রান্ত।

এ নিয়ে আমাদের সবার মন খারাপ। মনওয়ার ভাই ছেলের নাম দিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন সেবামূলক ‘স্বপ্নিল ফাউন্ডেশন’। এ প্রতিষ্ঠান সেবার আয়োজন করল হুমায়ূন আহমেদের দুই দিনব্যাপী বইমেলা। তখন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে টানা দুদিন থাকার সুযোগ হয়েছিল। ওনার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম। চট্টগ্রামের পূর্বকোণে ছাপা হয়েছিল। কথা বলতে গিয়ে বুঝেছিলাম, তিনি বইয়ের পাতায় যেভাবে সহজ এবং সোজা কথা বলেন, সাক্ষাৎকারও দিয়েছিলেন সরল স্বীকারোক্তি।

ফিরে আসি লন্ডনে। এ দেশে আসার পর স্থানীয় কাউন্সিল লাইব্রেরি ‘আইডিয়া স্টোর’-এ যাওয়া আসা করি। প্রথম দিন গিয়েই দেখি লাইব্রেরির একপাশে টানা লম্বা সেল্ফে সব বাংলা বই। যার বড় একটা অংশ দখল করে আছে হুমায়ূন আহমেদের পাঠকপ্রিয় সব উপন্যাস। যাওয়া-আসা করতে গিয়ে কিছুটা ভাব হলো আইডিয়া স্টোরের ম্যানেজারের সঙ্গে। তার সঙ্গে একবার বাংলা বই নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেন, পরবর্তীতে বই কেনার তালিকা তৈরির সময় আমার সঙ্গে কথা বলবেন। যথারীতি ফোন করেন। আমি এক এক করে বইয়ের নাম বলতে থাকি। হুমায়ূন আহমেদের নাম বলামাত্রই তিনি বললেন, এ লেখকের বই বেশি লাগবে।

হুমায়ূনের বই অনেক বেশি পড়ে লাইব্রেরি ব্যবহারকারীরা। প্রতিটি বইয়ের কয়েক কপি করে থাকা চাই। এ লাইব্রেরিতে প্রতি মাসে একটি পাঠচক্র হয়। তাতেও হুমায়ূনের বই প্রাধান্য পায়। মাঝে-মধ্যে যারা বই নিতে আসেন তাদের সঙ্গেও কথা হয়। বেশির ভাগ পাঠকই দেখা যায় অন্য বইয়ের সঙ্গে হুমায়ূন রচনাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন বেশি।
এ তো গেল লাইব্রেরির সদস্যদের হুমায়ূন পাঠের দৃশ্য। বাঙলি অধ্যুষিত ব্রিকলেনে কয়েকটি বইয়ের দোকান ছিল। তাতেও প্রদর্শনীতে সিংহ ভাগ বই ছিল হুমায়ূন আহমেদের। দোকানি বলেছিলেন হুমায়ূন দিয়েই তাদের বাণিজ্য টিকে আছে। এখানেই বলে রাখতে চাই আমাদের প্রকাশনা শিল্প শুধু দেশে নয়, বিশ্ববাজারে প্রসার লাভে হুমায়ূন আহমেদের ভূমিকা অসামান্য।

২০১২ সালের ১৪ ও ১৫ জুলাই লন্ডন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এক দশকপূর্তি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং পশ্চিমবঙ্গের ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার। আমি তখন বাংলা টিভিতে বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজে নিয়োজিত ছিলাম। সুযোগে সমরেশ মজুমদারের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের বড় একটি অংশজুড়ে তিনি হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর কথার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা এবং পাঠক তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান। এখানে সমরেশ মজুমদারের কথা থেকে কিছু অংশ কোনো পরিবর্তন ছাড়া উদ্ধৃত করতে চাই।

সমরেশ মজুমদার : হুমায়ূন আর আমি দীর্ঘ সময় একসাথে কাটানোর সুযোগ পেয়েছি। আমাদের মধ্যে অনেক আলাপ হয়েছে লেখালেখি নিয়ে। তো হুমায়ূন বিশেষ করে পাঠক তৈরির ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছে তা আমরা পারিনি। এর কারণ তার মেধা, গল্প ও চরিত্র নির্মাণের মুন্সিয়ানা। তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে একেবারে অবিকল উপস্থাপন করেছেন। তার তৈরি পাঠকেরা পরবর্তীতে আমাদের বই হাতে নিয়েছে। আর জনপ্রিয়তার কথা যদি বলি, জীবদ্দশায় শরৎচন্দ্র, নজরুল এত বেশি জনপ্রিয়তা পাননি। আমার জানামতে বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূনের মতো এত জনপ্রিয় কোনো লেখক হয়েছেন বলে আমার জানা নেই।

সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে যখন কথা হয় তখন আমি এবং উনি কেউ কি জানতাম আর মাত্র কয়েক দিন পরই নিশ্চিন্তপুরে ঘুমিয়ে পড়বেন আমাদের নন্দিত ঔপন্যাসিক?

২০১২ সালের ১৯ জুলাই আমি রিপোর্ট তৈরিতে ব্যস্ত। এমন সময় অনলাইনে চোখ রাখতেই চিৎকার করে উঠেছিলাম কিনা জানি না কিন্তু অনেকক্ষণ ছিলাম নিশ্চুপ।

ভাবলাম আজ সংবাদে বলতে হবে হুমায়ূন আহমেদ নেই! বারবার পত্রিকা দেখি। ভুল দেখি না তো। কয়েকদিন আগে আমেরিকার একটি অনলাইন পত্রিকায় দেখেছিলাম সড়ক দুর্ঘটনায় বোম্বে তারকা অমিতাভ বচ্চন নিহত হয়েছেন। খবরের সত্যতা যাচাই করতে কয়েক জায়গায় খোঁজ নিয়ে দেখলাম সংবাদটি সত্য নয়। হুমায়ূন আহমেদের সংবাদ শোনার পর কেবলই মনে হচ্ছিল, যদি কেউ বলে উঠত সংবাদ সত্যি নয়! কিন্তু না আমাকে কম্পিউটারের কি-বোর্ডে লিখতে হলো ‘নন্দিত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ ভক্তদের শোকে ভাসিয়ে চলে গেলেন অন্য পারে’। সমরেশ মজুমদার চলে গেছেন। আবু সায়ীদ স্যার আছেন। লন্ডনে নয় তিনি আমাদের অন্য একটি দলের সঙ্গে বেড়াতে গেছেন ব্রিস্টলে। ফোনে ধরলাম স্যারকে। বললাম স্যার হুমায়ূন আহমেদ তো নেই। সংবাদে আপনার একটা মন্তব্য দিতে চাই। তিনি বললেন, ‘দেখো হুমায়ূনের চলে যাওয়া আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমাদের পাঠক তৈরির ক্ষেত্রে তার অবদান কখনোই ম্লান হওয়ার নয়। তার কথাশিল্প পাঠকমহলে সমাদৃত হবে যুগের পর যুগ।’

প্রসঙ্গক্রমে একটু পেছনে ফিরে যেতে চাই। ২০০২ সালের মার্চে কলকাতায় গিয়েছিলাম যথারীতি ঘুরতে। তার মাত্র কয়েকদিন আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাটে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সমরমতি ট্রেনে। তখন দেশ পত্রিকায় কাজ করেন কথা সাহিত্যিক আবুল বাশার। আমার ইচ্ছে তার একটা সাক্ষাৎকার নেবো। ফোনে যোগাযোগ হলো। নিশ্চিন্তপুরে তাঁর বাড়িতে বসেই কথা হলো। তিনি সেবার সাহিত্যের বাইরে রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছিলেন আমার সঙ্গে। তখন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমি এবার কলকাতা বইমেলায় প্রবেশ করে অবাক হয়ে দেখি একটি স্টলের সামনে বই ক্রেতাদের দীর্ঘলাইন। এগিয়ে গিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখলাম কে এই লেখক, যার বই কিনতে দীর্ঘ লাইন? গিয়ে দেখি তোমাদের হুমায়ূন আহমেদ। আমি পশ্চিমবঙ্গের কোনো লেখকের বই কিনতে এভাবে পাঠকদের হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখিনি।’

এই হলো আমাদের হুমায়ূন আহমেদ। চলে গিয়েও তিনি আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখেছেন তাঁর প্রকাশিত অসংখ্য জনপ্রিয় গ্রন্থের সম্মুখে। বিলেতে যত বাড়িতে গিয়েছি, বুকসেল্ফে সবচেয়ে বেশি যে বই দেখেছি তা হুমায়ূন আহমেদের। এদেশে পাঠকদের হাত ধরে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই হুমায়ূন উপস্থিত থাকেন। বাস করেন প্রতিটি বাড়ির প্রতিটি পাঠকের মধ্যে।

 

 
Electronic Paper