ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

তুমি রবে নীরবে

আনিসুজ্জামান
🕐 ২:৪২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৯, ২০১৯

মায়ূন আহমেদকে শেষ বিদায় জানাতে শহীদ মিনারে যে অভূতপূর্ব জনসমাগম ঘটেছিল, তা থেকে বোঝা গেছে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তার স্থানটা কেমন ছিল। দূর ও নিকট থেকে এসেছিলেন নানা শ্রেণির, নানা বয়সের, নানা পেশার নরনারী। এদের অনেকেই হুমায়ূনের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না, অনেকে হয়তো তাকে দেখেনওনি কখনো। শুধু তার লেখার সঙ্গে, তার টেলিভিশন নাটকের সঙ্গে, তার নির্মিত চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে তারা এসেছিলেন আবহাওয়ার প্রতিকূলতা অগ্রাহ্য করে, এসেছিলেন অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে, এসেছিলেন নিকটাত্মীয়-বিয়োগের বেদনা বহন করে। বাংলাদেশের কোনো সাহিত্যিকের ভাগ্যে এমনটা হয়নি।

এরপর হুমায়ূন সম্পর্কে নতুন করে আর কী বলার আছে?

২৪ বছর বয়সী এক তরুণ বিজ্ঞানের ছাত্র প্রথম উপন্যাস লিখেই পাঠকসমাজে সাড়া জাগিয়ে ফেলল। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাবার অবকাশ বা প্রয়োজন হলো না। সে যা-ই লেখেন পাঠকরা তা সাগ্রহে লুফে নেয়। বইমেলায় লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে তারা তার বই কেনে, তাতে লেখকের স্বাক্ষর নিতে না পারলে দুঃখিত হয়। প্রকাশকরাও অমন অদৃশ্য সারিতে দাঁড়িয়ে থাকে তার পাণ্ডুলিপি পাওয়ার জন্য, বড় অঙ্কের আগাম টাকা দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হয়। হুমায়ূনের উপন্যাসের নাট্যরূপ ধারাবাহিকভাবে টেলিভিশনে প্রচারিত হলে বাড়িসুদ্ধ লোকজন সব কাজ ফেলে তা দেখতে থাকে। হুমায়ূন চলচ্চিত্র নির্মাণ করে, তা দেখতে শহর ভেঙে পড়ে। চলচ্চিত্র বা নাটকের জন্য হুমায়ূন গান লেখেন, তাতে সুর দেন, তা সমাদৃত হয়। মনের আনন্দে হুমায়ূন ছবি আঁকেন, তা নিয়ে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়।

হুমায়ূন লিখেছে দু’হাতে। তার গ্রন্থের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। তিনি লিখেছেন উপন্যাস ও ছোটগল্প, নাটক ও রম্যরচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ও শিশুতোষ রচনা।

প্রথম প্রথম সমালোচকরা তার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। তারপর তারা তার ত্রুটিসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। উপন্যাস নামধেয় হুমায়ূনের বেশিরভাগ রচনা আসলে বড়গল্প-উপন্যাস নয়। হুমায়ূন বেশি লেখে, তাতে তার লেখার মান পড়ে যায়। হুমায়ূন বড় বেশি জনপ্রিয়, তার মানে তার লেখায় গভীরতা নেই। হুমায়ূন কেবল গল্প বলে, দেশ ও সমাজের প্রতি তার কোনো অঙ্গীকার নেই।

নিজের রচনার শিল্পরূপ নিয়ে হুমায়ূন কখনো বলেছিল বলে আমার জানা নেই। তবে সে জানত যে, পৃথিবীর সর্বত্রই আগে শিল্প সৃষ্টি হয়েছে, পরে তার স্বরূপ ও লক্ষণ নির্ণীত হয়েছে। হুমায়ূনের অধিকাংশ রচনা হয়তো উপন্যাসিকা বলে গণ্য হবে জীবনের খণ্ডচিত্রই তারা তুলে ধরে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসও যে সে অনেক লিখেছে, তাও ভোলা যায় না।

যারা বলেন, জনপ্রিয়তা সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়, তারা ভুল বলেন না। তবে জনপ্রিয়তা লেখকের একটা অর্জন নিঃসন্দেহে। কারও রচনা গুণেমানে শ্রেষ্ঠ, কিন্তু পাঠক তা গ্রহণ করতে পারে না। আবার কারও রচনা মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে যায়। কোনো লেখকই কেবল নিজের জন্য লেখেন না, দশজনের কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে লেখেন । জনপ্রিয় হলে তার রচনা খেলো বলে গণ্য করতে হবে, এটা একটা কুসংস্কার মাত্র।

হুমায়ূন একবার বাংলা সাহিত্যের এক অধ্যাপককে একটা গল্প পড়তে দেন তার মতামত জানার জন্য। অধ্যাপক স্বীকার করেন, গল্পটা মন্দ নয়। তবে, তার মতে, এতে গভীরতা কম। পাণ্ডুলিপিটা পকেটে ভরতে ভরতে হুমায়ূন তাকে বলেছিলেন, ‘গল্পটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আমি চরিত্রের নাম পালটে কপি করে দিয়েছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় যখন গভীরতার অভাব, তখন আমার লেখা অগভীর হলে আমার দুঃখ নেই।’

হুমায়ূন কখনো দাবি করেননি, গল্প বলার অধিক তিনি কিছু করতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনকে যেমনভাবে তিনি দেখেছেন, তেমনিভাবে তাকে উপস্থিত করেছেন। দেখা যাবে, তিনি যা তুলে ধরেছেন তার লেখায়, তা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু তার দেখার ভঙ্গি, উপস্থাপনের ভঙ্গির মধ্যে এমন একটা বিশেষত্ব আছে যাতে এই চেনা জগৎ ও জানা কথার মধ্যে আমরা নতুনত্ব খুঁজে পাই, আনন্দ-বিষাদের দোলায় দুলতে থাকি। ভালো করে গল্প বলাই তো কথাসাহিত্যের প্রধানতম কাজ। টেলিভিশন নাটকে তার সৃষ্ট চরিত্রের শাস্তি যেন না হয়, তার জন্য বাংলাদেশের একাধিক জায়গায় মিছিল হয়েছে। বাস্তবতার বিভ্রম সৃষ্টির বড় দৃষ্টান্ত এর চেয়ে আর কী হতে পারে? আর সামাজিক অঙ্গীকার? আবার তার টেলিভিশন-নাটকের কথাই বলি। ধারাবাহিকের বিশেষ একটি পর্ব প্রচারিত হওয়ার পরের দিন সকালেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শুনি ছাত্রদের মুখে মুখে ‘তুই রাজাকার’ বাক্যটা সজোরে ঘুরে ফিরছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হুমায়ূনের লেখার মধ্যে যে-অসাধারণত্ব আছে বিশেষ করে, ১৯৭১-এর মতো অসাধারণ সংযত রচনায় এবং জোছনা ও জননীর গল্পের মতো পক্ষবিস্তারী উপন্যাসে তার গুণগ্রাহিতার পূর্ণ পরিচয় ভবিষ্যতে যে পাওয়া যাবে, তাতে আমার সন্দেহ নেই।

নন্দিত নরকে ও শঙ্খনীল কারাগার হুমায়ূনের প্রথম বই দুটি পাঠককে মুগ্ধ করেছিল মূলত সমকালীন সমাজের প্রতিফলন ও সমালোচনারূপেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার রচনার কথা বলা বাহুল্য। হুমায়ূন পাঠক সৃষ্টিতে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ইংরেজি মাধ্যমে পড়া ছেলেমেয়েরা বাংলা সাহিত্যে যাদের কোনো আগ্রহ নেই হুমায়ূনের বই পড়েই ভালো করে বাংলা শেখার উদ্যোগ নিচ্ছে। হুমায়ূনের কল্যাণে এ-দেশের প্রকাশনা শিল্প যেমন সহায়তা লাভ করেছে, তারও তুলনা বিরল।

 
Electronic Paper