ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

সোনার পুতলা

আয়েশা ফয়েজ
🕐 ২:৩৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৯, ২০১৯

কাজল, সবাই যাকে হুমায়ূন আহমেদ নামে জানে, আমার প্রথম সন্তান। আমার সোনার পুতলা। ওর জন্মের সময় আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। ডাক্তার পর্যন্ত ডাকতে হয়েছিল। অবশ্য ডাক্তার আসার আগেই ওর জন্ম হয়। সুস্থ-সুন্দর সন্তানের মুখ দেখে সব যন্ত্রণা মুহূর্তেই উবে গিয়েছিল। সবাই খুব খুশি। আমার বাবা ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান, আমিও আমার বাবার প্রথম মেয়ে, কাকতালীয়ভাবে আমার শ্বশুর ও স্বামীও ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান। সে কারণেই আমাদের প্রথম সন্তান যখন ভূমিষ্ঠ হয়, তখন আনন্দটা একটু বেশিই ছিল। ‘আমার ছেলেবেলা’ গ্রন্থের এক জায়গায় হুমায়ূন লিখেছে ‘নভেম্বর মাসের দুর্দান্ত শীত। গারো পাহাড় থেকে উড়ে আসছে অসম্ভব শীতল হাওয়া। মাটির মালসায় আগুন করে নানিজান সেক দিয়ে আমাকে গরম করার চেষ্টা করছেন। আশপাশের বৌ-ঝিরা একের পর এক আসছে, আমাকে দেখে মুগ্ধ গলায় বলছে ‘সোনার পুতলা’। এতক্ষণ যা লিখলাম সবই শোনা কথা। মা’র কাছ থেকে শোনা। কিন্তু আমার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। কারণ আমি ঘোর কৃষ্ণবর্ণের মানুষ।’

হুমায়ূন বিশ্বাস না করুক, কিন্তু ছেলেবেলায় ও আসলেই টুকটুকে ফর্সা ছিল। এতটাই ফর্সা ছিল যে ওর ফুফু-খালারা ওকে ‘সোনার পুতলা’ বলে ডাকত। কেন যে দিন দিন কালো হয়ে গেল ঠিক বুঝলাম না। এদিকে সবাই ছেলেসন্তান হওয়ায় অনেক বেশি খুশি হলেও আমার স্বামীর প্রত্যাশা ছিল কন্যাসন্তানের। উনি ধরেই নিয়েছিলেন যে আমাদের মেয়ে হবে। সে জন্য কন্যাসন্তানের জন্য জামাকাপড়ও কিনেছিলেন। হুমায়ূনের অনেক ছেলেদের পোশাক থাকলেও ওর বাবা ওকে মেয়েদের পোশাক পরাতে বেশি পছন্দ করতেন। মেয়েদের পোশাকে ওর ছেলেবেলার অনেক ছবিও ছিল।

আমি বই পড়তে ভীষণ পছন্দ করি। আমার স্বামীরও বই পড়ার প্রতি ঝোঁক রয়েছে শুনে আমার বাবা আমাকে রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি উপন্যাসটা কিনে দিয়েছিলেন বিয়ের আগে। আর আমি নৌকাডুবি উপন্যাস পড়েছি জেনে আমার স্বামী অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। মোট কথা, আমি অনেক আগে থেকেই বই পড়তে খুব ভালোবাসতাম। তো যখন হুমায়ূন উপন্যাস লেখা শুরু করল, তখন আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। ছেলের লেখা প্রতিটি বই-ই আমার অনেক প্রিয়। এমনকি যেসব বই সম্পর্কে অনেকে বলে যে বইটি ভালো হয়নি, সেসব বইও আমার অনেক ভালো লাগে। বই প্রকাশিত হলেই হুমায়ূন আমাকে তা পাঠিয়ে দিত। আমি ওকে একদিন বললাম, কী চিকন চিকন বই লিখিস! অল্প সময়েই শেষ হয়ে যায়। মোটা বই লিখতে পারিস না যাতে অনেকদিন ধরে পড়তে পারি? যেদিন সত্যি সত্যিই হুমায়ূন এ ধরনের বই লিখল, সেদিন আমি যে অনেক বেশি আনন্দিত হয়েছিলাম সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বলা যায়, বিমল মিত্রের সাহেব বিবি গোলাম, কড়ি দিয়ে কিনলাম, আসামি হাজির এসব বড় উপন্যাস পড়ে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, তার চেয়েও বেশি আনন্দ পেয়েছিলাম।

এবার হুমায়ূনের স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা বলি। ... হুমায়ূনের বাবা মানুষের বাড়িতে জায়গীর থেকে পড়ালেখা করেছিলেন। তো আমি ওকে বলেছিলাম, আল্লাহ তো তোকে অনেক কিছুই দিয়েছে। তোর বাবা অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা শিখেছে। তুই এই এলাকার ছেলেমেয়েদের কষ্ট দূর করার জন্য একটা স্কুল করে দে। এর পরই ও নেত্রকোনায় ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’ নামে বিদ্যালয়টি গড়ে তোলে।

হুমায়ূন দেশকে অনেক ভালোবাসত। বিদেশে যখন ছিল তখন তো দেশে ফেরার জন্য ছটফট করত। বিদেশে ও যখন পিএইচডি করতে যায় প্রায়ই বলত, আমি আর পড়ব না। যে দেশের মানুষ ঠিকমতো খেতে পায় না, সে দেশের মানুষের এত পড়ে কী হবে? তখন আমি অনেক বোঝাতাম। হুমায়ূন দেশকে ভালোবাসত, দেশের মানুষকে ভালোবাসত। দেশের মানুষও যে ওকে কত পছন্দ করে, কত ভালোবাসে এটা শহীদ মিনারেই দেখলাম। কিন্তু এ দৃশ্য আমি কখনোই দেখতে চাইনি। এরচেয়ে অনেক বেশি আনন্দের হতো আমার কবরের মাটি যদি আমার ছেলে দিয়ে যেতে পারত। সন্তানের লাশের সামনে বসে থাকার চেয়ে বড় কোনো কষ্ট একজন মায়ের হতে পারে না।

এখন হুমায়ূন নুহাশপল্লীর লিচুতলায় শুয়ে আছে। জন্মের পর কয়েক বছর ও আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। নানার বাড়িতে নানির কাছে মানুষ হয়েছে। কেননা আমি তখন অসুস্থ ছিলাম। সুস্থ হওয়ার পর যখন আমার বুকের মানিককে কাছে পেলাম, তখন ওকে জড়িয়ে ধরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম বাকি জীবন যেন আমার ছেলেকে তিনি সুখে রাখেন; শান্তিতে রাখেন। তা হয়নি। হুমায়ূন সুখ পায়নি; শান্তি পায়নি। তাই পরম করুণাময়ের কাছে আমার প্রার্থনা ইহলোকে ওকে শান্তি না দিলেও পরলোকে তুমি শান্তি দাও।

 
Electronic Paper