ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

হুমায়ূনহীন একটা জ্যোৎস্নারাত

ড. মনওয়ার সাগর
🕐 ২:৩০ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৯, ২০১৯

পড়ন্ত বিকাল, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বেরিয়েছি। চারদিকে হুমায়ূনহীন একটা পৃথিবী। ঘন, গভীর, ভেজা, উজ্জ্বল, সবুজ। মাঝে মাঝেই আকাশ ভরে যাচ্ছে মেঘে। পান্নাসবুজ পৃথিবীর ওপরে নেমে আসবে বুঝি ঝরঝরিয়ে বর্ষা। ধানের চারার সবুজ সমুদ্রে একটা হলুদ প্রজাপতি নাচতে নাচতে আড়ালে চলে গেল। পর মুহূর্তেই দেখা দিল আরেকটা ফুটি ফুটি ধূসর প্রজাপতি। মাঝে মাঝেই শ্লেটের মতো ঘন মেঘ সরে গিয়ে আকাশজুড়ে ভরে যাচ্ছে নরম তুলোর মতো রেশমশাদা ধবধবে মেঘ। তার ফাঁকে ফাঁকে সীমাহীন নীল নীল আকাশ। নরম ধারালো রুপালি ইস্পাতের মতো রোদে আবার ভরে উঠছে পৃথিবী। এই পৃথিবীতে হুমায়ূন নেই। না- দেখা একটা ছায়া জল-স্থল-সবুজের ওপর বিরাট একটা ছায়া ফেলে আছে। অন্য কোনো দিন এ রকম নয়।

সকালে স্বপ্নীল বলেছে, ‘পাপা, হুমায়ূন আহমেদ এর জন্মদিনে আকাশ ফকফকে হওয়ার কথা, এত মেঘ মেঘ লাগছে কেন।’ স্বপ্নীল আমার ছেলে, সে এখন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের এল এল বি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ও বড় হয়েছে হুমায়ূন পড়ে পড়ে, হুমায়ূনের কোলে লাফ ঝাঁপ দেওয়ার অনেক স্মৃতিও রয়েছে ওর। হুমায়ূনের স্মৃতি শেকড় হয়ে তাকেও আচ্ছন্ন করে নিয়েছে!

১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর। সীতাকু- উপজেলা চত্বরে হুমায়ূন এসেছে আমার ছেলের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘স্বপ্নীল চাইল্ড ফাউন্ডেশন’ এর উদ্বোধনে, সঙ্গে ছিল হুমায়ূনের বইমেলা। হুমায়ূন অতিথি হয়ে এসেছেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছেন হুমায়ূনের ছাত্র তৎকালীন ইউ এন ও (বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম লস্কর। সীতাকু-ের ইতিহাসে কোনো এক কথাসাহিত্যিককে নিয়ে সেটাই ছিল প্রথম বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদ হাসান (বর্তমানে যুগ্মসচিব) লেখক শাহনেওয়াজ বিপ্লব, লেখক মিল্টন রহমান, ছোট ভাই সাইফুর রহমান সাকিল। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদ হাসান, ডা. এখলাছ উদ্দিন, অধ্যক্ষ বেগম জরিনা আক্তার, অধ্যাপক সুনীল বন্ধু নাথ।

মেঘের মতো হালকা, ভরহীন এই মানুষটাই শঙ্খনীল কারাগারের সেই হুমায়ূন। সেই নন্দিত নরকের লেখক। দস্যু বনহুর, দস্যু বাহরাম, কুয়াশা, মাসুদ রানা, টেনিদা, ঘনাদা, পরশুরাম, শিব্রাম, রবীন্দ্রনাথ, মানিক, তারাশঙ্কর, বিমল মিত্র, শংকর, সুনীল, শ্যামল, ইকথিয়ান্ডর, চেখভ, টলস্টয়, ইস্পাত, গোর্কি, মোপাসাকে অদৃশ্য করে তিনি আমাদের একটা নতুন, অতিজীবিত, অতিচেনা অথচ চিরঅচেনা স্বপ্নের দুনিয়ায় নিয়ে এসেছেন। যেখানে স্বপ্নগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা যায়। যার গহিন জ্যোৎস্নায় অবগাহনের কাল কিছুতেই, কখনোই শেষ হবার নয়।

অনুষ্ঠান শেষে দুপুরে হুমায়ূন আহমেদ, ইউ এন ও, এসি ল্যান্ড এবং অন্যান্য অতিথিসহ আমার বাসায় লাঞ্চ করলাম সবাই, বিকালে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বের হলাম ইকোপার্কে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে, সন্ধ্যায় আবার ফিরে এলাম আমার বাসায়, আমার বাসায় বসে তিনি ক্লান্তিহীন অটোগ্রাফ দিতে লাগলেন। সমান যত্নে, সমান অক্ষরে তিনি প্রত্যেককে ফাউন্টেন পেনের কালিতে তার নিজের নামটি লিখে দিতে লাগলেন। আমি তার সিগারেট ধ্বংস করতে করতে তাকে দেখতে লাগলাম। তার শার্টে সীমাহীন সভ্যতা। তার চপ্পলে অশেষ মসৃণতা। তিনি বর্ষার চাঁদের মতো। সারাক্ষণ তার মস্তিষ্ক তার চতুষ্পার্শ্ব নিয়ে কল্পনার মায়াজাল বুনতে থাকে। তার চারপাশে ঝলমলে অদ্ভুত সব মায়াবী জ্যোৎস্নার মতো গল্প জন্ম নিতে থাকে। তার পাশে বসে থাকলে একটা অদ্ভুত তরঙ্গ টের পাওয়া যায়। তরঙ্গটা তার নিজস্ব। নিরন্তর, স্বচ্ছ, ইলেক্ট্রিসিটির মতো একটা ইনটেলিজেন্ট বিকিরণ। তিনি কি সেটা জানতেন? এরই মধ্যে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় খবর এসে গেল হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র চারটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। আর কী নিস্তার আছে? সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়লো আমার বাসায়, একের পর এক ইন্টারভিউ, এক পর্যায়ে হুমায়ূন আমাকে বলল ‘সাগর, আর পারছি না, আমাকে ওপরে নিয়ে চলো’, শেষ পর্যন্ত আমার ডুপ্লেক্স বাসার ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে হুমায়ূনকে ফার্স্ট ফ্লোরে নিয়ে গেলাম।

এরপর আর একবার রাতের দুইটা বাজে এসে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর (রোজার সময়) আমাকে ঘুম থেকে জাগালেন, সীতাকুণ্ড থেকে সমুদ্র বিলাস নাটকের চিত্রায়ণ করবেন, সঙ্গে এসেছিল একঝাঁক কলাকুশলী, এসেই বললেন সবাইকে চা খাওয়াও, সেই মধ্য রাতে বউকে (জেনী) দিয়ে সবার জন্য চা বানাতে হলো, সে যাত্রায় অভিনেতা মাহফুজ, মোজাম্মেল হক, আমিরুল ইসলাম, জিয়া হাসান, সেলিম চৌধুরী (শিল্পী), আনোয়ারা, দিলারা জামান, শান্তা ইসলাম, মুক্তি, জয়, শান্তা ইসলাম, তহুরা আলী (আওয়ামী লীগ এম পি, শাওনের মা), চিত্র গ্রাহক আওলাদ হোসেন, শাওনসহ অনেকেই এসেছিল, আসাদুজ্জামান নূর ও জাহিদ হাসান এসেছিল সকাল বেলায়, সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি ও জীবন (সহ-পরিচালক) বিভিন্ন স্পট পছন্দ করতে গেলাম, পুরো নাটকটির চিত্রায়ণ হয়েছিল সীতাকু- চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আর কুমিরা উপকূলীয় অঞ্চলে। রোজা রেখে সারাদিনের ঝক্কি ঝামেলাতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এভাবে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতিময় কাব্য রয়েছে, আমার সৌভাগ্য যে হুমায়ূন আহমেদের সেন্টমার্টিনের ‘সমুদ্র বিলাস’ এর সঙ্গে প্রথম থেকেই আমি সম্পৃক্ত ছিলাম। বাড়ি নির্মাণের সব ব্যয়ও আমার মাধ্যমে পরিশোধ হয়েছে, সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ ভাই ঢাকা থেকে সরাসরি আমার বাসায় আসতেন, আমার কাছেই ‘সমুদ্র বিলাস’ নির্মাণের খরচ রেখে যেতেন, আমি সে টাকা নূরুল হক সাহেবকে দিতাম, লেবার পেমেন্ট এবং যাবতীয় কেনা কাটা নূরুল হক সাহেব করতেন। তখন আমার পোস্টিং ছিল টেকনাফ। টেকনাফ উপজেলা পরিষদ আবাসিক এলাকায় সরকারি কোয়ার্টারে থাকতাম আমি। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সাহিত্য নিয়েও অনেক আড্ডা হয়েছে, কথাবার্তা হয়েছে, তার একটাই কথা ‘পাঠককে আনন্দ দেওয়ার জন্যই আমি সাহিত্য করি, আমি সাহিত্যের পণ্ডিত নই, কিন্তু ছেলে মেয়েদের বইমুখী করে ছাড়বো’। শেষ পর্যন্ত তিনি তাই করেছেন, পাঠক সৃষ্টি করেছেন, জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছেন।

আমি যেমন দেখেছি জোছনা রাতের হুমায়ূনকে, তেমনি দেখেছি শ্রাবণ মেঘের দিনের হুমায়ূনকে। সারা রাত কাটিয়েছি সেন্টমার্টিনের সমুদ্র পাড়ে, নোঙ্গর ফেলা নৌকায় দোল খেয়ে খেয়ে। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে সেন্টমার্টিন আমার ৩/৪ বার যাওয়া হয়েছে, একবার সেন্টমার্টিন গিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ইচ্ছা হলো নৌকায় জোছনা দেখে দেখে রাত কাটাবে, আমাকেও তার সঙ্গে রাখল, সে যাত্রায় কথাশিল্পী মোহিত কামালসহ আরও অনেকেই ছিল। মধ্য রাতে শুরু হলো দমকা হাওয়া, বড় বড় ঢেউ আমাদের নৌকা ডুবিয়ে দেওয়ার অবস্থা, আমি সমুদ্রপাড়ের মানুষ হিসেবে সাহস রাখার চেষ্টা করলাম, হুমায়ূন আহমেদকেও অবিচল দেখাচ্ছিল, কিন্তু নৌকায় আরও ২/৪ জন যারা ছিল তারা খুব ভীত হয়ে গেল, তখন মোবাইল ফোন ছিল না যে, আমাদের সহযাত্রী যারা সমুদ্রের পাড়ে অবস্থান করছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো। কিছুক্ষণ পর দেখলাম আমিন ভাই (কাস্টম অফিসার), নূরুল হক (স্থানীয় ব্যবসায়ী) আর একটা নৌকা নিয়ে এলেন (মাঝিসহ) আমাদের উদ্ধারের জন্য। আল্লাহর অশেষ রহমত আমরা আশঙ্কামুক্ত হয়েছি।

আরও একবার একটা মজার কাণ্ড হয়েছিল, হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বললেন- ‘সাগর চলো, আজ সমুদ্র পাড়ে আছরের নামাজ পড়বো, (যদিও এর আগে কখনো তাকে আমি নামাজ পড়তে দেখিনি) একটা জায়নামাজ নিয়ে আমি ও হুমায়ূন আহমেদ গেলাম টেকনাফ সমুদ্র সৈকতে, যেদিকটা জনশূন্য ছিল সেখানে হুমায়ূন আহমেদ আছরের নামাজের নিয়ত করলেন, সিজদা দিলেন, ঠিক তখনই প্রকা- একটা ঢেউ এসে হুমায়ূন আহমেদ আর আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। আমরা ভিজে আমসত্ত্ব হয়ে গেলাম। হুমায়ূন আহমেদের পুরো পরিবারের সঙ্গেই আমার অনেকবার ভ্রমণ হয়েছে, সমুদ্র পাড়ে হুমায়ূনের সঙ্গে নামাজ পড়া হয়েছে, সেজদারত অবস্থায় মাথার ওপর দিয়ে ঢেউ চলে গেছে, তার বাসায় অনেকবার আসা যাওয়া হয়েছে। শীলা, নূহাস অনেক ছোট ছিল, নূহাসকে অনেকবার কোলে নিয়েছি, আদর করেছি, আমাদের সে নূহাস এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। শাওনকে বিয়ে করার ঠিক কিছুদিন আগে হুমায়ূন আমার বাসায় এসেছিলেন, সেই যে শেষ দেখা হলো আর দেখা হয়নি, এরই মধ্যে একবার গিয়ে দেখলাম গুলতেকিন ভাবীকে খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল।

আর যাওয়া হয়নি কখনো, হুমায়ূনহীন সবকিছুই কেমন যেন পানসে লাগে। গতরাতও ক্যাম্পাসে অর্ধচন্দ্র জোছনায় হেঁটেছিলাম হুমায়ূনের সন্ধানে, কোথাও হুমায়ূন নেই, ইচ্ছে হয়েছিল সেই অন্ধকার গহ্বরে হুমায়ূনের জন্য একমুঠো জোছনা দিতে, জোছনার আলো হুমায়ূনের খুব পছন্দ ছিল, সে সৌন্দর্যে হুমায়ূন মুগ্ধ হতো। চাঁদের আলোতে জোয়ার আসে, সে আলোতে ভেসে যেতে চাইত তার মন। সেই আলোতে অবগাহন করাই ছিল তার স্বপ্নগাথা! কিন্তু কে জানতো, চাঁদ থাকে না অমাবস্যার গহন আঁধারে, বিপন্ন পথচলায়, প্রয়োজনে যখন দরকার পাশে। পঞ্চমীতে চাঁদ ডুবে থাকে আপন ব্যস্ততায়। বদলে যেতে থাকে তার নশ্বর আলোর তীব্রতা। হুমায়ূনের আলোটাও ঠিক তেমনি করে নিভে গেল। শ্রাবণ মেঘের দিনও তার খুব পছন্দ ছিল।

 
Electronic Paper