অন্তরঙ্গে কবি
আবিদ আজম
🕐 ১:১০ অপরাহ্ণ, জুলাই ১২, ২০১৯
আল মাহমুদের আশ্চর্য্য সংস্পর্শে-ছায়ায়-নিবিড় সান্নিধ্যে কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যের সোনালী দিনগুলো। দেড় দশকের অধিক সময় ধরে আল মাহমুদ আমাকে এতটা আশ্রয়-প্রশ্রয় ও আপন করে নিয়েছেন, যেন আমি তার আনন্দ-উচ্ছাস- অশ্রুক্ষরণ থেকে শুরু করে হৃদপিন্ডের ধুকপুকানীরও যেন সহযোগী হয়ে উঠেছিলাম। আল মাহমুদ হয়ে উঠেছিলেন আমার বেঁচে থাকা ও অস্তিত্বের অবলম্বন, আমিও ছিলাম অনেকটা তার ভাষায় ‘অন্ধের যষ্ঠি’, জীবন ও সাহিত্যের সহযোগী, সেই সঙ্গে তরুণ সতীর্থ। ফলে আমার দীর্ঘদিনের একান্ত প্রিয় বন্ধু-আত্মার পরম আত্মীয় এই কিংবদন্তী ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে আমার কেমন অনুভূত হচ্ছে, এ বেদনা-শোকের কোন অনুবাদ কিংবা ব্যাখ্যা হয় না। প্রসঙ্গ যখন আল মাহমুদ, হৃদয়টা বিছিয়ে দিলাম কষ্ট করে পড়ে নিন। শুনতে একটু অদ্ভূত লাগতে পারে, বছরের পর বছর ধরে আমার হৃদয় যেমন আল মাহমুদের সুরে গুঞ্জন করে উঠত, তেমনি আমার পকেট-হাত কিংবা সংগ্রহশালা ঝাড়া দিলে যেন ঝড়ে পড়ত আল মাহমুদের ঘ্রাণমাখা স্মারক, অলীক মুদ্রা কিংবা নিতান্তই তার অটোগ্রাফসহ বই নয়ত সদ্য সকালের শিশিরের মতো জলটলটম নতুন কবিতা।
আজ যখন কবিহীন পৃথিবীর ‘অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে জমে আছে শোকের লেগুন’ ঠিক তখন আত্মীয়-পরিজনের শোক-ব্যবচ্ছেদ ছাড়াও শূন্যতা আর হাহাকারে যেন ভরে উঠছে কিংবদন্তির কক্ষ, চিৎকার করে যেন কাঁদছে বাসার জড়বস্তু- খাঁট, আসবাবপত্র। চিরতরে নির্বাক হয়ে আছে আল মাহমুদের কবিতার খাতা। আচ্ছা, কবির প্রিয় চশমাটা, যা দিয়ে ধূসর হয়ে যাওয়া পৃথিবীটা দেখার চেষ্টা করতেন সেটিই বা কেমন আছে?
প্রেম, প্রকৃতি ও প্রার্থণার এই কবির শেষ দিকের অধিকাংশ রচনাই ছিলো মৃত্যুগন্ধী। কখনো স্বেচ্ছায় লিখতেন, কখনো আমাকে কৌশলের আশ্রয় নিতে হতো। ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প করতে হতো। নিজের কবিতার আবৃত্তি শুনে শিশুর মতো ঝরঝর করে কেঁদে উঠতেন। কবির কলম বন্ধ হয়ে যাবার পর আমার (আরো অনেকেই শ্রুতিলিখন করেছেন) হাতটাই যেন ছিল আল মাহমুদের সোনালী কলম। তিনি বলতেন আর আমি পরম আনন্দে হৃৎকলমের টানে লিখতাম।
অশিতিপর- প্রায়ান্ধ এই কবির সহলেখক হিসেবে এমন কত-শত কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, গদ্য ও স্মৃতিকথার জন্মসাক্ষী হতে হয়েছে আমাকে; পাশাপাশি কবি হৃদয়ের বেদনা-হাহাকার, আনন্দ আর দিনযাপনেরও প্রত্যক্ষদর্শী। কবিতা লেখার সময় নিস্পাপ অশ্রুলিপিতে ভরে উঠতে কবির চোখ। মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে ভালবাসাবাসির পাশপাশি মান-অভিমানও যে ছিল না, তা নয়। চিন্তার সমর্থক হলেও ছিলো বেশ কিছু ভাবনার সঙ্গে স্পষ্ট-অস্পষ্ট মতপার্থক্য যে ছিলো না, কেমনে বলি? প্রবল প্রেম-ভালবাসার পাশপাশি ঝগড়া, তর্ক ও কিছু মনোমালিন্য ছিলো কী? একবার এয়ারপোর্টে তাকে দেরীতে পৌঁছে দেয়ার ফলে ফ্লাইট মিস করায় ভয়াবহ বকেছিলেন আমাকে, বলেছেন, তুমি এখন আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও। আমি নিজেকে সামলে বললাম, তাহলে আপনি বাসায় যাবেন কার সাথে মাহমুদ ভাই! শুনে তিনি হেসে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়েছি। আরেকবার আমাকে দেয়া অঙ্গীকার ভঙ্গ করে একটি ‘বিতর্কিত পদক’ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন জীবনব্যাপী বারবার ‘ইমোশনাল ব্লাকমেইল’ হওয়া মাহমুদ ভাই। আমি সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিলে তিনিও শিশুর মত কেঁদে উঠে লজ্জিত হয়ে ভবিষ্যতে সতর্ক থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি পা ছুঁয়ে সালাম করেছি। ২০১৩ সালের দিকে একবার রাগ করে তার বাসায় তিনমাস না যাওয়ায় কবিবন্ধু আহমদ সাইফকে সঙ্গে নিয়ে আমার রামপুরা বাসায় তিনি হাজির হয়েছিলেন। আমার নিজের আঙুলের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাই মাঝে মধ্যে, কারণ এ আঙুল ছিল আল মাহমুদের শেষ সময়ের কলম। ফলে আমার সময়টাই কেটেছে আল মাহমুদময়। রবীন্দ্র, নজরুল,জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দকে আমরা দেখিনি, নিবীড়ভাবে দেখেছি আল মাহমুদকে-এই
পাওয়াটাকে আমি পরম পাওয়া হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। জানি না, আল মাহমুদের ব্যাপারে আমার আবেগ, পাগলামী অনেক বেশি কি-না। বলা যায়, আল মাহমুদ আমার হৃৎপিন্ডের অংশ।
শিক্ষা জীবনের প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে যাকে পাঠ করে আমাকে শিক্ষিত হতে হল, তার অমূল্য সাহিত্য ও বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন নিয়ে একজীবন কাজ করলে খুব বেশি কিছু হবে? আল মাহমুদ থেকে আমার আসলে মুক্তি নাই, মুক্তি পেতে চাইও না। আরো নিমজ্জিত হতে চাই। আমি একবার ফেসবুকে মজা করে লিখেছিলাম, ‘আওয়ামীলীগ, আল মাহমুদ ও আবিদ আজম—এই তিন ‘আ’ থেকে সহসা তোমার মুক্তি নাই আয়েশা আক্তার...’।
আল মাহমুদ আমার কাছে হাজার ফুলের সৌরভপূর্ণ এক গন্ধবণিক, যে ঘ্রাণ আমি জীবনব্যাপী নিতে চাই। নাহ, আর কুলুচ্ছে না; পারছি না কিছু লিখতে। কী সব এলোমেলো বকলাম কিছুই মনে ধরছে না। ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভূ...