ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ড্রামিতি

হামিম কামাল
🕐 ২:১১ অপরাহ্ণ, জুলাই ০৫, ২০১৯

পুরনো বাড়ির অন্ধকার খাবারঘরের কোণে একটা অদ্ভুত চালের ড্রাম ছিল। উচ্চতায় আমার বুক সমান প্রায়, প্রস্থে তিনগুণ। সেটা ভরে যখন চাল রাখা হতো, আমায় এক ভূতে পেয়ে বসত।

গোপনে ড্রামের ঢাকনা খুলে চালের ভেতর কনুই অব্দি হাত ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম।

একটা শীত শীত অনুভব আমার হাত হয়ে গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ত। এর বাইরে আরেকটা ঘটনা ঘটত। ধানের তুষ আর পাটের আঁশের ঘ্রাণ মেলানো একটা চেলে গন্ধ পেতাম। গন্ধটা আমার কী যে ভালো লাগত! তবে বেশিক্ষণ নিতে পারতাম না।

আমার নাকের হাড় ঠিক মাঝখানে বাঁকা বলে হয়তো অল্পেই আমার হাঁচি পেত। চালে হাত ডোবানো অবস্থায় চেষ্টা করতাম যেন আবার হেঁচে না ফেলি, কারণ মা শুনলেই গণ্ডগোল।

হাতটা যখন তুলে আনতাম, চালের মরা কোষে সাদা হয়ে আছে। ঠাণ্ডা অনুভবটা থাকত না বেশিক্ষণ। গুঁড়োগুলো ঝেড়ে ফেলতাম। ভ্যাপসা গরমে বাহু ঘেমে সেখানটা আঠা হয়ে উঠতে থাকলে ধুয়ে আসতাম। কী অর্থহীন আনন্দের দিন!

একদিন বাবা ছুরি মাছের শুঁটকি আনলেন ঠাটারিবাজার থেকে। বাজারটার নাম শুনলেই আমার মনে ভাসত একটা হতচ্ছাড়া জায়গা, সারাক্ষণ শুধু বাজ পড়ছে, আর সেখানে মানুষ সরু চাঁদিবিহীন ছাতা নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে বাজার করতে এসে লাচার হয়ে ফিরে চলে যাচ্ছে।

ছুরি শুঁটকিও ছিল আমার কাছে বিস্ময়ের আধার। একটা শুঁটকি আলাদা করে নিয়ে আমি জানলার পাশে চলে যেতাম। দেখতাম, তার চোয়ালে ভয়ানক দাঁতের সারি। দেখতাম ভাষাহীন চোখ।

যেন কোনো প্রাগৈতিহাসিক সামুদ্রিক দিনলিপি উঁকি দিয়ে যেত। কল্পনা করতাম, এভাবে একে শুঁটকি বানিয়ে ফেলার আগে সে একটা জীবন্ত মাছ, বাবাগো! কীভাবে না জানি তাড়া করত, আর কামড় বসাত। যখন জলের ওপরের স্তরে চলে আসত, ওর শরীরে হয়ত সূর্য চমকাত। কী ধারাল নাম! ছুরি মাছ!

প্রথম দিন শুঁটকিগুলো কোথায় রাখা যায় আমি ভাবনায় পড়লাম। ছোটবেলায় মাথার কাজটা নতুন বলেই হয়তো, সমাধান না মিললেও খাটাতে উদগ্রীব, তবে পাঠ্যবইয়ের ‘অনুশীলনী’ আর ‘এসো নিজে করি’ মেলানো ছাড়া আর সমস্ত কাজে।

আমি ছুরি শুঁটকির ঠিকানা আমার শোওয়ার খাটের নিচে হতে পারে বলে ঘোষণা করলাম। খাটের নিচটা ছিল আমার সব রহস্য জমানোর আধার। জানালা গলে আসা সৌর আলোর একটা অংশ প্রতি দুপুরে খাটের নিচে ছোট করে আসর বসাতো, যেন মহাজগতের অন্ধকারে হঠাৎ আলোকরেখা। যেন দারুণ কিছু মঞ্চায়িত হবে এখনই।
মা বললেন, তোমার খাটের নিচে থাকলে ওটা আর তুমি খেতে পারবে না।
তাহলে?
খাবে আরশোলা, ইঁদুর আর বেড়াল। বুঝলে?
আমি দেখলাম, দুশ্চিন্তার বিষয়। জায়গাটা তেলাপোকার চারণক্ষেত্র। আর সাদা একটা বেড়ালি সেখানে চারটা বাচ্চা ফুটিয়েছে, এখনো চোখ ফোটেনি। ভবিষ্যতে ওদের শিকার হবে বলে বেড়ালছানাগুলোর ওপর আগাম উৎপাত চালায় ধাড়ি ধাড়ি সব ইঁদুর। তাহলে উপায়?
মা বললেন, শুঁটকি চালের ড্রামে রাখা হবে।

রাখা হলো। পাটের সুতো দিয়ে বাঁধা ছুরি শুঁটকির একটা জোট। পরদিন দুপুরে ইশকুল ছুটির পর এসে আমি চালের ড্রামের ঢাকনাটা খুলতেই চেলে গন্ধের সঙ্গে শুঁটকির একটা সূক্ষ্ম আঁশটে গন্ধ পাওয়া গেল। এবং কী আশ্চর্য, গন্ধটা আমার ভালো লাগল।
আমি পরদিন আবার এসে সেই ঘ্রাণ নিলাম। ততদিনে দুটো ছুরি শুঁটকি খাওয়া হয়েছে।
পরদিন ড্রামের চালের ঠাণ্ডার ভেতর হাত ডুবিয়ে তোলার সময় ছুরির চোয়ালে দাঁতের বেশ ক’টা আমার আঙুলে ফুঁড়ে গেল, উহ!
খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে সেই নীরব দুপুরটায়। বিছানার ওপর উপুড় করা ‘হাতকাটা রবিন’। মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমার নায়ক তখন। আমি ধীরে ধীরে বইটার কাছে ফিরে এসেছিলাম।

এরপর আর যতদিন ছুরি শুঁটকি ছিল চালের ড্রামে, আমি আর হাত ডোবাইনি।
বাড়িটার পেছনের উঠোনে একটা হিমসাগর আমের গাছ ছিল আমার শৈশবের বন্ধু। ছোট্ট এক টুকরো উঠান, তারই এক কোণে জায়গা করে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছড়িয়ে আমাদের ছোট্ট বাড়িটাকে ছায়া দিয়ে রেখেছিল শেষ দিনটি পর্যন্ত। অনেক পাখির নিরাপদ আবাস ছিল গাছটা, আর ভ্রাম্যমাণ বেড়ালের চমৎকার ‘হাইডআউট’, কখনো রণক্ষেত্র।
বসন্তের শুরুতেই গাছটায় আমের বোল এসে চারপাশ সৌরভে মাতাল করে তুলত। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে যখন এলাকার বাকি গাছে হলুদের ছোঁয়া লেগেছে কি লাগেনি, আমাদের গাছের আম তখন পেকে চুনচুন করছে।
আমগুলো খাটের নিচে একটা থলে বিছিয়ে তার ওপর রাখা হতো।
অবাক হয়ে দেখতাম বোঁটার জায়গা থেকে বেরুনো কষের ফোঁটা ছোট ছোট মুক্তার বিন্দুর মতো জমে আছে। খুঁটে তুলে ফেলতে চাইতাম, উঠত না।
সে বছর গ্রীষ্মের শেষাশেষি এক দুপুরে হঠাৎ কাল বৈশাখী এলো। দরজা জানালা বন্ধ করে আমি আমার ঘরে বসে ছিলাম। বাতাসের সেকি তা-ব, ছাদের ওপর গাছটা বুঝি মাতাল হয়ে গেছে। বৃষ্টির তোড়ে বন্ধ জানালার সূক্ষ্ম ফাঁক গলে জল গড়িয়ে ঘরে চলে আসছে। প্রায় আধঘণ্টা হয়ে গেল, ঝড় বা বৃষ্টি কোনোটারই থামার কোনো নাম নেই।
মায়ের গলায় শঙ্কা। ‘হায় খোদা, আজকে তো আবার তাহলে...’
বাবা বলল, ‘কোনো অসুবিধা নেই।’
কিসের শঙ্কা করছিলেন তারা আমি একটু পরই বুঝতে পারলাম। বাড়ির পেছনে নর্দমা উপচে উঠোনে এসে রান্নাঘরের চৌকাঠটা ছোঁয় ছোঁয়। চৌকাঠটা পেরুতে পারলেই হলো, নর্দমার পানি গলগল করে ঘরে ঢুকতে শুরু করবে।
বাবা আর দেরি করল না। নর্দমার শেষ মাথায় সবলে ঘা মারতে লম্বা একটা বাঁশ নিয়ে বৃষ্টি মাথায় করেই উঠানে নেমে গেল। ঠিক সেই সময়ে বিজলি চমকাল।
মা বলল, ঘরের ভেতরে যদি পানি ঢুকে পড়ে? তুই তার আগেই একটা কাজ করত বাবা। আমগুলো নিয়ে চালের ড্রামে রাখ।
আমি ঝুঁকে তখনই খাটের নিচে তাকালাম। ষাট ওয়াটের বাল্বের অল্প খানিকটা আলোর টুকরাংশ আসছিল।
আমগুলো গুনলাম, দশটার মতো ছিল। সবকটা একবারে কোলে নিতে গেলে গোল বাঁধল। মা বলল, ‘ভাগ করে নে পাগল, তাড়া কেন!’
বাবা ফিরে এসে বলল, ‘ওহ, আর পারছি না। কী একটা আটকেছে, অনেকক্ষণ চেষ্টা করলাম।’
মা একটা গামছা দিয়ে তার মাথা মুছে দিতে দিতে বলল, ‘থাক, আর দরকার না। পানি ঢুকলে আমরা আছি। কিরে, রাখলি?’
আমি অর্ধেকটা আম তুলে নিয়েছি তখন। আমার বোন অঙ্কের টেবিল ছেড়ে কখন উঠে চালের ড্রামের ঢাকনা তুলে ধরল। ঝুঁকে পড়ে আমি টপাটপ আমগুলো সেখানে ফেললাম। আবার গিয়ে বাকিগুলো নিয়ে এলাম। ফেললাম। ঢাকনা দেওয়া হলো।
রাতে চুলায় ভাত চড়বে, মা আমাকে বলল একটা হাঁড়িতে দেড়পট চাল এনে দিতে। ব্যাস, আমার সুযোগ মিলে গেল। চালের পুকুরে হাত ডোবাব এবার। ঢাকনাটা যেই খুলেছি, হঠাৎ মন্ত্রমোহিতের মতো স্থির। একি কা-!
পাটের আঁশ তুষের মিলিত প্রিয় গন্ধের সঙ্গে রসালো আমের চিনিচাঁপা অদ্ভুত ঘ্রাণ মিলেমিশে অবাক করা এক সৌরভ তৈরি করেছে। আমি পা উঁচিয়ে চালের ড্রামের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।
সেই সুঘ্রাণ বুকের ভেতরে প্রবেশ করে আমাকে ধন্য করল। আমি চালের গভীরে ধীরে ধীরে হাত ডুবিয়ে দিলাম।

 
Electronic Paper