আমাদের প্রথম আধুনিক
আহমেদ মাওলা
🕐 ৩:০২ অপরাহ্ণ, জুন ২৮, ২০১৯
আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪) আমাদের বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রথম আধুনিক। ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার যে-ধারা উত্তরকালের কবিদের হাতে বিকশিত হয়েছিল, আবুল হোসেন ছিলেন সে-ধারার সফল উত্তরাধিকারী। জীবনদৃষ্টি ও কাব্যভাষা দিয়ে তিনি আমাদের যুক্ত করেছিলেন আধুনিকতার সঙ্গে। তার সমসাময়িক মুসলমান কবিরা হলেন আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, বেনজীর আহমদ, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, মহিউদ্দিন, হুমায়ুন কবির, কাজী কাদের নেওয়াজ, বন্দে আলী মিয়া প্রমুখ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের এই মুসলমান কবিরা, তারা সেই সময়ে খুব পরিচিত ছিলেন। কিন্তু আধুনিকতাটা তারা বুঝলেনই না।
তারা লিখলেন পুরনো ধাঁচের কবিতা। তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান ছিলেন কবি আবদুল কাদির। তার রুচি, রসবোধ ও পাণ্ডিত্য ছিল কিন্তু তিনিও হাঁটলেন পুরনো পথে। আধুনিকের পথে হাঁটলেন খুব স্বল্পসংখ্যক কবি। আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, গোলাম কুদ্দুস এবং আবুল হোসেন। তাদের মধ্যে আহসান হাবীবের রাত্রিশেষ (১৯৪৭), ফররুখ আহমদের সাতসাগরের মাঝি (১৯৪৪) এবং আবুল হোসেনের নববসন্ত প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র-সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধানতম মুখপত্র কবিতা পত্রিকায় গ্রন্থটির আলোচনা করেন নীহাররঞ্জন রায়, রূপায়ণে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, কৃষকে আবুল মনসুর আহমদ, সওগাতে গোলাম কুদ্দুস, চতুরঙ্গে শওকত ওসমান।
একই সময়ে প্রকাশিত সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের (১৯১৯-২০০৩) পদাতিকের (১৯৪০) প্রথম কবিতা ‘সকলের গানে’র পঙক্তি ‘কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?/ কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে’ এবং আবুল হোসেনের নববসন্ত গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘নবযুগে’র শেষ দুটি পঙক্তি ‘কান পেতে দ্বারে সারারাত জেগে রই/ আসে আসে সে যে শুয়ে শুয়ে শুনি।’ দুটি কবিতাতেই আসন্ন নতুন যুগের বার্তা ধ্বনিত হয়েছে। আবুল হোসেনের নববসন্তে স্পন্দিত হয়েছে মূলত বাঙালি মুসলমানের আধুনিক হয়ে ওঠার বার্তা। তিরিশের কবিদের প্রধান ছন্দ ছিল অক্ষরবৃত্ত আর আবুল হোসেনের নববসন্ত কাব্যগ্রন্থে স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং মুক্তক অক্ষরবৃত্তের অমিল, সমিলের কবিতা আমরা দেখতে পাই। আধুনিক বাংলা কবিতা বলতে যা বোঝায়, তার জন্মই হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে বিরোধিতা করে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতাকে এত মিষ্টি করে ফেলেছিলেন যেন, এটা খুব একটা পেলব জিনিস, শুধু গীতিময়তা। গীতিময়তা থেকে ভিন্ন দিকে নেওয়ার কাজটি করেছিলেন তিরিশের কবিরা সম্মিলিতভাবে।
কাব্যভাষার এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এলো গদ্যকবিতা। রবীন্দ্রনাথই প্রথম গদ্যকবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন, অবশ্য গদ্যকবিতায় তিনি একধরনের গল্প বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল, ছন্দমিলের যে-কবিতা, সেটাতে সবকিছু লেখা যায় না। গদ্যকবিতার মধ্যে একটা প্রাত্যহিকতা আছে, তার ঊর্ধ্বে নয়। এটা যে সঠিক নয়, তা উত্তরকালে সমর সেন প্রমাণ করেছেন। সমর সেনই সাহসিকতার সঙ্গে বাংলা কবিতাকে গৎবাঁধা নিয়মের মধ্য থেকে বের করে গদ্যকবিতার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। আবুল হোসেন আত্মমুক্তির পথ খুঁজে পেলেন সমর সেনের অনুসৃত পথেই। এক সাক্ষাৎকারে আবুল হোসেন বলেছেন ‘আমার মনে হলো, আমি কবিতা শিখবো সেই ভাষায়, যে ভাষায় মানুষ কথা বলছে হাটবাজারে, ড্রয়িংরুমে। যে কারণে আমি সমর সেনকে বড় কবি বলি, সেটা হচ্ছে গদ্যকবিতা, এই গদ্যকবিতায় যে ছন্দরস থাকতে পারে, সেটা এনেছেন সমর সেন। আমি সমর সেনের কাছে এটা শিখেছি।’ (কালের খেয়া, ১৫০ সংখ্যা, ২৯ আগস্ট, ২০০৮)। আবুল হোসেন প্রথম লিখলেন সমিল গদ্যকবিতা।/ আজকের দিনে রান্নাঘরের অন্ধকারের মাঝে/ যে মেয়েরা বসে চীনে বাসন মাজে/ মশলা পিষতে চোখ ভরে আসে জলে/ তাদেরো অন্ধ জীবনের তলে/ উঁকিঝুঁকি মারে রাজকুমার। পেঁয়াজ কাটার ফাঁকে/ মনের গহনে রবিঠাকুরের একটি লাইন হয়তো চিত্র আঁকে/ হয়তো কখনো মনে তোলে দোলা/ শেলির একটি কবিতা, আত্মভোলা/ কীটসের অমর ওডগুলো/ হয়তো পথের ধুলো / সংবাদ আনে রাজকুমারের আগমনের সুপ্ত মনের/ আড়াল দেওয়া পর্দাটা যায় ফেঁসে/ একটি নিমিষে।
(‘আমরা : বাংলার মেয়ে’, নববসন্ত)/ আবুল হোসেনের নববসন্ত গ্রন্থে শব্দে, ছন্দে, উপমায় তিনি অবিরলভাবে প্রয়োগ করেছেন সে-যুগের কঠিন সমাজবাস্তবতা। কবিতায় মানুষের মুখের ভাষার অনুবর্তী কত সাধারণ হওয়া যায়, তার দিকেই অগ্রসর হয়েছেন তিনি। এটাই হচ্ছে আবুল হোসেনের স্বোউপার্জিত আধুনিকতা।
মৃত্যুতে কবিরা অমর হন। কবি ও ব্যক্তি এ দুয়ে মিলে হয়ে ওঠে শিল্পী ও শিল্প। প্রায় ৯২ বছর বয়স পেয়েছিলেন আবুল হোসেন। মাত্র ২১ বছর বয়সে প্রথম কাব্যগ্রন্থ নববসন্ত প্রকাশের পর তিনি নতুনধারার কবি হিসেবে বোদ্ধা পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য। ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, হুমায়ুন কবির, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রমুখ কবি, লেখক, সমালোচকের সঙ্গে।
তার কর্মজীবনও ছিল বৈচিত্র্যময়, শেষে যুগ্ম সচিব থেকে অবসরে যান। কিন্তু যেখানে কাজ করেছেন, ছিলেন কবিতায় নিমগ্ন। প্রথম জীবনে প্রচুর লিখলেও পরে আবু সয়ীদ আইয়ুবের পরামর্শে লেখা কমিয়ে দিয়েছিলেন। তার স্বাতন্ত্র্য, সততা ও সমাজ-সচেতনতা এবং আধুনিক জীবনদৃষ্টি সমকালীন কবিকর্মীকে পথচলায় প্রেরণা জোগাবে নিশ্চয়। আবুল হোসেন মুসলমান বাঙালি কবিদের মধ্যে প্রথম আধুনিক কবি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।