মধুভোর
নাজমীন মর্তুজা
🕐 ৩:১৪ অপরাহ্ণ, জুন ২১, ২০১৯
পাক্কা আঠারো ঘণ্টা জার্নির পর এই শহরে নামলাম। এটা আমার গন্তব্য নয় কিন্তু মাঝপথে স্পেন্ডরের ট্রেনটা কেমন বেঁকে বসলো।
পায়ের আংটি নূপুর সব কেমন আঁটসাঁট হয়ে বসে আছে। সত্যি জানি না এটা কোন শহর। কাঁধ বাঁকিয়ে রাস্তার দোকানের নেমপ্লেটে দেখলাম হাওড়া। বুকের ভেতরে অদ্ভুত একটা ধুঁকপুকের দ্রুত লয় টের পাচ্ছি। একটা দুটো পাখি নোংরা ঘাটছে, দুটো কুকুর লীলা রতির পর কেমন শেষ আমেজের সুখ নিতে চক্রাকারে একে অন্যের পেছনে ঘুরছে। একটা বুড়ো বিমর্ষ হয়ে নিচু মুখো হয়ে ঝাড়ু দিচ্ছে। তার মনোযোগ দেখে মনে হচ্ছে জগৎ সংসারের তাবৎ ময়লা ঝাড়– দিয়ে ফকফকা করাই যেন তার কাজ। ভাবছি কোন দিকটায় যাবো ডানে-না বাঁয়ে...!
একটু সামনে এগোতেই দেখি একটা চলটা ওঠা দেয়াল, ক্ষয়ে যাওয়া ইটগুলো দাঁত কেলিয়ে হাসছে। মাঝখানটায় না, ঠিক মাঝখানটায় না, একটু চেপে, ...কারা যেন সুবোধের মতো কাকে এঁকেছেন, হাত পাকা না, তাই বোঝা যাচ্ছে না পরিষ্কার করে আসলে কি এঁকেছেন। লোকটা উল্লাসে মেতেছে না শোকে আহাজারি করছে ঠিক বোঝা গেল না।
দিদিমনি পেপার লাগবে...?
ঝটপট কিছু বুঝতে না বুঝতেই হাতে গুঁজে দিয়ে বললো পয়সা দিন, ও দিকটায় যাবো। সক্কাল সক্কাল দু’চারটে না বেচলে বেলা হয়ে গেলে অন্য মাল হাতে চলে আসবে। দিন দিন পয়সাটা।
আমি অবাক হয়ে ওয়ালেট চেক করে দেখি আমার কাছে পয়সা নেই! আবার বলে উঠল-
পেপারটা নাও
পয়সা নেই রে ভাই। আর আমি এদেশের খবর পড়ে কি করবো বলো!
ছেলেটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। আমিও সামনে চলে যাচ্ছি। রিকশায় ভেঁপু বাজছে অনবরত। মনে হচ্ছে যেন উৎসব এদেশের আনাচে কানাচে। দূরে একটা রিকশাওয়ালা হাঁকছে, এই যে দিদিমনি এই দিকে কোথায় যাবেন চলুন নামিয়ে দিয়ে আসি।
তার ডাকে আমিও গিয়ে হাজির। কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো আমি তো কাওকেই চিনি না এ শহরে। তবু বললাম আচ্ছা চলো। চেপে বসতেই জিজ্ঞেস করলো ডানে না বায়ে।
আমি মানুষ দেখছি, ভাতের ফেনের মতো সকাল... চারদিকে একটা গতিময়তা। একটা আয়োজন চলছে দিনের শরীরে মাখন লাগিয়ে দিনটিকে প্রস্তুত করতে।
এই যে দিদিমনি শুনতে পাচ্ছেন না বলছি কোন দিকে ছুটবো?
আসলে আমি জানি না কোথায় যাবো?
আচ্ছা ভাই।
তুমি কি একজন লেখককে চেনো? তার একটা বইয়ের নাম জানি। ‘বাউড়ি বাতাস’। ভীষণ ভালো কবিতা লেখে চেনো?
নাহ গো দিদিমনি আমি চিনি না। তোমাকে বইয়ের দোকানে নিয়ে যাই। ওরা বলতে পারবে ঠিক।
আমিও ভাবছি বেশ তবে চলো।
দুই.
আমার কাছে অচেনা শহরের ধুলো, শব্দ, গন্ধ হঠাৎ চেনা মনে হতে লাগলো। একটা খোঁজ আমাকে আপন ভাবাচ্ছে। আমাকে আপ্লুত করছে। আমি আসলে কেন খুঁজছি? লোকটাকে কী দরকার? হাজারটা প্রশ্ন। এদিকে পায়ের আঙ্গুলগুলো ফুলে ঢোল, ভেতরে কেমন কুট কুট করছে। স্বস্তি পাচ্ছি না।
একটা বস্তির মহিলা ভাতসমেত কালো একটা হাঁড়ি রাস্তায় ছুড়ে দিয়ে দ্রুত আমার রিকশার সামনে আসছে। আর উচ্চস্বরে বলে যাচ্ছে- বলি ও মরদ তোর ভাত দেবার মুরোদ নেই আর গতর চষে বেড়াস... কাউকেও ছাড়লিনে। আমার ফুলের মতো বোনটাকেও নরকের রাস্তা দেখিয়ে ছাড়লি তুই। কি দুনিয়া এলো ভগবান সব দেখি লিঙ্গের আগায়। তোর সংসারের মুখে আগুন। আজ তোর মুখে আগুন দেবো বলছি। আজ যদি একটা বিহিত না করতে পারি তবে আমার নাম মিনতি না। হুমমম বলে গেলাম!
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি,
আহা কি হয়েছে যে মহিলা নিজের স্তনের ওপরের কাপড়টা পর্যন্ত ঠিকঠাক ঢাকেনি!
ঈশারা করে বললাম এই যে আপা আঁচলটা টেনে নেন। আপনি মনে হয় খেয়াল করেননি।
ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো, এই যে বড় নোকের বিটিরা। কি বুঝবেন আমার মতো মানুষের মনে কত কষ্ট সোয়ামীর জ্বালা... পেটের জ্বালা গতরের জ্বালা।
একটু সংযত হয়ে বলছি প্লিজ একটু শান্ত হউন।
সামনে থেকে রিকশাওয়ালা বলে উঠল, এই যে দিদিমনি ওদের সাথে কথা বলতে যাবেন না। খারাপ মেয়ে মানুষ।
না, আমার তো তা মনে হলো না। ঠিক আছে আপনি চালান।
আচ্ছা আপনি কি নতুন এসেছেন? রিকশাওয়ালা প্রশ্ন করল।
একটু নড়েচড়ে বসলাম। নাহ্ ঠিক তা না আমি কল্পনায় বহুবার এসেছি এবার বাস্তবে। লোকটা পেছন ফেরে আমাকে পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিলো।
এই যে এসে পড়েছি। সামনের মোড়টার একটু ডানে গিয়েই বই দোকান। যে কাউকে বলবেন বলে দেবে।
ধন্যবাদ আপনাকে। আমার কাছে পয়সা নেই মানি একচেঞ্জ করতে হবে। ধরো দশ টাকা বেশি রাখো। সুন্দর একটা বুদ্ধি দেবার জন্য।
আসি গো দিদিমনি।
হুম এসো।
তার কেলানো হাসির ঝিলিকটা বড্ড মনোহর।
তিন.
আচ্ছা আমি একজনকে খুঁজছি। আসলে উনার একটা বই পড়েছি। উনার নাম চিন্ময়... কি যেন! চেনেন?
বইটা কোন প্রকাশনীর বলতে পারবেন?
না ঠিক মনে নেই... দেখুন তো উনি কি না?
বইয়ের ফ্ল্যাপের পাশে তার ঝকঝকে ছবি চোখে পড়ল। রুপোর মতো দাঁতগুলো ঝিলিক দিচ্ছে।
সাউথের লোক নাকি উনি?
নাহ্ নাহ্ উনি ওপার বাংলার। বাপের আমলে চলে এসেছেন। বড্ড ভালো কাজ করছেন আজকাল।
তাই নাকি?
তা কতগুলো বই আছে উনার?
৭/৮টা তো হবেই।
বেশ।
এখন লিখছে কম মিছিল মিটিংয়ে বেশি দেখি। এই যে এটাতে বৈতরণী পুরস্কার পেল। পড়ুন।
আচ্ছা। আসলে একটা কথা বলতে চাচ্ছি। মানে আমি ওনার দেখা কোথায় পাবো বলতে পারেন?
তা জানি না। ঐ যে মেডিকেলের ছাত্ররা অনশন করছে ওখানে আসে রোজ। গণসঙ্গীত চলে বক্তৃতা চলে। দেখুন পেয়ে যেতে পারেন।
তার কথামতো খুঁজতে ইচ্ছে করল। বই না কিনেই ফুটপাত ধরে হাঁটা শুরু করলাম। সবে তো সকাল। আমার রাতে ট্রেন।
হাঁটছি অচেনা শহরে যার ভাষাটা এক বলার ভঙ্গিটা আরেক। রাস্তাটা চেনা মনে হচ্ছে, হয়তো এই পথেই হেঁটে গেছে বহুবার সে। একটা চায়ের দোকান পেয়ে গেলাম। ভাঁড়ের চা। অসাধারণ মাটির গন্ধ। একটা অর্ডার করে নিলাম। চায়ে চুমুক দিতেই মনে মাটির গন্ধ চিন্ময়ের শ্বাসের গন্ধর মতোই!
এটা কি সত্যিই তার শ্বাসের ঘ্রাণ? চারদিক শুধু চিন্ময়। আমি পুরে যাচ্ছি অচেনা শহরে। ক্লান্ত হতে হতে আবেশে মন হারাচ্ছে তার কথা ভেবে। তার বলবার ভঙ্গি সবার সাথে মিলে যাচ্ছে চা ওয়ালা, পেপার ওয়ালা, টাঙ্গাওয়ালা বই দেকানী... ট্যাক্সি ড্রাইভার... রাস্তার মহিলা সব্বাই যেন তার মতো করে কথা বলছে।
এখানে এসে দেখি অনশন স্পটে মেডিকেল স্টুডেন্টরা প্রায় মরুমরু স্যালাইন দেওয়া। কেউ বা মার্কিন কাপড়ে নুনজল মিশিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছে... সবার চোখ স্থবির। শত শত লোক জটলা পাকিয়ে ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই চিনলাম এক মহিলাকে। কোথায় যেন দেখেছি। হুম মনে পড়ছে টিভিতে ‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি’ এমন একটা গান গেয়েছিলেন। একটা লোক তদারকী করছে সব। কেমন এলোমেলো।
এই যে ভাই একটা ইনফরমেশন দেবেন প্লিজ...
জ্বি বলুন কী
আমি আসলে বাংলাদেশ থেকে এসেছি।
তো কি চাই? সাংবাদিক টাংবাদিক নাকি?
আচ্ছা আজ কি চিন্ময় দা আসবেন?
এসেছিল তো দুঘণ্টা হলো। ঐ যে ঐ দিকটায় চলে যান পেয়ে যাবেন।
দ্রুত ভিড় ঠেলে যাচ্ছি... সিগারেট গাঁজার মিশেল গন্ধ। যাচ্ছি...যাচ্ছি...। দেখলাম কত পরিচিত শিল্পী কত লেখক আরি ব্বাহ!
আমি এদের সব্বাইকে চিনি।
লজ্জার আড়মোড়া ভেঙে একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম, এক্সকিউজ মি, আচ্ছা চিন্ময় দা কে খুঁজছিলাম।
ও চিন্ময় দা এক্ষুনি তো ছিল! কোথায় গেল হঠাৎ। এই তো ব্যাগ পড়ে আছে।
সবাই কেমন তন্ন তন্ন করে খুঁজছে এদিক ওদিক। একজন উপযাচক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি মানে আসলে চিন্ময় দার কি হোন..?
আমি কিছু হই না উনার ভক্ত ‘বাউড়ি বাতাস’ পড়ার পর আমি উনার প্রেমে পড়ছি।
লোকটা হাসলো... ভালো বলেছেন লেখকের প্রেমে সবাই পড়ে ... তাই না?
তার কথা শেষ না হতেই একটা লোক এসে বলল, চিন্ময় দা একটু বেড়িয়েছে গো... ব্যাগ নেওয়ার সময় পাননি।
কখন ফিরবে কিছু জানেন?
নাহ্। বাউণ্ডলে পাবলিক কোথায় কি কাজ পড়েছে চলে গেছে।
একটু আমতা আমতা করে বললাম, চিন্ময়দার ব্যাগটা দেবেন? না মানে ছুঁয়ে দেখতাম। কিছুক্ষণ পর আমার ট্রেন। ছেলেটা মৃদু হাসছে। হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নিয়ে চেয়ারে বসলাম। লোকটা একটু দূরে চলে গেল।
আমি ব্যাগটা বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে নিবিড় আলিঙ্গন করছি। এলোপাতাড়ি চুমো দিচ্ছি। দেখলাম আশপাশে কেউ নেই।
আমি সাবলিলভাবে হাতে চিন্ময়দার ব্যাগ নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম। কেউ কিছু বলল না পিছু ডাকলো না।
টেক্সিকে বললাম, ভাইয়া জ্বি হাওড়া চালিয়ে...
ওকে দিদি
আমি যেন সমস্ত দুনিয়ার সুখ সঙ্গে করে নিয়ে ছুটছি। স্পেন্ডরের ট্রেন হুইসেল দিয়ে ছুটলো। কাঁপতে কাঁপতে ব্যাগ হাতরালাম। পেলাম লাইটার, ডায়েরি, ছোট নোটবুক, একটা কবিতার বই আর এক প্যাকেট সিগারেট। প্রথমে সিগারেটে আগুন দিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরলাম। জীবনে প্রথম সিগারেট ফুঁকছি। তারপর ডায়েরি খুলে দুটো লাইন দেখে স্ট্যাচু হয়ে গেলাম-
‘একদিন মধুভোরে নম্রতা আসবে
আমার আলিঙ্গন চাইতে
আমি তার আয়োজনে দিন মাস বছর
পার করছি
সে আসবে একদিন মধু ভোরে...।’