ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আকবর হোসেন

দেশ-কাল সমাজজীবনের শিল্পী

রকিবুল হাসান
🕐 ১২:৩৩ অপরাহ্ণ, জুন ১৪, ২০১৯

ঔপন্যাসিক আকবর হোসেনের শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের বেশ কিছু সময় পূর্ব বাংলার নদীয়া জেলায় (বর্তমানে কুষ্টিয়া ও পাবনা) কেটেছে। জন্মস্থান কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে শৈশব-কৈশোর-জীবন কাটিয়েছেন। বিএ অধ্যয়নকালে কলকাতার রাজনৈতিক অবস্থা তার মনে প্রভাব ফেলে। তবে কোনো দলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি ছিলেন না। ছিলেন রাজনীতি সচেতন। তার উপন্যাসে তা প্রতিফলিত হয়েছে।

তিনি লক্ষ করেছেন একশ্রেণির মানুষ ‘নেতা’ নামে খ্যাত হলেও তারা প্রকৃত অর্থে ব্যক্তিস্বার্থলোভী মানুষ। এ ধরনের নেতারা লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত, সর্বহারা মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণসংগ্রাম গড়ে তোলার কথা বলে মূলত, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায়। সুতরাং সেই মানুষটি যিনি প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র আর গণসংগ্রামের নেতা নন, সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করেই যে তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চান তা তার ‘নতুন পৃথিবী’ উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে।

আকবর হোসেন ছিলেন সমাজ সচেতন শিল্পী। সমাজের বিভিন্ন সমস্যাকে তিনি উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সমাজে নারী-পুরুষের অবৈধ জৈবিক মিলনে নারীরা যুগ যুগ ধরে যে লাঞ্ছিত তারই চিত্র এঁকেছেন তার প্রথম উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’ গ্রন্থে। গ্রামের অশিক্ষিত সহজ- সরল মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির অর্থপিশাচ স্বার্থান্বেষীরা যে ধোঁকাবাজির রাজত্ব চালায় এবং সে সঙ্গে নগরজীবনে উচ্চাভিলাষিতার নামে যে নষ্টসভ্যতা, তার অনুকরণে শিক্ষিত সমাজ ভ্রান্ত প্রগতির নামে কতটা অধঃপতনে নিমজ্জিত তার স্বরূপ এঁকেছেন তিনি ‘পাইনি’ উপন্যাসে। এ অধঃপাতটিই আকবর হোসেনের শিল্পীমনকে সংযুক্ত করেছিল।

তার সাহিত্যজীবন মূলত, ১৯৪০-এর দশক থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত। জমিদারি আমলে জমিদার তথা তাদের নায়েবদের অত্যাচারের কাহিনীও লক্ষ করা যায় তার রচনাতে। ‘অবাঞ্ছিত’তে জমিদারের অত্যাচারে দুর্যোগের কালো মেঘ নেমে এসেছিল গোমস্তা ওসমানের নাতনি রোকেয়ার জীবনে। ‘ঢেউ জাগে’ উপন্যাসে জমিদার এনায়েত খানের অত্যাচারে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে প্রতিবাদী ও আদর্শবান ওমর মাস্টার এবং লাঞ্ছিতা হয়েছে তার স্ত্রী রাঙা বউ। গ্রামের সাধারণ সহজ-সরল নারীরা জমিদারের লালসার শিকার হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। মান-সম্মান নিয়ে যেমন বেঁচে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে ছিল তেমনি অত্যাচারের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে অসংখ্য মানুষ।

১৯৪৬ সালে কলকাতায় যে দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল আকবর হোসেনের ‘মোহমুক্তি’ উপন্যাসে তা তুলে ধরেছেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষও আকবার হোসেনের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ দারিদ্র্য ও কৃষকের দুর্গতির জন্য যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আংশিকভাবে দায়ী তেমনিই কৃত্রিম অভাব সৃষ্টিকারী বণিক সমাজ ও হৃদয়হীন শাসক গোষ্ঠীর হঠকারী ভূমিকাও কম নয়। ১১৭৬ বঙ্গাব্দের মন্বন্তর থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত উপমহাদেশে বহুবার দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়েছে। যেমন ১৭৮০, ১৮৬৬, ১৮৭৩-৭৪, ১৮৭৫-৭৬, ১৮৯১-৯২, ১৮৭৯ ও ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের কথা আমরা বলতে পারি। প্রতিবারই ক্ষুধার ঘাতকের কাছে এ দেশের বহুলোক আত্মাহুতি দিয়েছে। সবচেয়ে ইতিহাসের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ঘটে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে। এ শতকের সবচেয়ে বড় ভয়ংকর এই দুর্ভিক্ষে ১৫ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। সেখানে খাদ্য ও বস্ত্রের অভাব এত তীব্ররূপ ধারণ করেছিল, অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরাও একমুঠো ভাত আর পরিধানের একটু কাপড়ের জন্য নিরুপায় হয়ে শরীর বেঁচতে বাধ্য হয়েছিল। ক্ষুধার জন্য দেহদানের ব্যাপক চিত্র পাওয়া যায় ’৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়কালে।

কলকাতায় দুর্ভিক্ষপীড়িত নারীরা যেন দেহ ব্যবসা করতে না পারে এ জন্য বেশ্যাবৃত্তি প্রতিরোধ কমিটি ও গঠিত হয়েছিল। নর-নারীর লজ্জা নিবারণ করাও কঠিন হয়ে উঠেছিল। এমনকি মৃতের সৎকার ও বিবাহের উৎসবে নতুন কাপড়ও জুটত না। আর এই অভাব থেকেই সমাজে সংঘটিত হতে থাকে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এর ফলে সমাজ ক্রমশই এক মূল্যবোধহীন অন্তঃস্বারতায় পর্যবসিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২)-এ ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ভয়াবহ বর্ণনা রয়েছে।
১৯৪০ সালের দুর্ভিক্ষের বর্ণনা পাওয়া যায় বিভূতিভূষণের ‘অশনি সংকেত’ (১৩৬৬ বঙ্গাব্দ) এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মন্বন্তর’ (১৯৪৪), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নমুনা’, ‘আজকাল পরশুর গল্প’, শওকত ওসমানের ‘বণী আদম’ ও ‘জননী’ ইত্যাদিতে। আকবর হোসেনও সচেতনভাবে দুর্ভিক্ষের ছবি তার উপন্যাসের বিষয়বস্তু করে সমাজ ও কালসচেতন শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তার ‘মোহমুক্তি’ ও ‘ঢেউ জাগে’ উল্লেখযোগ্য। তার ‘মোহমুক্তি’ ও ‘ঢেউ জাগে’ দেশবিভাগের পরে রচিত হলেও এর প্রেক্ষাপট ছিল দেশবিভাগের পূর্বকালের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফলে ভারতবর্ষে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল বাংলার ঘরে ঘরে ক্ষুধার যন্ত্রণার অভুক্ত নর-নারীর যে আহাজারি সৃষ্টি হয়েছিল, গ্রামগঞ্জে-শহরে-রাজধানীতে বুভুক্ষু মানুষের মৃতদেহ যে ভয়াবহ দৃশ্যের সৃষ্টি করেছিল আকবর হোসেনের ‘আভা ও তার প্রথম পুরুষ’ উপন্যাসে উঠে এসেছে। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সময়কাল পর্যন্ত আকবর হোসেনের উপন্যাসে তার শিল্পী মনের পরিচয় পাওয়া যায়।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (১৮৭৬-১৯৪৮)। আরবি হরফে বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র, বাংলাকে ইসলামিকরণের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষার জন্য পূর্ববাংলায় ১৯৪৮ সালের গোড়া থেকেই আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন ক্রমশ কঠিন রূপ ধারণ করে। অবশেষে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রামী জনতার বুকে গুলি চালানো হয়। এর ফলে ঢলে পড়ে রফিক, আবুল বরকত, জব্বার, সালাম, শফিউরসহ অসংখ্য তরুণের রক্তে অর্জিত হয় বাংলা ভাষার স্বীকৃতি। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ১৯৭১ সালে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিকতন্ত্র পূর্ব বাংলার সামগ্রিক পরিবেশকে বিপন্ন করে দেয়। মাঝখানে ’৬২-৬৩ সালের ছাত্র আন্দোলন, ’৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলন, ’৬৫ সালের শ্রমিক আন্দোলন, ’৬৬ সালের স্বায়ত্তশাসন তথা ছয় দফার আন্দোলনের মাধ্যমে বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব এ দেশের মানুষের মনে দানা বেঁধে ওঠে।

আন্দোলন ও প্রতিরোধের মুখে ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্জন করলেও তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) স্বাধীনতার ডাক দেন। বাঙালির আত্মজাগরণের এই মহান দেয়ালীকে চিরতরে নির্বাপিত করার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে অনুষ্ঠিত হয় ইতিহাসের নির্মম গণহত্যার বর্বরতম যুদ্ধ। তার পরেই রক্তপিপাসু শাসকের সব মুখোশ খুলে, সব ধনীর জিগির সাম্প্রদায়িকতা এবং ভারত বিদ্বেষের সব টালবাহানা অপনোদন করে এ দেশবাসী এক অনমনীয় সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত হয়। নয় মাসের যুদ্ধ শেষে তিরিশ লাখ মানুষের রক্তে, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা। ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন পাকিস্তানি শাসন পর্বের এই সাড়ে তেইশ বছরের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সমালোচক ও পর্যবেক্ষক। পাকিস্তানি শাসন পর্বের নানা অত্যাচার, বৈষম্য ও ভারত বিভক্তি এসব তিনি তার ‘দুষ্টক্ষত’ উপন্যাসে আলোচনা করেছেন।

১৯৬০-এর দশকে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম যতই তুঙ্গে উঠেছে, পশ্চিমা শাসকচক্র ততই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য কূটকৌশল অবলম্বন করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের সম্মেলনে ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করেন। ছয় দফার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবসহ অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। অধিকন্তু ছয় দফার স্বপ্নকে বানচাল করার জন্য আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’য় তাকে জড়িয়ে ফেলেন। ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে শুরু হয় বিচারের নামে প্রহসন। ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে গণঅসন্তোষ। ঘাতক শক্তির বুলেটে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি শহীদ হন ছাত্রনেতা আসাদ। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা নিহত হন। গণআন্দোলনের প্রচণ্ডতায় ২৫ মার্চ ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান আইয়ুব খান। নতুন সামরিক শাসক হন ইয়াহিয়া খান।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে নারীরা কীভাবে নির্যাতিত হয়েছিল এবং নির্যাতিত হতে হতে তারা কীভাবে বীরাঙ্গনা নারীতে পরিণত হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল পাকবাহিনীর পশুশক্তির বিরুদ্ধে তারই বাস্তবরূপ ‘দুষ্টক্ষত’ উপন্যাসের চামেলী চরিত্র। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার মধ্যে পরিবর্তনের সূচনা হয়। নতুন দেশে যুক্ত হয় ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক নির্দেশনা। ফলে তার উপন্যাসে দেশ-কাল-সমাজ নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি সমাজ ও কালসচেতন ছিলেন বলেই তার সাহিত্যসৃষ্টিতে এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে সাবলীলভাবে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। আর এ কারণে তার উপন্যাস বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার হয়ে উঠতে পেরেছে। আকবর হোসেন এক্ষেত্রে একজন দক্ষ-শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন।

 
Electronic Paper