পীরেন স্নাল
অচিন্ত্য অর্ক
🕐 ১:৩০ অপরাহ্ণ, মে ১৭, ২০১৯
ধরুন আপনার বাড়ির উঠোনে কী হবে না হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে আপনার বাড়ি থেকে কয়েকশ মাইল দূরে। পরিকল্পনায় আপনার বাড়ি ভেঙে তেঁতুল গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, কোনো পাশে হয়তো বলা হচ্ছে নাটকের জন্য মঞ্চ বানাবে, কেউ হয়তো বলছে একটা উন্নতমানের বাথরুম কিন্তু রাখবেন দয়া করে!
সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আপনার ঘর, আপনার বাড়ি, আপনার জমি কিন্তু একবারের জন্য আপনার সঙ্গে কেউ কথা বলল না বা বলা যে দরকার তাও চিন্তা করল না কেউ। পরিকল্পনা করে সোজা আপনার বাড়িতে হাজির লোকজন, বাড়ি ছাড়তে হবে, এখানে সরকারের উন্নয়ন হবে! খুব অবাস্তব, অতি কল্পনা হয়ে যাচ্ছে? কিছুই না, ২০০৪ সালে এমন কাজও করা হয়েছিল। শুধু ২০০৪ না, যাদের জমি নেওয়ার কথা বলছি তাদের কোনো দিনই হিসাবে ধরে কোনো কাজ করা হয়নি, শুধু ছুড়ে ফেলা হয়েছে বাড়ির উঠোন থেকে, কোনো ওজর আপত্তি কাজে দেয়নি।
২০০০ সাল বন বিভাগ পরিকল্পনা করে মধুপুরে ইকোপার্ক বানানোর। বিশ্বব্যাংক থেকে আর এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক থেকে সবুজ বাতি পাওয়ার পরই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে টাঙ্গাইলের মধুপুরে যে শালবন আছে তাতে একটা ইকোপার্ক বানানো হবে। ১০টা পিকনিক স্পট, ৬টা ব্যারাক বানানো হবে। ব্যাপক কর্মযজ্ঞ, প্রচুর টাকাপয়সার মামলা, উৎসাহী লোকজনের অভাব নেই। ৪৭৮ বর্গকিলোমিটার ব্যাপী শালবন পুরোটা ঘিরে ফেলে এই ‘ইকো’ পার্ক বানানো হবে। কিন্তু যারা কয়েকশ বছর ধরে সেখানে বাস করছে, দুই আড়াই হাজার মান্দি (গারো) আদিবাসীদের কথা কেউ একবার ভাবল না। তাদের সঙ্গে একবারের জন্যও আলোচনার বসার চিন্তা কেউ করেনি। আদিবাসীরা তাদের গৃহহারা হওয়ার শঙ্কায় আন্দোলনে নামে। পীরেন স্নাল সেই আন্দোলনের নেতা। আন্দোলন তীব্র হয়, কোনোমতেই শেকড় ছিঁড়তে রাজি না তারা।
২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারিতে বনরক্ষীরা গুলি ছুড়ে আদিবাসীদের লক্ষ্য করে। মারা যায় পীরেন স্নাল। নিজের ন্যায্য অধিকার আদায়ে প্রাণ দেয় পীরেন স্নাল। বুকের রক্তে বলসালব্রিংয়ের মাটি লাল করে শহীদ হন জয়নাগাছা গ্রামের যুবক পীরেন। আহত হন উৎপল, রিডা, রহিলা, বিনমাংসা, পিছিলনের মতো আরও অনেকেই। শান্তিপূর্ণ মিছিলে এই অতর্কিত গুলি করে পীরেন স্নালের হত্যার বিচার আজও হয়নি। পীরেন স্নালের রক্তের বিনিময়ে তখন সরকার বাতিল করে ইকোপার্ক কার্যক্রম। কিন্তু ওই আন্দোলনের মামলায় জড়ানো হয় কয়েক হাজার আদিবাসীকে। সেই মামলা চলে দিনের পর দিন।
আদিবাসীরা নিজের ভিটেমাটির অধিকার নেবে কী মামলা সামলায়েই উঠতে পারে না। ২০০৭ সালের ১৮ এপ্রিল তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌথবাহিনী চলেশ রিসিল কে ধরে নিয়ে যায়। ক্রসফায়ারে মারা যায় চলেশ রিসিল। মরেও রক্ষা পায় না রিসিল। মামলায় ‘গরহাজির’ থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে সমন জারির মতো কা-ও করেছিল! পীরেন স্নালের সমাধির কাছে তারই স্মরণে গড়ে উঠেছে ‘মৃত্তিকা’ পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।