ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গারো লোকগল্প

ডম্বি ওয়ারী

গল্পকার খালসন সাংমা রংমুথু বাঙলায়ন সুমনা চিসিম
🕐 ১২:০৭ অপরাহ্ণ, মে ১৭, ২০১৯

সে অনেক অনেক আগের কথা। রংডিক নদীতীর ঘেঁষে এক গ্রাম ছিল। জরেং এ গ্রামেরই বাসিন্দা। দিন যায় মাস যায়। এক দিন জরেং ডম্বি নামে অপূর্ব রূপবতী এক যুবতীকে বিয়ে করল। ডম্বি ছিল রেমা গোত্রের। তার মতো এমন সুন্দরী দ্বিতীয় আর কোনো নারী ছিল না ওই এলাকায়। সে কারণেই জরেং সব সময় গর্ব করে বলে বেড়াত তার স্ত্রীর মতো সুন্দরী কেহই নেই। কারও নেই। কোথাও নেই।

এক দিন জরেং রংডিক নদীর এক গভীর জলাধারের (ওয়ারী) তীরে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে চিৎকার করে বলছিল, তার মতো ভাগ্যবান কেউ নেই এ পৃথিবীতে। এমন সুন্দরী স্ত্রী কার আছে? দুই সন্তান জন্ম দেওয়ার পরও ডম্বি আরও বেশি যুবতী ও রূপবতী হয়েছে। ইত্যাদি ইত্যাদি। গর্বে গর্বে দিন তার যায়। এ কথা জলাধারের গভীর পানির ভেতর থেকে মৎস্যপুত্র শুনছিল। আর মনে মনে ভাবতে লাগল। আর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো, সে এ সুন্দরী ডম্বিকে খুঁজে নেবেই নেবে!

ডম্বি কখন নদীতে আসে মৎস্যপুত্র জলাধারের কিনারে এসে তারই অপেক্ষায় দিন কাটাতে লাগল। অনেক দিন অপেক্ষার পর দেখল ডম্বি পানি তুলতে নদীর দিকে আসছে। আর এ কি! তাই তো সত্যি সত্যি ডম্বি অপূর্ব রূপবতী এব যুবতী। মৎস্য যুবক দেখেই ডম্বির রূপে মুগ্ধ হলো ও ভালোবেসে ফেলল!

ডম্বির অপরূপ রূপ দেখে মৎস্য যুবকের মন আর বসে না। জলাধারের কিনারে প্রতিদিনই এসে বসে থাকে ডম্বিকে এক নজর দেখবে বলে। আর মনে মনে পরিকল্পনা করে ডম্বিকে কীভাবে তার প্রাসাদে নিয়ে আসতে পারে। সুযোগ খুঁজে। এদিকে ডম্বি প্রায়শই নদীতে এসে কাপড় ধোয় ও গোসল করে। পানি নিয়েও যায় সে এ নদী থেকে। আর এসব দেখে মৎস্য যুবক সুযোগ খুঁজতে থাকে। নিশ্চয়ই এক দিন সে ডম্বিকে নিতে পারবে। সারাক্ষণ সুযোগ খুঁজতে থাকে সে।

বরাবরের মতোই ডম্বি গোসল করতে এলো। যেই নদীতে নামল অমনি হঠাৎ কে যেন পা ধরে পানির ভেতর টানতে লাগল। ডম্বির বড় মেয়ে দেখছিল তার মা ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু এও ভাবল মা হয়তো ইচ্ছা করেই ডুব দিয়ে চলে যাচ্ছে। ছোট বোনকে পিঠে নিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে লাগল, হয়তো মা ফিরে আসবে। কিন্তু না আর ফিরে আসে না। অপেক্ষায় অপেক্ষায় বসে থাকল নদীতীরে। সে অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ অপেক্ষায় থাকল।

এদিকে ছোট্ট বোনটি ক্ষুধায় কান্নাকাটি শুরু করে দিল। সামলাতে পারছিল না আর! কি করা যায় ভেবে নদীর কিনারে উঁচু এক পাথরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগল। মা মা তুমি ফিরে আস। বোনটির ক্ষুধা পেয়েছে। দুধ খাওয়াতে ফিরে আস মা! বোনটি কাঁদছে মা। তুমি ফিরে এসো। দুধ খাওয়াতে ফিরে এসো। ক্ষণে ক্ষণে ডাকতে লাগল।

ডম্বি বড় মেয়ের ডাক শুনতে পেল। ডাক শুনে নদীর কিনারে আসতে চাইলে মৎস্য যুবক কোনোভাবেই তাকে ছাড়ছিল না। ডম্বি ছোট্ট মেয়েটিকে দুধ খাওয়ানোর জন্য জোর করাতে সে ডম্বির উপরের অংশ পানির উপরে তুলে পা শক্ত করে ধরে থাকল। ডম্বি এভাবেই তার ছোট্ট মেয়েকে দুধ খাওয়ালো। আর দুধ খাওয়ানো শেষে বড় মেয়েকে বলল, তুমি বাড়ি যাও আর ছোট বোনটিকে দেখাশোনা কর এই বলে পানিতে ডুব দিয়ে চলে গেল।

জরেং বাড়ি এসে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল তোমার মা কোথায় গেছে? বলল, মা গোসল করতে গিয়ে পানিতে ডুব দিয়ে চলে গেছে। বোনকে দুধ খাওয়ানোর পর আর ফিরে আসে নাই। আবারও পানিতে ডুব দিয়ে চলে গেছে। জরেং মেয়ের কথায় বিশ^াস হলো না। কেননা মানুষ পানির ভেতর বেঁচে থাকতে পারে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে করে ফিরে না আসাতে জরেং ভাবল ডম্বি পানিতে ডুবে মারা গেছে হয়তো। এ কথা ভেবেই মনটা কেঁদে উঠল তার। না এ হতে পারে না।

পরদিন বড় মেয়েটি বোনকে নিয়ে নদীর কিনারে এলো। আগের মতো ডেকে বোনকে দুধ খাওয়াতে শুরু করতেই জরেং দূরে পাহাড়ের ধারে বসে তা দেখে ফেলল। মেয়ের ডাকে চোখের পলকে তার সুন্দরী স্ত্রী পানির ভেতর থেকে ভেসে এসে দুধ খাওয়াচ্ছে। এ কেমন করে সম্ভব! এ আমি কি দেখছি! মাথা ঠিক আছে তো আমার! নানান আবোল-তাবোল চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল শুধু। দেখল দুধ খাওয়ানো শেষে ডম্বি পানির ভেতর আবারও চলে গেল। এতে জরেং ভীষণ কষ্ট পেল। কেননা সে ডম্বিকে মনেপ্রাণে প্রচ- ভালোবাসত। পানির দিকে অপলক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকল। চোখের পলক যেন আটকিয়ে গেল। না হয় না। হয় না। এমন হতে পারে না। কি করা যায়। কীভাবে ডম্বিকে ফিরে আনা যায়। ভাবতে লাগল।

পরদিন। জরেং তার বিশেষ এক তলোয়ারের দুদিক ধার দিতে লাগল। ধার দিতে দিতে মনে মনে বিড়বিড় বলতে লাগল স্ত্রীকে বাঁচাতে হবে। কে সে! কার এমন সাহস ডম্বিকে পানির ভেতর রেখে দেওয়ার! ধার দিতেই আছে। আর বিড়বিড় করতেই আছে। একসময় ধার দিতে দিতে এমন ধার হলো ছোঁয়ালাগা মাত্র কারও রক্ষা আর থাকবে না। সে এমনই ধার! এ ধারে কোনো মশা-মাছি যে-ই হোক রক্ষা পাবে না আর। বজ্রপাত চমকানো আলোর মতো চকচকে হয়ে গেল। চারদিক আলোয় আলোকিত হয়ে গেল তার তলোয়ার।

সবকিছু ঠিকঠাক করে জরেং মেয়েকে নিয়ে নদীর ধারে গেল। আর ডাকতে বলল। জরেং গোপনে তলোয়ার নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কখন ডম্বি ভেসে ওঠে। মেয়েটি বাবার কথামতো ডাকতে লাগল। কী আশ্চর্য। সত্যি সত্যি মেয়ের ডাক শুনে ডম্বি পানির ভেতর থেকে ভেসে আসল কিনারে। কিন্তু মৎস্য যুবক পা দুটি শক্ত করে ধরে থাকল। পরে জরেং হাঁটু গেড়ে এক হাতে স্ত্রীর হাত ধরল আর অন্য হাতে পানির ভেতরের শত্রুকে ভয় দেখানোর জন্য তলোয়ার ঘোরাতে লাগল। ঘোরাতে লাগল। ছপাত ছপাত শব্দে তলোয়ার ঘুরতে লাগল। তলোয়ারের ঝলকানিতে মৎস্য যুবক ভয় পেয়ে ডম্বিকে ছেড়ে দিল। জরেং খুশিতে নাচতে শুরু করল আর জোরে জোরে চেঁচাতে লাগল। জরেং-এর আনন্দ-ফুর্তি পানির ভেতর থেকে মৎস্য যুবক শুনতে পেল। আর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞা করতে লাগল। ডম্বিকে যে করেই হোক সে আবারও নিয়ে আসবেই।

জরেং স্ত্রী ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য নদী থেকে অনেক দূরে উঁচু পাহাড়ের এক বড় গাছের ওপর ঘর বাঁধল। মনে মনে ভাবল আর কোনো চিন্তা নেই। সুখে-শান্তিতে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে বসবাস করতেও লাগল। জরেং নিজেই গোসলসহ যাবতীয় সাংসারিক কাজের জন্য পানি তুলে নিয়ে আসতে লাগল। ডম্বিকে বাইরে যাওয়ার নিষেধ করে দিল। গাছের উপরে ঘর হওয়াতে জলজন্তু বা শত্রু থেকে হাজার গুণ নিরাপদ মনে করল। ভাবল কেউ কিছুই করতে পারবে না এখন।

এদিকে মৎস্য যুবক তার কর্মচারীদের নিয়ে ডম্বির অবস্থান খুঁজতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ডম্বির অবস্থানও জেনে গেল তারা। ডম্বিকে খোঁজার এ রাস্তাকে ‘ডম্বিকে ফিরে পাওয়ার রাস্তা’ (Dombiko Am ani Rama) নামে (বর্তমানে এই রাস্তা মেঘালয় রাজ্যে গারো পাহাড়ের আরুয়াকগিরি এবং নকখাটগিরি নামক জায়গায় দেখা যায় বলে লোকমুখে শোনা যায়) নাম দিল। নদী থেকে গাছের উপর তৈরি ঘর (বোরাং) পর্যন্ত টানেল করার পরিকল্পনা করল। অনেক জলজ প্রাণী এ কাজে জড়িতও হলো। যেমন প্রকা- সংকীর্ণ (এক ধরনের জলজ প্রাণী), ইল, অসংখ্য কাঁকড়া, জলের প্রকাণ্ড টিকটিকি, ছোট জাতের কুমির, প্রকাণ্ড বোয়াল, শিং মাছসহ অনেক জলজ প্রাণী এ কাজে অংশ নিল।

নদীর স্রোতের সাহায্যে টানেলের কাজ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারল। উপর থেকে সহজে বোঝার উপায় ছিল না মাটির নিচে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কী ধরনের কাজ হয়েছে। এদিকে বর্ষাকালও শুরু হল। এক দিন দুদিন টানা বৃষ্টি হতে লাগল। নদীর প্রচণ্ড স্রোতে বন্যা বয়ে যেতে লাগল। সারা রাত ঝড় ও দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি হলে মৎস্য যুবক জরেংকে সর্তক করে বলল, তোমরা ডুরা পাহাড়ে চলে যাও। পাহাড় ধসে ডুবে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু জরেং বিশ্বাস না করে বরং চিৎকার করে বলল, নদী থেকে অনেক দূর তাদের অবস্থান। পাথুরে পাহাড়। ধসে পড়ার সম্ভাবনা নেই। এসব বলে জরেং নিশ্চিন্তে পরিবার-পরিজন নিয়ে রাতে ঘুমাতে গেল। বিপদ কতটা বিপজ্জনক ও সন্নিকট তা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি জরেং। যা হওয়ার তা ঘটে গেল রাতেই। পরদিন সকাল। গ্রামবাসী দেখল পিপিল গাছসহ বোরাং কিছুই নেই আর। বরং দেখলো বড় এক লেক হয়ে প্রবল স্রোত বয়ে চলেছে। বোরাংসহ পরিবারের সবাই তলিয়ে গেল গভীর জলাধারে।

 
Electronic Paper