অনিঃশেষ হৃদয়
সাকিরা পারভীন
🕐 ২:২১ অপরাহ্ণ, মে ১০, ২০১৯
আমার রবীন্দ্রভাবনা! রবীন্দ্র তো আমারই সত্তা। মেঘের পরে মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে। আর তিনি আমাকে আবিষ্ট করে রাখেন। মোহগ্রস্ত করে রাখেন। আচ্ছন্ন করে রাখেন। তাকে নিয়ে আমার ভাবনা অনিঃশেষ। শেষ হয় না। আমি তাকে ভালোবাসি। তিনি গুরুদেব। তিনি মহামানব।
তার গানের মাধ্যমে আমি প্রার্থনার বাণী খুঁজে পাই। তার সুর ও বাণীর ভেতর দিয়ে আমি পরম শক্তির সঙ্গে সংযোগ তৈরি করার চেষ্টা করি। যখন শুনি, ‘তুমি যদি না দেখা দাও করো আমায় হেলা/কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা’।
এই যে তুমি হলেন তিনি। তিনি যদি না দেখা দেন তাহলে সব মিথ্যা। কিন্তু আমার মতোন এত ক্ষুদ্র জীব তার দেখা কেমন করে পাবে। শুধু রবীন্দ্রনাথ আছেন বলে মায়ের ভাষায় তার সঙ্গে কথা বলতে পারি। অন্তত আবেদন জানাতে পারি। গাইতে পারি বারবার দূরের পানে মেলে আঁখি, কেবল আমি চেয়ে থাকি, পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দূরন্ত বাতাসে।
‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে/ আমায় কেন বসিয়ে রাখ/একা দ্বারের পাশে’ কিংবা ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না।/কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না।...মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না’ না এভাবে হয় না, এটা গেয়ে শোনাতে হয়, বোঝাতে হয়, বুঝতে হয়।
একটু অতীতে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন। ওইসময়ে একবার সঞ্চয়িতা বুকে চেপে ঘুরি ফিরি। মা বলে কী হয়েছে রে? আমি বললাম, মা আমি বোধহয় এই কবিতাটির প্রেমে পড়েছি। ‘যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,/সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,/যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,/যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া’ এ কবিতাটি ছিল।
সেলিম আল দীন স্যারের কাছে অশেষ ঋণী। তিনি বলতেন, রোজ গীতবিতান পড়বি। যত বড় হবি বুড়ো হবি তত রবীন্দ্রনাথ নানারূপে মহামহিম হয়ে উঠবেন তোর কাছে।
আমার কষ্ট হয় কেউ কেউ সমালোচনার নামে রবীন্দ্রবিরোধিতার দিকে নজর রাখে বেশি। তাকে আধুনিক মনে করা হয় না। কিন্তু তার চেয়ে আধুিনক কেউ আছে নাকি? থাকলে কেউ লিখতে পারবে ‘বিসর্জন’-এর সংলাপ? ত্রিপুরা রাজ্যে আজি হতে বলি প্রথা হইল নিষেধ!
কিংবা ‘অচলায়তন’ ভেঙে কী বের হতে পেরেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা? পারেনি। হ্যাঁ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানারকম দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে।
এবার যদি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের দিকে আসি! সেও তো বিশাল ব্যাপার। মার্লোন ব্র্যান্ডোর কটি বিয়ে আর কটি সন্তান এসব বিবেচনা করে আমরা তার অবিনয় দেখতে বসি না। আর তার কোনো জীবন মূল্যায়নের কোনো স্পর্ধা আমার নেই। আউটসাইডারে মায়ের লাশ সন্তানের জন্য কোনো বিশেষ অর্থ বা বেদনা বহন করে না। গুরুদেব কন্যার মৃত্যু সংবাদ একপাশে রেখে নৈমিত্ত্যিক অন্য কাজ করতে দ্বিধা করেননি। আমার কী কাফকার সৃষ্ট চরিত্র আর ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে এক করে দেখি? না। ঠাকুর দেবযানীর সব অনুনয় উপেক্ষা করে চলে যায় কেন যায়? কেননা কর্মই সেখানে মুখ্য।
আমরা এক জীবনে রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করার মতো শক্তিই তো অর্জন করতে পারব না। আর তাকে উপলব্ধি করা শুরু করলে, জীবন যে অপরূপ সুন্দর হয়ে উঠবে। আমি তো চলচ্চিত্রের ক্লাস শুরু করি রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে। আর হ্যাঁ রবীন্দ্রনাথের কাছেই শিখেছি অন্ধকারের মাহাত্ম্য।
পদ্মার বুকে তিনি ভেসে বেড়াতেন গভীর অন্ধকারে। অন্ধকারের পরত বা স্তরকে তিনি নাম দিয়েছিলেন, ‘বৈভব’। এই যে বৈভবের রূপ দেখা, ব্যাথ্যার মাঝে প্রকৃত সুখের অনুসন্ধান, সেও তার কাছে শেখা।