ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শেষ পর্যন্ত কেন কাঞ্চনজঙ্ঘা

হামিদ কায়সার
🕐 ৬:৪০ অপরাহ্ণ, মে ০৩, ২০১৯

অনেক দিন পর একটা মধুর বিপদে পড়া গেল। জীবনানন্দ সম্পাদক শিমুল জাবালি এবার ধরল, মুগ্ধতার সিনেমায় এ-সংখ্যায় সত্যজিৎ রায়ের একটা সিনেমা নিয়ে লিখুন।

কোন সিনেমা নিয়ে লিখব, বিপদ সেটাই। অপু ত্রিলজির কথা মনে আসবে প্রথম, সেটাই স্বাভাবিক। সেজন্য তো স্পেস অনেক লাগবে! কাপুরুষ মহাপুরুষ? জনঅরণ্য? নায়ক? শতরঞ্চ কী খিলাড়ি? চারুলতা? অরণ্যের দিনরাত্রি নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘা? শেষ পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘাকেই বেছে নিলাম। মূলত তিনটি কারণে! এক. ম্যাল, দার্জিলিংয়ের ম্যাল। দুই. মনিকা থুক্কু মনিষা! তিন, কাঞ্চনজঙ্ঘা আজো প্রাসঙ্গিক এবং সমকালীন।

আগে ম্যালের কথা বলে নিই। তিন-চার দিন ধরে বেশ গরম পড়ছিল। এত গরম যে তেষ্টানোই দায়। ভাবলাম, কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে লিখলে বেশ ঠাণ্ডা সুশীতল থমথমে ঝাউবন ঘেরা ম্যালের একটা আবহ পাওয়া যাবে। একটু হলেও আরাম পাব। ১০২ মিনিট দৈর্ঘ্যরে পুরো সিনেমাটিই তো ম্যালকে ঘিরে আবর্তিত। মূল ম্যাল চত্বর আর চারদিকের ম্যালের বিভিন্ন বাঁক, সড়ক, চড়াই উতরাইয়ের পথ ছাড়া এই সিনেমার আর কোনো দৃশ্যপট নেই বললেই চলে। এক দুটি দৃশ্য রয়েছে শুধু হোটেল রুমের। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। অথচ চিত্রনাট্য এক মুহূর্তের জন্যও ঝুলে যায়নি। বরং বৈচিত্র্যের নানান বিন্যাস ও সমাহারে সমৃদ্ধ।

ঘটনাস্থল শুধু ম্যাল হলে কী হবে, দার্জিলিংয়ের এই ম্যালে বেড়াতে আসা শিল্পপতি ইন্দ্রনাথ রায়, তার স্ত্রী লাবণ্য, পুত্র অনিল, বিবাহিতা বড় মেয়ে অনিমা, অনিমার স্বামী এবং ওদের মেয়েশিশু, অবিবাহিতা ছোট মেয়ে মণীষা, শ্যালক জগদীশসহ মণীষার পানিপ্রার্থী বিলাত ফেরত মিস্টার ব্যানার্জি এবং কলকাতা থেকে অসুস্থ কাকাকে নিয়ে হাওয়া বদল করতে আসা বেকার যুবক অশোকের চরিত্র বৈশিষ্ট্য পরিপূর্ণভাবেই ফুটে উঠেছে এবং সিনেমা শিল্পোত্তীর্ণ হয়েই পেয়েছে সফল পরিণতি।

মণীষার কথা পরে বলব। আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা কেন এখনো প্রাসঙ্গিক এবং সমকালীন সেটা বলা যাক। আমি ঘটনাক্রমে গুলশান দুইয়ের এক বিশাল শিল্পপতির বাসায় কয়েক দিন ঘন ঘন আসা-যাওয়া করতাম। সে বাসার গেটে কুকুর ছিল না বটে, তবে এমন একজন দারোয়ানের অস্তিত্ব ছিল, যে কিনা সে বাসায় রিকশায় বা পদব্রুজে কেউ গেলে সালাম দেওয়া তো দূর অস্ত, কথা পর্যন্ত বলতে চাইতো না। আর কেউ যদি গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হতো সে কসাই সম্রাটই হোক আর পকেটমার সর্দারই হোক, সালাম দেবে না স্যালুট দেবে তা ভেবে-টেবে একেবারে দিশেহারা হয়ে যেত। তার এ হেন প্রবণতার পেছনে যে সেই শিল্পপতি বা তার পত্নির প্ররোচনা ছিল না, তা বলি কি করে! সেই শিল্পপতির একমাত্র কন্যাটির বিয়ে হওয়ার চার মাস যেতে না যেতেই সে বিয়ে ভেঙে গেল, ছেলেটির একাধিক মেয়ের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক থাকার কারণে।

আমি আরেকজন শিল্পপতির ঘটনা জানি, তার দুই মেয়ের সংসারই ভেঙে গিয়েছে দুই জামাইয়ের ইয়াবাসহ বিভিন্ন ড্রাগ আসক্তির কারণে। বিয়ে যে শুধু শিল্পপতির মেয়েদের ভাঙছে, তা না। এটা এখন আমাদের সমাজে একটা মহামারীরই আকার ধারণ করেছে। তবু আমি কেন শিল্পপতির উদাহরণ টানলাম, তার কারণটা হলো, কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমার মূল চরিত্র ইন্দ্রনাথ রায় একজন প্রচণ্ড প্রভাবশালী শিল্পপতি এবং এখনকার সময়ের প্রায় শিল্পপতিদের মতোই দাম্ভিক। যিনি পরিবারের প্রতিটি চরিত্রের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে চরিত্রগুলোর ভেতরে তৈরি হয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। বড় মেয়ে অনিমাকে ওর অমতেই বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু অনিমা বিয়ের পরও ওর প্রেমিককে ভুলতে পারেনি। সে-প্রেমিক এখনো ওকে চিঠি পাঠায়।

এই চিঠিকে কেন্দ্র করে ওদের দার্জিলিং ভ্রমণও তিক্তকর হয়ে ওঠে। দুজনের মধ্যে একটা বিচ্ছেদের সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর এই পরিপ্রেক্ষিতেই ইন্দ্রনাথ রায় ছোট মেয়ে মনিষাকে বিয়ে দিতে চায় বিলাত ফেরত ড্যাম স্মার্ট মিস্টার ব্যানার্জির কাছে। মনিষার মনের কোনো চাওয়া পাওয়ার মূল্য নেই, ওর পছন্দ-অপছন্দেরও নেই দাম। সিনেমা যখন পরিণতির দিকে এগোয় তখন আবিষ্কার করি, ইন্দ্রনাথ রায়ের স্ত্রী লাবণ্যও ভেতরে ভেতরে পুষে রাখে চাপা কান্না। সে তার ভাই জগদীশকে আকুলভাবে আবেদন জানায় মণীষাকে গিয়ে বলতে যে, ‘মনিকে একটা কথা বলতে পারলে খুব ভালো হতো- বলবে সে নিজে যা ভালো বোঝে তাই যেন করে, কোনোদিক থেকে ওর ওপর কোনো চাপ নেই, জোরজবরদস্তির ব্যাপার নেই-

এই শিল্পপতি ইন্দ্রনাথের সঙ্গে ম্যাল চত্বরে দেখা হয়ে যায় কলকাতা থেকে হাওয়া বদল করতে আসা শংকরের। শংকর সঙ্গে আসা ভাস্তে অশোককে ঠেলে দেয় শিল্পপতির কাছে চাকরি চাওয়ার জন্য। কিন্তু অশোকের আত্মসম্মান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কেননা শিল্পপতি ইন্দ্রনাথ রায়ের তুচ্ছ করে কথাবার্তা বলার ঢংটা ওর পছন্দ নয়। মানুষকে যারা হেয় চোখে দেখে এবং ধমকিয়ে ধমকিয়ে কথা বলে ওদের মুখ দেখতেও ও বীতস্পৃহ। তার চেয়ে বেকার থাকাটাও অনেক স্বস্তির।

এবার মনিকার কথা বলব। সত্যজিতের সিনেমাগুলো তো বটেই, দুই বাংলার সিনেমাগুলোর মধ্যেও মনিকা আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি চরিত্র। সে যেন বাঙালির মানসকন্যা। করপোরেট ওয়ার্ল্ডের ডাকসাইটে চাকরিওয়ালা উঁচু মাইনে পাওয়া বিলাত ফেরত মিস্টার ব্যানার্জিকে ও মন থেকে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারে না। কীভাবে পারবে, ও যে চটকদার স্মার্ট। অত্যন্ত সুন্দরভাবে কথা বলে অপ্রয়োজনীয় ইংরেজিতে। এমন স্যুটেড বুটেড যে একটুও ভাঁজ পড়তে দেয় না পোশাকে। সে বিলেতে থাকাকালে তিন-চারটে ইংরেজ মেয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশা করে এসেছে সেটাও মনিকাকে জানায় অকপটে। সিগারেট ধরাতেও তার কী যে কেতাদুরস্ত ভঙ্গি। কৃত্রিমতার একটা ডেপো। মণীষা বাপের জন্য মুখের ওপর নাও করতে পারছে না যে এই গাড়লটাকে ও বিয়ে করতে চায় না। ভেতরে ভেতরে জর্জরিত হয়। ঠিক এ কারণেই মনিকা আমার প্রিয়, মনিকাকে আমার ভালো লাগে। আমি বাইশ বছর করপোরেট ওয়ার্ল্ডে চাকরির সুবাদে দেখেছি এবং এখনো ফেসবুকসহ নানান জায়গায় দেখছি, আজকের মেয়েরা প্রায় সবাই যেন ছুটে বেড়ায় নকলের পেছনে। চটকদার পোশাক, কায়দা করে দুলাইন ইংরেজি বলা আর লেটেস্ট ডিজাইনের মোবাইল বা ড্রেসআপ করা ভেড়ার পাল করপোরেট চাকরিজীবীই যেন এসব মেয়েদের প্রথম পছন্দ। ওদের হিরের টুকরো চেনার অন্তর্দৃষ্টি নেই। সে-কারণেই মনিকা নিশ্চিন্তির জীবন ছেড়ে যেন অশোকের প্রতিই খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ল। দেখুন না, কাঞ্চনজঙ্ঘার শেষের দিকে ওদের দুজনের কথোপকথনের কী হাল।

অশোক : আপনি কি আমার চাকরির ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত মনিকা দেবী? এসব ব্যাপার নিয়ে আপনাদের মাথা ঘামানো মানায় না। জামাকাপড়ের প্রবলেমস, আদবকায়দার প্রবলেমস, এই কখন কোন শাড়িটা পরবেন, তার সঙ্গে কোন জুতোটা ম্যাচ করবে, কখন সরি বলবেন, কখন থ্যাংকু বলবেন, কোন কাটা চামচ দিয়ে কখন কোন খাবারটা...

অশোকের এসব কথা শোনে মনিকা একটু বিরক্তই হয়েছিল, তারপর ওর মন ধীরে ধীরে গলতে থাকে যখন ছেলেটা মনিকার বাবার অফার করা চাকরিটা প্রত্যাখ্যান করার কথা জানিয়ে কেমন প্রগলভ হয়ে যায়, ‘চাকরিটা বোধ হয় নিয়ে নেওয়াই উচিত ছিল। তিনশো টাকার চাকরি! হঠাৎ কী যে হয়ে গেল! এই জায়গা বলেই বোধ হয়! কলকাতা হলে নির্ঘাত নিয়ে নিতাম। ভিক্ষা হোক আর যাই হোক। কিন্তু এখানে এরকম দৃশ্য তো দেখিনি এর আগে কখনো।

এই বিরাট হিমালয়, এই থমথমে ঝাউগাছ, এই রোদ এই মেঘ এই কুয়াশা- সব যেন অবাস্তব! স্বপ্নরাজ্যের মতো! মাথাটাথা কী রকম গোলমাল করে ফেলে! আমি যেন আর আমি নেই- একটা কেউকেটা, একটা হিরো, একটা জায়েন্ট, বেপরোয়া! কাউকে কেয়ার করি না! আচ্ছা, মনিকা দেবী, এরকম জায়গায় এলে সাহসটাহস বেড়ে যায়, না?’
আর সিনেমার শেষের দিকে তো আরো একটু স্পষ্ট হয়ে ওঠে সব। চলুন না আড়ি পেতে শোনা যাক ওদের সংলাপ।

মনিকা : কলকাতা গেলে আসবেন তো আমাদের বাড়িতে?
অশোক : না।
মনিকা : কেন?
অশোক : আমাকে ঢুকতেই দেবে না।
মনিকা : কে বলেছে?
অশোক : আপনার বাবা, বলেছেন যে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগবে।
মনিকা : আমার বন্ধুদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগে না। আসবেন তো?
অশোক : দেখি
মনিকা : আমাদের বাড়িতে কুকুর নেই কিন্তু
অশোক : ওহ্! তাহলে আসতে পারি। আমাকে একবার গড়ের মাঠে এক সাহেবের কুকুর কামড়ে দিয়েছিল। তারপর থেকেই-
মনিকা : আমার নাম মনিকা নয় কিন্তু
অশোক : তবে?
মনিকা : মণীষা
অশোক : আচ্ছা। মনে থাকবে।

দেখুন দেখি কাণ্ড! আমিও তো মণীষাকে মনিকা মনিকা বলে আসলাম বোধ হয়। এখন আর কারেকশন করতে ইচ্ছে করছে না। আপনারা মনিকাকে মণীষা হিসেবেই পড়বেন। আর আশা করি, মণীষাদের বাড়িতে কুকুর যেমন নেই, গুলশানের সেই শিল্পপতির বাড়িটার মতো সেরকম দারোয়ানও যেন না থাকে, কেননা অশোকের যে গাড়ি নেই, ওদের যে কোনো গাড়ি থাকে না।

 
Electronic Paper