ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মজিদ মাহমুদ যেভাবে পাঠকের হৃদয়ে

মারুফ ইসলাম
🕐 ১:০২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৯, ২০১৯

আর আমাদের স্বীকার না করে উপায় নেই, নাগরিক জীবন প্রতিদিনই ক্লান্ত হয়। সংসার তাকে ক্লান্ত করে। অফিস তাকে ক্লান্ত করে। তাকে ক্লান্ত করে ট্রাফিকের লাল আলো, রাস্তার ভিখিরি, মোড়ের মুদি দোকানি, ফুটপাতের চাওয়ালা। ছেলেটার স্কুলের বেতন, মেয়েটার লাল ফিতের বায়না, বউয়ের নিরীহ মুখ, বন্ধুর আহ্লাদি আবদারও তাকে কম ক্লান্ত করে না। তাকে ক্লান্ত করে যাপিতজীবনের সব আয়োজন। আর তাকে ক্লান্ত করে কোনো এক বিপন্ন বিস্ময়! অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করা ক্লান্তি নিয়ে এক একটা মানুষ তবে দিনশেষে কী চায়? সে চায় ‘দু’দণ্ড শান্তি। তাই দীর্ঘ দুরুহ দিনশেষে আমরা ফিরে যাই কবিতার কাছেই। কবিতা, সেই-ই তো আমাদের অনন্ত শান্তির আঁধার।

কবিতা আমাদের শান্তি দেয়। কবিতা আমাদের স্বস্তি দেয়। কবিতা আমাদের দু’দণ্ড ভুলিয়ে রাখে জীবনের কোলাহল। কবিতা আমাদের হাসায়, কাঁদায়, জাগায় এবং ভাসায়। তাই কিংবদন্তি কবি আবু জাফর ওয়ায়দুল্লাহ উচ্চারণ করেন, ‘যে কবিতা শুনতে জানে না/সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।’

এবার আসুন সবাই। যারা মজিদ মাহমুদের নাম শোনেননি এত দিন, তারা ঘন হয়ে বসুন। শুনুন যা কিছু সার্থক, যা কিছু অবিনশ্বর, যা কিছু কালোত্তীর্ণ তার শিকড় থাকে মাটির গভীরে প্রোথিত আর উন্নত শির থাকে উত্তোলিত আসমানে। কবি মজিদ মাহমুদের কবিতার শরীর ব্যবচ্ছেদ করুন, দেখতে পাবেন তার অঙ্গে অঙ্গে বাংলার ধুলোমাটিকাদা, বাংলার মিথ। তার কবিতার দর্শন আর অন্তর্গত বার্তা আমাদের শেখায় দিগন্তবিহারী হতে, চিন্তায়-জীবনাচরণে; এমন শিক্ষা দেয় কেবল আর একজন যার নাম আকাশ। উদাহরণ চান? এই নিন
আমার রক্তের মধ্যে দামোদর
আমার রক্তের মধ্যে মহিষ
মাগো তুই মহিষাসুর বধের মন্ত্র শেখা
আমি তোর কাছে যাবো।
[বল উপাখ্যান, বিদ্যাসাগরের মা ভগবতী দেবী]
দামোদর নদী, বিদ্যাসাগর, মহিষ শব্দগুলো কি আপনার শিকড়কে মনে করিয়ে দেয় না? আপনি যখন পড়েন ‘মাগো তুই মহিষাসুর বধের মন্ত্র শেখা’ তখন কি হৃদয়টা আকাশ স্পর্শ করে না? আপনি যখন পড়েন ‘আমি তোর কাছে যাবো’ তখন মায়ের কাছে ফেরার ব্যাকুলতায় আপনার অন্তরাত্মা কি আর্দ্র হয়ে ওঠে না, ক্ষণিকের জন্য?

এর নাম কমিউনিকেটিং ইন্টারঅ্যাকশন। পাঠক-লেখক আন্তঃসংযোগ। যে লেখক পাঠকের ভাবনার সঙ্গে নিজের লেখার সংযোগ ঘটাতে পারেন তার লেখাই পাঠক দিনের পর দিন মনে রাখে। রবীন্দ্র, নজরুল, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান প্রমুখ কবির কবিতা আজও পঠিত হয় ওই কমিউনিকেটিং ধর্মের কারণেই। মজিদ মাহমুদের কবিতাও আমরা মনে রাখি ঠিক এই কারণেই।

আরও একটা কারণ আছে বটে। মজিদ মাহমুদ আমাদের অন্তর দখল করে নিয়েছেন তার স্বকাল সচেতনতার জন্য। আগামী দিনের পাঠকের অন্তরও যে তিনি শাসন করবেন তা আগাম বলে দেওয়া যায়। কেননা, যে সূত্র মেনে জীবনানন্দ-সুধীন্দ্র-সুকান্ত-অমীয়-শক্তি-সুনীল আজও আমাদের পাঠক হৃদয়ে জাগরুক আছেন তা-তো ওই স্বকাল সচেতনতার জন্যই। কবি মজিদ মাহমুদের কবিতায় কীভাবে সমকাল ধরা পড়েছে দেখুন
বাগানের ভেতর শোভা পাচ্ছিল বসন্তের ফুল
গন্ধ ও রঙে আকৃষ্ট হয়ে উড়ে আসছিল মৌমাছি
আমারও ইচ্ছে খুব সে ফুলের সান্নিধ্যে যাবার
কিন্তু চারিদিকে শক্ত দেয়াল, ভেতরে নির্দয় মালি
[ব্যর্থতা : ভালোবাসা পরভাষা]
এই ‘চারদিকের শক্ত দেয়াল’ এবং ‘ভেতরের নির্দয় মালি’ই আমাদের স্বকাল, আমাদের বাস্তবতা। এই দেয়াল ও নির্দয়তা আমাদের সমাজের বুকে জগদ্দল পথে হয়ে বসে আছে দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী। সে বিভাজন তৈরি করেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই ‘বসন্তের ফুল’ তার নিজস্ব ‘গন্ধ ও রঙে আকৃষ্ট’ করে মৌমাছির মতো কবিকেও সৌন্দর্য উপভোগের আয়োজনে শামিল হওয়ার হাতছানি দিলেও কবির সেখানে প্রবেশানুমতি নেই। মজিদ মাহমুদ এভাবেই নিখুঁত শিল্পীর তুলির আঁচড়ে ফুটে তোলেন সমাজ বাস্তবতা।
মার্কিন কবি ভ্যালেরি বলেছেন, ‘কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি আসে স্বর্গ থেকে।’ অর্থাৎ কবিতা এমন একটি জ্ঞান যা আহরণ করতে হয় সাত আসমানের ওপার থেকে। কিন্তু মজিদ মাহমুদের বেলায় আমরা দেখতে পাই, এই আপ্তবাক্য খাটছে না। তিনি কবিতার জ্ঞান আহরণ করেন তার চারপাশ থেকেই। দেখুন তার কবিতার ভাষ্য
কবিতা এমন একটা জ্ঞান যা ফুটপাত থেকে কুড়িয়ে নিতে হয়
কাগজ কুড়ানো শিশুদের পলিথিনের ব্যাগের ভেতর ঘুরে ঘুরে
কবিতাগুলো আবার আমার হাতেই ফিরে আসে
[কবিতা ২, সিংহ ও গর্দভের কবিতা]
মজিদ মাহমুদকে তাই বলতেই হয় সময়ের সন্তান। তিনি এই সময়ের, এই সমাজের, এই দেশের। তার কবিতার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে আপনি দেখতে পাবেন, তার কবিতার শরীরজুড়ে কী নিবিড় মমতায় জড়াজড়ি করে আছে স্বদেশ, স্বকাল, স্বজাতি। তার কবিতার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে আপনি দেখতে পাবেন, ইতিহাস, মিথ, পুরাণ ও আধুনিকতা কীভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে নন্দনতত্ত্ব ছড়াচ্ছে। মজিদ মাহমুদের কবিতা আরও ছিঁড়েখুঁড়ে দেখতে চান? তবে নিবিষ্ট হয়ে বসুন সবাই। চোখের সামনে মেলে ধরুন মজিদের কবিতামালা
সুউচ্চ পর্বতের শিখর থেকে গড়িয়ে পড়ার আগে
তুমি পাদদেশে নদী বিছিয়ে দিয়েছিলে মাহফুজা
আজ সবাই শুনছে সেই জলপ্রপাতের শব্দ
নদীর তীর ঘেঁষে জেগে উঠছে অসংখ্য বসতি
ডিমের ভেতর থেকে চঞ্চুতে কষ্ট নিয়ে পাখি উড়ে যাচ্ছে
কিন্তু কেউ দেখছে না পানির নিচে বিছিয়ে দেয়া
তোমার কোমল করতল আমাকে মাছের মতো
ভাসিয়ে রেখেছে
[নদী, মাহফুজামঙ্গল]
কবিতা পাঠ শেষ। জানি, আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ভাসমান এক জীবন। এ জীবন আপনারই। কেননা আপনি আধুনিক মানুষ। একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে আপনি স্বীকার করতে বাধ্য, আপনার মনন সতত সঞ্চারণশীল মাছের মতো। খুব বেশি থিতু নয় কোনো একক বিষয়ের প্রতি। আপনি খানিকটা অস্থির, দ্বিধাগ্রস্ত, অবসাদে ম্রিয়মান কখনো কখনো। আপনার মনস্তত্ত্বে খেলা করে জটিল সব ভাবনা, আপনার ছুটে চলাই নিয়তি যেন। এসবই আধুনিক মানুষ, আধুনিক সমাজের বৈশিষ্ট্য।
বলা হয়, আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যকে উপজীব্য করে লেখালেখির শুরু মূলত উনিশ শতকে, ফ্রানজ কাফকার হাত ধরে। মেটামরফোসিস নামক একটা গল্প লিখে তিনি বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দিলেন। সেই গল্পে ফুটে উঠল হতাশা, বিষণ্নতা, অবসাদ, স্বার্থপরতা, সম্পর্কের জ্যামিতিক বিশ্লেষণ ও যাপন করা জীবনের বহুবিধ সংগ্রাম। এক অদ্ভুত শৈল্পিক বর্ণনায় কাফকা যে জীবনের গল্প বলে গেছেন তা পাঠ করতে করতে পাঠক ঘোরগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কারণ সরলরৈখিক পথে গল্প বলেন না কাফকা, নানান পথ ঘুরে এগিয়ে নিয়ে যান গল্পের কাহিনী। ফলে পাঠক বুঝে উঠতে পারেন না কোথাকার কাহিনী কোথায় যাচ্ছে। এক অদ্ভুত রহস্যময়তার জাদুজালে আটকা পড়ে থাকেন পাঠক। ফলে গল্প শেষ না করে উঠতেও পারেন না। শিল্পসমালোচকরা বললেন, এটি একটি উত্তরাধুনিক গল্প। আপনি যখন মজিদ মাহমুদের কবিতা পড়বেন তখন আপনার ভেতরও এক ধরনের ঘোরলাগা বিপন্নতা বোধ কাজ করবে। কী বলতে চাইছেন কবি তা বোঝার আগেই শেষ হয়ে যাবে কবিতাখানি। আপনি আবার প্রথম থেকে শুরু করবেন কবিতাপাঠ। অতঃপর আপনি আবিষ্কার করবেন, আপাত সরল মনে হলেও সরলরৈখিক পথে হাঁটে না মজিদের কবিতা। আপনি আরও আবিষ্কার করবেন, আধুনিক জীবনের দ্বিধা-দ্বন্ধ তার কবিতায় উপস্থিত
মাঝে মাঝে মনে হয় মরে যাওয়া ভালো/ মাঝে মাঝে মনে হয় বেঁচে থাকি। [স্বজন, সিংহ ও গর্দভের কবিতা]
এসব দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে আপনার নিজের বলে মনে হবে। কবিতাগুলোকে মনে হবে আপনার খুব আপন। আপনি সারা দিনের ক্লান্তি শেষে দু’দণ্ড শান্তির খোঁজে মাঝে মাঝেই আশ্রয় চাইবেন মজিদ মাহমুদের কবিতার কাছে। সেখানেও আবিষ্কার করবেন আপনারই মতো হতাশাবাদী উত্তরাধুনিক মানুষ
অথচ সুখ ও দুঃখ, কর্তনের বেদনা
কেবল আমার
আমি কি নিজের জন্য মরতেও পারব না?
[দাস, সিংহ ও গর্দভের কবিতা]
মনে হবে, এই তো হৃদয়ের কথা। এই তো একান্ত আপনার কথা। এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে উঠবে আপনার মন। আপনি অবশ্য টের পাবেন না, এরই মধ্যে মজিদ মাহমুদ আপনার অন্তরের সিংহাসন দখল করে ফেলবেন!

 

 
Electronic Paper