এক উর্বরতার উৎসব
শিমুল জাবালি
🕐 ২:১৮ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১২, ২০১৯
মেলা বাংলাদেশের লৌকিক ও জনপ্রিয় উৎসব। এ দেশে মেলার উৎপত্তি হয়েছে মূলত গ্রাম-সংস্কৃতি থেকে। গবেষকদের মতে, বাংলায় নানান ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠান ও উৎসবের সূত্র ধরেই মেলার উৎপত্তি। সেদিক দিয়ে এ দেশের মেলার প্রাচীনত্ব হাজার বছরেরও অধিক। এ দেশের প্রাচীন পর্যায়ের উৎসব ও কৃত্যানুষ্ঠানকেন্দ্রিক মেলাগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে জীবন ধারণের আহার্য কৃষিশস্য এবং বিশেষ করে কৃষির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত রোদ ও বৃষ্টির কথা।
বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকো উৎসব চড়ক পূজা। চৈত্রের শেষ দিন এ পূজা অনুষ্ঠিত হয় কিন্তু প্রস্তুতি চলে এক মাস আগে থেকে। সমাজের উচ্চ স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন নয়। তবে পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এ উৎসব প্রচলিত ছিল। ভূমিকেন্দ্রিক সভ্যতার এই দেশে উর্বরতাও প্রার্থনাস্বরূপ এ পূজার উৎপত্তি বলে উল্লেখ আছে। উর্বরতা শুধু জমিতে নয়, ঘরেও। যেজন্য চড়কের গাছ যে আঙ্গিকে পোঁতা হয় তা পুরুষাঙ্গের আকৃতি বলেই ধরা হয়। এ জন্য চড়ক গাছ যেদিন পুকুর থেকে ওঠানো হয় সেদিন যেসব নারীর সন্তান হয় না তাদের ওই পুকুরে স্নান করানো হয় সন্তান হওয়ার প্রত্যাশায়। চড়ক ঘোরার বিষয়টি চান্দ্র মাসের পরিচয় বহন করে।
আধি পুরাণে বর্ণিত আছে, রাজা দক্ষের এক কন্যা ছিল চিত্রা। চিত্রার নামানুসারে এক নক্ষত্রের নাম করা হয় চিত্রা। চিত্রা নক্ষত্র থেকে চৈত্র মাসের নামকরণ। তাই হিন্দুধর্মে চৈত্রের আছে বিশেষ স্থান। চৈত্র মাসের শেষ দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে বসে বিধাতাকে তুষ্ট করার নানা আয়োজন। এর মধ্যে সবচেয়ে অভিনব ও প্রাচীন আয়োজন চড়ক পূজা, সেই সঙ্গে মেলা। চড়ক পূজার ১০-১২ দিন আগে থেকে বিভিন্ন এলাকার পূজারিদের মধ্যে ৪০-৫০ জন সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব-গৌরীসহ নৃত্যগীত করে মাগন করেন। চড়ক পূজা পর্যন্ত তারা পবিত্রতার সঙ্গে সন্ন্যাসব্রত পালন করে ও আমিষ খাদ্য গ্রহণ করে না। সারা দিন উপবাস পালন করে। চড়ক পূজার ২ দিন আগে থেকে পূজারিরা শ্মশানে গিয়ে পূজা-অর্চনা করে ও শেষে গৌরীর বিয়ে, গৌরী নাচ ও বিভিন্ন গান গেয়ে ঢাকের বাজনায় সরগরম করে গোটা এলাকা প্রদক্ষিণ করে। চৈত্র মাসের শেষ দিন পূজারিরা পূজা করে পান বাটা দিয়ে চড়ক গাছকে নিমন্ত্রণ জানায়। অর্থাৎ দিঘি বা পুকুর থেকে চড়কগাছ তুলে আনা হয়। তারপর মাঠে গাছ পুঁতে দেওয়া হয়। গাছের চূড়া থেকে প্রায় কোমর পর্যন্ত আড়াআড়ি চারটি পাখার মতো করে বাঁধা হয় চারটি মোটা বাঁশ এবং তাতে যুক্ত করা হয় মোটা-লম্বা রশি। এ সময় শিব ও কালীর নৃত্য দেখানো হয়। নৃত্য শেষে ওই পুকুর বা দিঘিতে স্নান করে সন্ন্যাসীদের জিহবা ও নাকে গহনা গেঁথে দেওয়া হয়। নৃত্যের তালে তালে চড়কগাছ ঘোরানো হয়। দেবতার পূজা-অর্চনা শেষে অপরাহ্নে মূল সন্ন্যাসী চারজনের (কখনো এক বা দুই) পিঠে লোহার দুটি বড়শি গেঁথে রশিতে বেঁধে চড়ক গাছে ঝুলিয়ে ঘোরানো হয়।
চড়ক পূজা মূলত নীল পূজা নামেই পরিচিত। গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়ক পূজারই রকমফের। চড়ক পূজা চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিবসে পালিত হয়। পতিত ব্রাহ্মণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পূজার বিশেষ অনুষঙ্গ হলো পাট পূজা বা শিবের পূজা।
একখানা সজ্জিত কাঠ তাতে লালসালু প্যাঁচানো। সিঁদুরে মাখানো মাথার দিকটা। এই পাট একজন মাথায় নেয় আর বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এই পাটের সামনে কোনো গর্ভবতী মহিলা পড়লে তার বিপদের আশঙ্কা থাকে বলে মনে করা হয়। এসব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ। পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়।
তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো লোহার শলাকা তার জিভে ফুঁড়ে দেওয়া হয়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো তা প্রচলিত আছে। আধুনিকতার অভিঘাতে ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর চারিত্রিক পরিবর্তন হচ্ছে। তারপরও মেলা শ্রেণিহীন উৎসব। এর কোনো বিকল্প নেই।