ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বলতে যা বুঝব

মজিদ মাহমুদ
🕐 ১২:৪৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ২২, ২০১৯

বৃহত্তর অর্থে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এ ভূখণ্ডের মানুষের টিকে থাকার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে উদ্ভূত। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের আগে হাজার বছরের বাঙালি জীবনে বাঙালির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাঙালিরা নিজেদের শাসন করেনি। অবশ্য এ অঞ্চলের সব ভাষাগোষ্ঠীর জন্য একথা সত্য। তবু বাংলা ভাষা বিকাশের জন্য রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব হয়নি। কিন্তু চর্যাগীতির মাধ্যমে বাঙালির জীবনপাতের যে সূচনা হয়েছিল অচিরেই তা হারিয়ে যায়। এই হারিয়ে যাওয়া কারণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে এ ভাষার জন্ম ও টিকে থাকার লড়াইয়ের ইতিহাস। যদিও চর্যার পদগুলো বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধন ভজনের মন্ত্র হিসেবে রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়; তবু বৌদ্ধ ধর্ম দেব-দেবী কিংবা ঈশ্বরনির্ভর না হওয়ায় সমকালীন মানুষই এখানে প্রধান কুশীলব হিসেবে উঠে এসেছে।

বাংলা কবিতার যে পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের কবিতাকে তার সঙ্গে নিঃসন্দেহে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। কবি সর্বদা অন্যায় অত্যাচার-জুলুমের বিরুদ্ধে কবিতা রচনা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের যে সশস্ত্র সংগ্রাম তার সঙ্গে হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না।

হাজার বছর ধরে বাংলাভাষী জনগণ তাদের ভাষার দ্বারা তাদের অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম চালিয়ে আসছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। এখন প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বলতে আমরা কোন কবিতাকে বোঝাবো? চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধের কবিতা রচনার প্রথম পর্বের সূচনা ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে। ১৯৭১ সালের চূড়ান্ত স্বাধীনতার আগে যা থামেনি। ভাষার পক্ষে স্বাধীনতার পক্ষে পুরো সময় সোচ্চার ছিলেন শামসুর রাহমান (১৯২৯-১৯০৬)। নান্দনিক কবিতা কর্মের পাশাপাশি সমসাময়িক ঘটনাকে কবিতা করে তোলার যার ছিল অসম্ভব ক্ষমতা।

স্বাধীনতা-পরবর্তী তার টেলেমেকাস, আসাদের শার্ট প্রভৃতি কবিতা মুক্তিকামী মধ্যবিত্তের ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া এ সময়ে সিকান্দার আবু জাফরের সংগ্রাম চলবেই, বাংলা ছাড়, যে কোনো মূল্যে, সৈয়দ আলী আহসানের আমার পূর্ববাংলা, আল মাহমুদের সোনালি কাবিনসহ লোকজ জীবন আবৃত তার স্মৃতিবিধুর দেশাত্মবোধের কবিতা মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা বেগবান করে তোলে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গাওয়া ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির শোকময় সুর ও বাণী দেশের মাটি মানুষের প্রতি ভালোবাসার আবেগকে আরও ঘনীভূত করে। তা ছাড়া পাকিস্তান শাসকদের বাংলা ও বাঙালিকে হিন্দুর সমার্থক বিবেচনা করা, হিন্দু বলে সরকারি প্রচার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধকরণ, আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব কবি সাহিত্যিকদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরও সরব করে তোলে। বাঙালি মুসলমানদের রক্ষাকল্পে পাকিস্তানি শাসকদের এসব প্রকল্প উদার ও সংস্কৃতিমনা নাগরিকদের পহেলা বৈশাখ পালন, মেয়েদের কপালে টিপ, পোশাক-আশাকে বাঙালিয়ানার ছাপ এবং রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে আরও উৎসাহী করে তোলে।

উপরোক্ত বিস্তৃত পটভূমিকায় বাংলা কবিতার সংগ্রামশীলতার যে পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের কবিতাকে তার সঙ্গে নিঃসন্দেহে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। কবি সর্বদা অন্যায় অত্যাচার জুলুমের বিরুদ্ধে কবিতা রচনা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের যে সশস্ত্র সংগ্রাম তার সঙ্গে হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। হাজার বছর ধরে বাংলাভাষী জনগণ তাদের ভাষার দ্বারা তাদের অধিকার আদায়ের যে সংগ্রাম চালিয়ে আসছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। এখন প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বলতে আমরা কোন কবিতাকে বোঝাবো? নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখিত সব কবিতাই মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখা কবিতা যেমন মুক্তিযুদ্ধের কবিতা তেমন যে কোনো ন্যায় আন্দোলনকে সমর্থন করে লেখা কবিতাও মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। শাসক যেই হোক তাদের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় শাসনতান্ত্রিক আবদারের বিরুদ্ধে রচিত কবিতাও মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। হয়তো এমনও অস্বাভাবিক নয়, মুক্তিযুদ্ধের শিল্পোত্তীর্ণ কবিতাগুলো রচনার জন্য ভবিষ্যতের কবি অপেক্ষা করছে। কিন্তু একটি কথা আমাদের মনে রাখা দরকার, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেসব কবি মুক্তিযুদ্ধের কবিতা রচনা করেছে তাদের পঙ্ক্তিতে কি আর কেউ বসার সুযোগ পাবেন? কারণ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কবিতার রচয়িতা কেবল কবিই নন একজন মুক্তিযোদ্ধাও বটে। মুক্তিযোদ্ধা কবির মুক্তিযুদ্ধের কবিতার মূল্য ইতিহাসের সততার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

কিন্তু ইতিহাস সৃষ্টিকারী ওই নয় মাস কি নান্দনিক কবিতা লেখার পক্ষে ছিল? কবি আর মুক্তিযোদ্ধা তো সমার্থক নন। একজন শক্তিমান কবি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিয়েও মুক্তিযুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো লিখতে পারেন। তার উদাহরণ অবশ্য আমাদের সাহিত্যেও বিরল নয়। তবে আমাদের সৌভাগ্য অধিকাংশ সামর্থ্যবান কবিই সেদিন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তারা ছিলেন আগে মুক্তিযোদ্ধা পরে কবি। একথা সত্য যারা শিকারে যায় আর যারা শিকারির জন্য অপেক্ষা করে তাদের অভিজ্ঞতা এক নয়। অপেক্ষমাণদের কল্পনার সুযোগ বেশি। কবি তো জীবনের গান গাইবেনই। সে সময়ে লেখা জসীমউদ্দীনের (১৯০২-১৯৭৬) ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, মৃত্যু পিছনে আগে,/ভয়াল বিশাল নখর মেলিয়া দিবস রজনী জাগে।/কখনো সে ধরে রেজাকার বেশ, কখনো সে খান-সেনা,/কখনো সে ধরে ধর্ম লেবাস পশ্চিম হতে কেনা।

তা ছাড়া ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে কবির লিখিত বেশ কিছু কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাক-পরিবেশ ফুটে উঠেছে। যেমন গীতারা চলিয়া যাবে, গীতারা কোথায় যাবে, গীতারা কোথায় গেল, দগ্ধগ্রাম প্রভৃতি কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল পরিবেশ ফুটে উঠেছে। আবুল হোসেন ‘পুত্রদের প্রতি’ আহসান হাবীব ‘আমার সন্তান’ কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের অনির্বাণ আহ্বান ও মৃত্যুর গৌরব প্রকীর্ণ করেছেন শব্দে। শামসুর রাহমানের ‘নিজ বাসভূমে’, ‘নিরালোকে দিব্যরথ’, ‘বন্দি শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে নিয়ে অনেক কবিতা রয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য কবিতার মধ্যে তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, গেরিলা, তুমি বলেছিলে, এখানে দরোজা ছিল প্রভৃতি। তবে একথা সত্য, শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বাধীনতার তীব্রতর আকাক্সক্ষা ব্যক্ত হলেও যুদ্ধকালে বারুদের গন্ধ টের পাওয়া যায় না। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার চেয়ে তার কবিতায় স্বাধীনতার গৌরব ও আকাক্সক্ষার তীব্রতর রূপ প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা গভীরভাবে প্রকীর্ণ হয়ে আছে তার কবিতায়। এ সময়ে লিখিত আল মাহমুদের ক্যামোফ্লাজ কবিতাটি এখানে স্মরণযোগ্য জেনো, শত্রুরাও পরে আছে সবুজ কামিজ/শিরস্ত্রাণে লতাপাতা, কামানের ওপরে পল্লব/ঢেকে রাখে/নখ/দাঁত/লিঙ্গ/হিংসা/ বন্দুকের নল/হয়ে গেছে নিরাসক্ত বিষকাঁটালির ছোট ঝোপ।

সাদা কাগজ আর শত্রুর বিরুদ্ধে তারা একই সঙ্গে কলম আর বন্দুক ধারণ করেছিলেন। বুকের রক্ত আর কলমের কালি তাদের কাছে সমার্থক ছিল। তারা ছিলেন ন্যায়সংগত সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের সন্তান। দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা আর তারুণ্যের তরতাজা আগুন তাদের কবিতাকে দিয়েছিল একই সঙ্গে দ্রোহ ও টিকে থাকার ক্ষমতা। নান্দনিক বিচারে যা ছিল তাদের কবিতার দুর্বল দিক তা-ই কালের বিচারে কালোত্তীর্ণ বিষয় সৌন্দর্য নিয়ে টিকে থাকবে বহুকাল। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা বাংলা কবিতায় নিঃসন্দেহে একটি বাক ও বিপ্লব। যে কোনো সময়ের কবিতা থেকে তা আলাদা করে চেনা যায়। যুদ্ধের ভয়াবহতা, জীবন-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা, রণাঙ্গনের চিত্র, তৎকালীন ব্যবহার্য মারণাস্ত্র এই সময়ের কবিতার অঙ্গ গঠনে সহায়ক হয়ে ওঠে। এ সময়ের শব্দ ও বাকপ্রতিমা, উপমা ও উৎপেক্ষা, ছন্দ ও ছন্দপতন বাংলা কবিতাকে এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

 
Electronic Paper