ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আহমদ শরীফ সম্পর্কে

নেহাল করিম
🕐 ১২:০৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৫, ২০১৯

ড. আহমদ শরীফ সম্পর্কে তার প্রিয় ছাত্র ও সহকর্মী প্রখ্যাত প্রথাবিরোধী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘একটি শব্দ ধ্রুবপদের মতো ফিরে ফিরে তার সম্পর্কে ব্যবহার করেন পরিচিত ও অন্তরঙ্গরা। শব্দটি ছোট কিন্তু তার অর্থ-আয়তন অভিধানের বড় বড় শব্দের থেকে অনেক ব্যাপক। শব্দটি ‘অনন্য’। তারা বলেন, ডক্টর আহমদ শরীফ অনন্য। এমন আর নেই, আর পাওয়া যাবে না পলিমাটির এই ছোট ব-দ্বীপে। দ্বিতীয় নেই, তৃতীয় নেই, চতুর্থ নেই তার।’

বাংলাদেশে সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে ড. আহমদ শরীফই সম্ভবত একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সবার কাছে প্রিয় হওয়ার দুর্বলতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পণ্ডিত ও বয়স্ক বিদ্রোহী ড. আহমদ শরীফ চট্টগ্রামের পটিয়ার সুচক্রদন্তী গ্রামে ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২১ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সালে ঢাকায় প্রয়াত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ও ১৯৬৭ সালে পিএইচডি অর্জন করেছিলেন। কলেজে অধ্যাপনার (১৯৪৫-৪৯) মধ্য দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু।

পরে এক বছরের কিছু বেশি সময় রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সহকারী হিসেবে থাকার পর ১৯৫০-এর শেষদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। একটানা ৩৪ বছর অধ্যাপনা করে ১৯৮৩ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে তিনি বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানসহ সিন্ডিকেট সদস্য, সিনেট সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি, শিক্ষকদের ক্লাবের সভাপতি ও কলা অনুষদের চারবার নির্বাচিত ডিন ছিলেন। সেই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অন্যতম রূপকার ছিলেন।

পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম কাজী নজরুল ইসলাম অধ্যাপক পদে ১৯৮৪-৮৬ পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার প্রাগ্রসর এবং মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাসের বিদগ্ধ প-িত ড. আহমদ শরীফ একগুচ্ছ অসামান্য তীব্র বৈশিষ্ট্যসংবলিত একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। একথা অকপটে বলা যায়, বাংলাদেশের সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে ড. আহমদ শরীফ একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, যাকে উপেক্ষা করা যায়, তবে কোনো অবস্থাতেই তার বিশাল কীর্তি অস্বীকার করা যায় না। নিজস্ব দর্শন-চিন্তা ও বিশেষত্বের কারণে বোদ্ধা সমাজের কাছে ছিলেন বহুল আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত এবং তার মৃত্যুর পরেও এ ধারা বহমান। তবে অপ্রিয় হলেও সত্যি, বাংলাদেশের মতো একটি অনুন্নত দেশের আর্থসামাজিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে এখানে লেখাপড়া জানা মানুষের মাঝে না-পড়া, না-জানার প্রবণতা গড়ে উঠেছে। তাই কেউ নিজে থেকে কোনো বইয়ের বা পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে দেখার গরজ অনুভব করে না। আবার যে কোনো মানুষ বা কোনো বিষয়কে সমাজে পরিচিত করতে প্রচার হচ্ছে সবচেয়ে বড় মাধ্যম। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় পর্যায়ের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদিতে বা বিভিন্ন জাতীয় পর্ষদগুলোয় কিংবা জাতীয় প্রচার মাধ্যমে আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোয় ঘুরে-ফিরে যারা সবসময় অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে থাকেন, তারাই কেবল দেশের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি লাভ করে থাকেন। সরকারি বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের রচনাশৈলী যা-ই হোক না কেন, তার গুণগত মান প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে সঠিক মূল্যায়ন শুধু বর্তমান ও ভবিষ্যতের গবেষকরাই করতে পারবেন।

বাংলাদেশে ড. আহমদ শরীফের মতো হাতেগোনা চার থেকে পাঁচজন লিখিয়ে পাওয়া যাবে, যারা কোনো সময়ই সরকারি বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বেড়াজালে নিজেদের জড়াননি। তাই তারা মননশীল লেখক হিসেবে বা তাদের চিন্তাসমৃদ্ধ গ্রন্থগুলো লেখাপড়া জানা মানুষের কাছে অদ্যাবধি অজ্ঞাত ও অপঠিত থেকে গেছে। তিনি পঞ্চাশের দশক থেকে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেছিলেন এবং তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলমান ছিল। তার রচিত মৌলিক রচনাসংবলিত গ্রন্থের সংখ্যা ৪৫, যার মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৩ হাজার ৮৪৪ অর্থাৎ ছাপাকৃত প্রতি পৃষ্ঠাকে হাতের লেখায় আড়াই পৃষ্ঠা করে ধরলে তাতে ৩৪ হাজার ৬১২ পৃষ্ঠা হয়। উল্লেখ্য, এ সংখ্যা শুধু মৌলিক রচনার হিসাব এবং সম্পাদিত মৌলিক গবেষণার ওপর গ্রন্থগুলোর পৃষ্ঠা সংখ্যা সবমিলিয়ে লাখের অধিক হবে। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, অদ্যাবধি বাংলাদেশে মৌলিক গবেষণার সংখ্যা হিসাবে ড. আহমদ শরীফের থেকে বেশি কাজ আর কারোর নেই।

দেশ-কাল-সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রথাগত সংস্কার পরিবর্তনের লক্ষ্যে সবসময় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। মানুষের আর্থসামাজিক মুক্তিসহ সমাজতন্ত্রের প্রতি ছিল তার প্রচ- আস্থা ও আগ্রহ। ভাববাদ, মানবতাবাদ ও মার্ক্সবাদের যৌগিক সমন্বয় প্রতিফলিত হয়েছিল তার চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণে, বক্তব্যে ও লেখনীতে। তার রচিত শতাধিক গ্রন্থের প্রবন্ধে তিনি অত্যন্ত জোরালো যুক্তি দিয়ে পরিত্যাগ করেছিলেন প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা, বিশ্বাস ও সংস্কার এবং আন্তরিকভাবে আশা করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য। আগেই উল্লেখ করেছি, পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ পর্যন্ত সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন, ইতিহাসসহ প্রায় সব বিষয়ে তিনি অজস্র লিখেছেন। দ্রোহী সমাজ পরিবর্তনকামীদের কাছে তার পুস্তকারাশির জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়, তার রচিত পুস্তকারাশির মধ্যে দুখ রচিত ‘বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য’ তার অসামান্য কীর্তি। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, পিতৃব্য আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অনুপ্রেরণায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও সমাজ সম্পর্কে পাহাড়সম গবেষণাকর্ম তাকে ‘কিংবদন্তি পণ্ডিত’-এ পরিণত করেছে। উভয় বঙ্গে এ বিষয়ে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় এবং অদ্যাবধি স্থানটি শূন্য রয়ে গেছে। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করে তিনি মধ্যযুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনা করে গেছেন। বিশ্লেষণাত্মক তথ্য-তত্ত্ব ও যুক্তিসমৃদ্ধ দীর্ঘ ভূমিকার মাধ্যমে তিনি মধ্যযুগের সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাস বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে দিয়ে গেছেন।

জীবিতকালে বেশকিছু পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তার মধ্যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকসহ পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ‘ডি-লিট’ ডিগ্রি পেয়েছিলেন। তার লেখনীর মধ্যে যেমন মানুষের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তির কথা রয়েছে তেমনি তৎকালীন পাকিস্তানের বেড়াজাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তির লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতা তাত্ত্বিক সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ১৯৬২ সালে গঠিত ‘নিউক্লিয়াস’ (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ)-এর সঙ্গেও তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ১৯৬৩ সালে গঠিত অপূর্ব সংসদের (অস্থায়ী পূর্ব বাংলা সরকার) এবং তৃতীয় চূড়ান্ত ইশতেহার, যা ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ‘ইতিহাসের ধারায় বাঙালী’ প্রবন্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাঙলাদেশ’ এবং ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটির কথা উল্লেখ ছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি দেশের সব সংকটময় মুহূর্তে কখনো এককভাবে কখনো সম্মিলিতভাবে তা প্রশমনের জন্য জনতার কাতারে যুক্ত হয়েছিলেন। অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ পর্যায়ের উত্তাল দিনগুলোয় অন্য পেশাজীবীদের মতো লেখক, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রতিবাদ সভাগুলোয় তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালের ৫ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, কলাকুশলী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের বিক্ষোভ সমাবেশে সবাইকে তিনি শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন।

সবাই তার নেতৃত্বে হাত তুলে শপথ নেন ‘আমরা পূর্ব বাংলার সার্বিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম মৃত্যুর বিনিময় হলেও চালিয়ে যাব। সংগ্রামী জনগণকে আমরা প্রেরণা জাগাব লেখনীর মাধ্যমে, আমাদের লেখনী হবে সংগ্রামের সাফল্যের জন্য বুলেট- বেয়নেট, অতীতের সব মতানৈক্য ভুলে জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমরা এগিয়ে যাব সংগ্রামের সাফল্যের দিকে।’ স্বাধীনতার পর জরুরি অবস্থা ঘোষণার সময় গঠন করেছিলেন মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি। প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তৎকালীন একদলীয় রাজনৈতিক দল গঠনের বিরুদ্ধে। ১৯৭৬-এ সামরিক শাসনের ভেতর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ‘একুশ’ উদযাপন জাতীয় কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান ও ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করার জন্য ১৯৮১ সালে গঠন করেছিলেন সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটি।

উভয় বঙ্গের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অসামান্য পণ্ডিত, বিদ্রোহী, অসাম্প্রদায়িক, যুক্তিবাদী, দার্শনিক, বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব, প্রগতিশীল, মানবতাবাদী, মুক্তবুদ্ধি ও নির্মোহ চিন্তার ধারক ড. আহমদ শরীফকে ধর্মান্ধরা শাস্ত্র ও প্রথা বিরোধিতার কারণে ‘মুরতাদ’ আখ্যায়িত করেছিল। কথা ও কর্মে অবিচল, অটল, দৃঢ় মনোভাবের নাস্তিক সব রকমের প্রথা-সংস্কার শৃঙ্খল ছিন্ন করে ১৯৯৫ সালে লিপিবদ্ধ করা ‘অসিয়তনামা’র মাধ্যমে মরণোত্তর চক্ষু ও দেহ দান করে গেছেন। অসিয়তনামায় উল্লেখ ছিল, ‘চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণ প্রতীক। কাজেই গোটা অঙ্গ কবরের কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগানোই তো বাঞ্ছনীয়।’

 
Electronic Paper