ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

গল্প

একটি অনুতাপের গল্প

শিবশঙ্কর পাল
🕐 ১২:০৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ০৮, ২০১৯

ঢাকাই ছবিতে তখন দৈত্যাকৃতি দেহের জন্য ভিলেন ‘জাম্বু’র খুব নামডাক। প্রায় ছবিতেই জাম্বু প্রধান ভিলেনের সহকারী, চকচকে ন্যাড়া মাথা, মোটা শরীর নিয়ে বিভিন্ন রকম স্টাইলে ফাইট করে, ভারী গলায় ভয়ঙ্করভাবে ডায়লগ বলে। ভিলেন চরিত্রের হলেও সিনামায় তার ক্যারিশম্যাটিক অভিনয়ের জন্য নায়ক-নায়িকার পাশাপাশি তখন আমরা তাকে খুব পছন্দও করতাম। তখন আমাদের কিশোরকাল। আর সেই রকম ভিলেন-অভিনেতা জাম্বুর মতো প্রায় মোটাসোটা দেহের কারণেই হয়তো আমাদের পাড়ায় চেয়ারম্যানের প্রতিবেশী ছেলেটার নামও ‘জাম্বু’- সবাই ডাকে। তার আসল নামটা ছোটকালে স্কুলে হয়তো শুনেছিলাম, এখন আর মনে নেই। ও প্রায় আমাদের বয়সীই হবে, প্রাইমারি স্কুলে আমাদের সঙ্গেই পড়ত। জাম্বুর রিকশাতেই বাড়ি ফিরছি আজ। 

রিকশা চলছে আরাম-আয়েশে, অথচ আমাদের ‘জাম্বু’র যা স্বাস্থ্য তাতে এই প্যাকাটিমার্কা রিকশাটাকে ও উড়িয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম। কিন্তু ও বেশ আরাম-আয়েশ করে যেন রিকশা চালাচ্ছে, এবং তাতে আমারও তেমন একটা অভিযোগ নেই ওর প্রতি-যাচ্ছে যাক না! শহরের কোলাহল পেরিয়ে ঝিঁ ঝিঁ ডাকা প্রায় নির্জন রাস্তায় ঢুকেছে রিকশা, দু’একটা রিকশা হুস-হাস বেরিয়ে যাচ্ছে আর বাড়ি ফেরত পথচারীদের পায়ের খস খস আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে শুধু। জাম্বু দু’একবার কথা বলে আমার সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করলে আমার নীরবতায় সে দমে যায়। আমি জাম্বুর রিকশার সিটে বসেই জাম্বুকে নিয়ে একটু কৈশোরে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম- সেই কবে ছেঁড়া লুচির মতো বই-খাতাগুলো বাম হাত দিয়ে প্যান্টের সঙ্গে চেপে ধরে ডান হাতের তালু দিয়ে নাকের সবুজ রঙের তরল সর্দি পাছায় প্যান্টের ওপর মুছতে মুছতে তখন সে প্রাইমারি স্কুলে যেত। জাম্বুর বাবাকে কোনোদিন দেখিনি, মারা গেছে কী তাদের ফেলে রেখে চলে গেছে- এরকম কিছু একটা শুনেছিলাম ছোটকালেই। ওর মা আর এক বড় বোন ছিল সংসারে, দুজনকেই দেখেছি হাটে হাটে গরুর গোবর কুড়িয়ে দইলা বানিয়ে বেচতে। তা দিয়েই বোধকরি ওদের সংসার চলত। 

জাম্বুদের বাড়ির পাশ দিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় দু’একদিন ওর সঙ্গে দেখা হলে ওর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা আমরা শুনতাম আর ওর সঙ্গে স্কুলের পথে হাঁটতাম। পাকা রাস্তায় চলা ট্রাক দেখিয়ে বলত সে ট্রাকের ড্রাইভার হবে। ট্রাকের ড্রাইভাররা কত উঁচুতে বসে কী আরামে গাড়ি চালায়! ঠোঁটে কী সুন্দর করে সিগারেট ধরে ফুঁক ফুঁক করে ধোঁয়া ছাড়ে! সে-দৃশ্য বার কতক দেখে সে মনস্থির করেছিল, বড় হয়ে সে ড্রাইভারই হবে। ...তারপর এক সময় স্কুলে পৌঁছে গেলে ক্লাশে ঢুকে যখন পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা মাথা আঁচড়ানো সুন্দর চুলের হিন্দু স্যারটাকে দেখত তখন সে মনে মনে ভাবত বড় হয়ে সে মাস্টারই হবে। কিন্তু ক্লাশে স্যার যখন তার বইপত্র দেখে বলত, কীরে তোর বইয়ের অবস্থা তো খুব খারাপ রে! একেবারে লুচি বানায় ফেলেছিস দেখছি! বাড়িতে মা খেতে দেয়নি নাকি রে? স্যারের কথায় ক্লাশের সবাই যখন হোঁ হোঁ করে হেসে উঠত তখন তার মাস্টার হওয়ার ইচ্ছাটাও বোধহয় মাথা থেকে হারিয়ে যেত। স্কুল ছুটি হলেই সে কথা বিরক্তসহকারে বলতে সে আমাদের ভুলত না। কিংবা, বিকালবেলা স্কুল-মাঠে খেলতে যাওয়ার সময় যখন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহেবকে তার বাড়ির আঙিনায় ফাঁকা জায়গায় চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যেত, আর চেয়ারম্যানের ছোট বউ মানে চার নম্বর বউটাকে দেখা যেত চেয়ারম্যানের পায়ে চকচকে কালো পালিশ করা জুতা জোড়া ঢুকিয়ে দিতে। তখন সে তা দেখে দেখে ভাবত তার পক্ষে চেয়ারম্যান ভিন্ন অন্য কোনো কিছু হওয়া সম্ভবপর নয়! এরকম আরও আরও কত স্বপ্ন যে তার জীবনে এসেছে আর গেছে আর আমাদের জানিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অবশ্য এগুলোর কোনোটিই শেষ পর্যন্ত তার জীবনে ধরা দেয়নি আজ পর্যন্ত। বলা যায়, তার ধারের কাছেই ঘেষতে পারেনি।

রাস্তায় থেমে থাকা ট্রাকের পেছনের ডালা ধরে দু’একবার ঝুল পেরে দেখলেও ট্রাকের ড্রাইভার দূরে থাকুক হেলপারই হতে পারেনি সে। বারবার একই ক্লাশে ফেল করতে করতে স্যারদের দয়ায় কোনোমতে থ্রিতে উঠতে পারলেও ক্লাশ ফোরে স্যারেরা তুলে দেয়নি তাকে কোনোদিনই এবং পড়ালেখার সেখানেই ইস্তাফা। পাড়ায় চেয়ারম্যানের ভোটের ক্যানভাসের মিছিলে দিনকয়েক গলা ফাটানো কিংবা তার ছেলেদের সঙ্গে পাড়া ঘুরে ঘুরে পোস্টার মারা আর বিভিন্ন কাজ অ-কাজ করেই তাকে সান্ত¡না খুঁজতে হয়েছে চেয়ারম্যান হওয়ার স্বপ্ন সফল করতে।

জাম্বুর ভাবনা থেকে নিজে যখন অন্যদিকে মন ঘুরিয়েছি আর ঠিক তখনই প্রায় নৈঃশব্দ ভঙ্গ করে জাম্বু কথা বলে উঠল, ‘দাদা একটা কথা কবো?’ জাম্বুর খুব আন্তরিকপূর্ণ কথা শুনে বললাম, ‘বল।’
‘আপনের বাড়ির পেছনে একটা বড় কাঁঠালগাছ আছিল না আগে?’
আমি জাম্বুর কথায় কিছুটা হতভম্ভ হলাম এবং কিছুটা চমকেও উঠলাম। ব্যাটা এতদিন বাদে আজকে এই প্রসঙ্গটাই তুলল কেন! আমি কিছুটা সময় নিয়ে বললাম, ‘হয় আছিল তো। তো কী হয়েছে?’
‘ওই গাছের কাঁঠাল কে চুরি করত জানেন?...চেয়ারম্যানের ব্যাটা নূরুল।’
‘জানি।’-দাঁতে দাঁত চেপেই বললাম। কারণ, একবার না, বারবার চুরি গেছে ওই গাছের কাঁঠাল। কোনো বছর একটা-দুইটা আমাদের খাওয়ার ভাগ্যে হয়েছে কী হয়নি। আমাদের বাড়ির পেছনে একটু দূরে হওয়ায় আমাদের বাড়ির মানুষের তেমন একটা নজরে থাকত না। তারপর দিনের বেলায় কিছুটা নজরে রাখার চেষ্টা করলেও রাতে সম্ভব হতো না। আর ঘটনা ঘটত রাতের অন্ধকারেই। কিছু মানুষের বিশ্বস্ত সূত্র থেকে আমাদের কাছে তথ্য এলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বাবাকে দেখেছি এড়িয়ে চলতে, ‘খাক। সারা জীবন তো এইভাবেই চলল।’

আমার ভাবনার মধ্যে জাম্বু হঠাৎ কথা বলে ওঠে, ‘আর কাঁঠালগুলো আমাক দিয়্যাই চুরি করাইছিল।’
‘তাও জানি।’- আমার টান জবাবে জাম্বুর কথা মুহূর্তে যেন অন্ধকারে হারিয়ে গেল। ওর মুখটা একেবারে চুপসে গেছে সন্দেহ নাই। জাম্বু বা চেয়ারম্যানের ব্যাটাকে দেখামাত্র আমার দুই চোখে ‘চোর’ ভেসে ভেসে উঠছিল এতদিন। সেই খচখচানি কাঁটার অসহ্য জ্বালাটাই যেন নেভানোর জন্য বললাম, ‘কাজটা কি ঠিক করেছিস তোরা?’

জাম্বু যেন এই কথারই অপেক্ষায় ছিল। সহসা বলে উঠল, ‘বিশ্বাস করেন দাদা, আমি চুরি করতে চাইনি। আমাক ভয় দেখায় গাছে তুল্যা দিয়্যা চুরি করাইছে। আর...আর সব কাঁঠালই ওরা লিয়্যা গ্যাছে, খাওয়ার জন্য একটা কাঁঠালও আমাক দেয়নি।’ খানিক বাদে আবার ও বলা শুরু করল, ‘কাঁঠাল পাকানোর জন্য মাঝে মাঝে মাটির নিচে পুঁতে রাখত, সেই কাঁঠাল কয়দিন বাদে পচেও গ্যাছে তাও আমাক একটা খাওয়ার জন্যও দেয়নি জানেন এরকম হারামি ওরা।’

বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি। হঠাৎ জাম্বুর রিকশার গতি কিছুটা বেড়ে গেছে, হয়তো কথা বলার উত্তেজনাতে হবে। বাড়ির সম্মুখে সে ব্রেক কষে দাঁড়াল, ভাড়া মিটিয়ে দিতে গেলে ও কিছুতেই ভাড়া নিতে চাইল না। রিকশা বাড়িতে গ্যারেজ করবে বলে ও রিকশার হ্যান্ডেল ধরে টান দিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলে আমি ওকে থামালাম।

ভাড়ার টাকা কয়টা ওর হাতে জোর করে গুঁজে দিয়ে ওকে বললাম, ‘জাম্বু, আমাদের সেই কাঁঠালগাছটা খুব ফলবতি গাছ ছিল। প্রচুর কাঁঠাল দিত মৌসুমে, বেশ সুস্বাদু বড় বড় কাঁঠাল। আমাদের সেই গাছটি তোদের সেই ঘটনার পর থেকে কোনো এক কারণে ফল দেওয়া বন্ধ করেছিল, একসময় পাতা শুকিয়ে গোটা গাছটাই মারা গেল। আমাদের নতুন গাছে এখন কিছু কাঁঠাল ধরে, কাঁঠালের সময় এলে খাওয়ার জন্য একটা কাঁঠাল নিয়ে যাস। এখনই বলে রাখলাম, মনে থাকবে তো?’

জাম্বু আমার কথায় কী বুঝল কে জানে। অন্ধকারে আমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তার রিকশা নিয়ে দ্রুত জায়গা ত্যাগ করল।

 
Electronic Paper