ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

শৈশবের রোদে মাহমুদুল হক

ইমতিয়ার শামীম
🕐 ২:২৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ০১, ২০১৯

খুব কম বয়সেই আমি জেনে যাই, মাকড়সার মতো অত নিখুঁতভাবে না হোক, বিন্দু বিন্দু ধূলিকণাও নিবিড়, ঘন জাল বুনতে পারে। ধূলি দিয়ে গড়া সেই টুকরো টুকরো ফ্যাকাশে জাল নিরবচ্ছিন্ন ভঙ্গুর মসলিন হয়ে লেপ্টে থাকে গুদামজাত বইপত্রের ফাঁকফোকরে। শৈশবের অপরিহার্য প্রিয়জনদের মানুষ যেমন তার স্মৃতিঘরে রেখে দেয়, তাদের নিয়ে বিষণ্ন রূপকথা রচনা করে আটপৌড়ে আলোআঁধারে-যদিও বাস্তবে আর তাদের দিকে ফিরে তাকানোর সময়ই পায় না কোনো সময়, পায় না পাশে বসে দু’দ- কথা বলবার ফুরসত-এসব বইও তেমনি পড়ে থাকে দিনের পর দিন চোখের সামনেই অগোছালো চুপচাপ আমলকীর মৌ ছড়িয়ে। পড়ে থাকে হয়তো ঘরের তাকের ওপর। হয়তো আলমারির ভেতর। হয়তো ঘরের কোণে দেয়াল ঘেঁষে কিংবা চকি-বিছানার নিচে।

এসব ঘটেছিল কোনো একদিন-আর তা আজ আর মনে হয় না আমার। মনে হয় অন্য কারও-অন্য কারও এই জীবনের শৈশব। হঠাৎ কী কারণে রুগ্ন, শীর্ণ, প্রায়ই বিছানার সঙ্গে লেপ্টে পড়া এই আমাকে দেখে হয়তো আমার সেজো ভাইয়ের খুব মায়া হয়েছিল, তাই দেখে বাবার নির্লিপ্ত মায়াতেও একটু প্রাণ জেগেছিল। পুরনো দালানের জানালার কার্নিশে দাঁড়িয়ে তারা হাত বাড়িয়েছিলেন অনেক ওপরের দেয়ালঘেঁষা তাকের দিকে। বড় রহস্যে ঘেরা ওই তাকে কত কিছু যে আছে- বইপত্তর, বাঁধাই করা ফটো, ছোট-বড় কৌটা এমনকি টিনের তোরঙ্গ। দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা বইপত্রের একেকটি প্যাকেট নামাচ্ছিলেন তারা আর ঝরে পড়ছিল ধূলিকণার ছ্যাঙ্গা, টিকটিকির ডিম আর সরল, চোখ না ফোটা ধুকপুকে হৃদয়ের সন্তান। তার পিতামাতা, আত্মীয়স্বজনদের কেউ দৌড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার আগে ফেলে রেখে যাচ্ছিল সামান্য একটু লেজ-যেন সেই লেজ দেখতে দেখতে পথ খুঁজে পাবে হতভাগারা। তাদের করুণ চোখকে বারবার পরোক্ষে নিয়ে যাচ্ছিল পাগলের মতো দৌড়ে বেড়ানো পৃথিবীর সমান বয়সী বিরক্তিকর, আতঙ্কজনক ছোট-বড় দুর্গন্ধময় আরশোলারা, আর তাদের ঘ্রাণ পেয়ে মনের আনন্দে দাপাদাপি করছিল গৃহপালিত মোরগ-মুরগিরা। জীবিত হোক আর মৃত ও চিড়েচ্যাপ্টা হোক, অনায়াস নিপুণতার সঙ্গে তারা সেগুলোকে গিলে ফেলছিল প্রভূত আনন্দ নিয়ে।

আমার মহামূল্যবান সম্পদের জগতে ছিল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটের খালি সব খোল, খবরের কাগজ থেকে কেটে কেটে জমা করা রনবী ও নজরুলের কার্টুন, কৃশকায় মায়াবিনী ববিতা, ক্যাসিয়াস ক্লে কিংবা ভিয়েতনাম-বলিভিয়া, ছিল রঙিন মার্বেল দু’চারটা, ছিল তুচ্ছ সব বিচিত্র খাপড়া ও ঝামা ইট...হয় কি, সেই দিন থেকে এসবের সঙ্গে যুক্ত হয় পুরনো পত্রিকা-শাহীন আর সেতারা। সেদিন থেকে আমার এই অকিঞ্চিৎকর জীবনে যুক্ত হন মাহমুদুল হক। সেদিন আমি খুঁজে পাই ‘যেমনি আর তেমনি’-দের, সেদিন থেকে আমি খুঁজে ফিরি ‘যেমনি আর তেমনি’-দের। ‘যেমনি আর তেমনি’ই কি ছোটদের জন্য কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হকের প্রথম লেখা? ও নিয়ে কোনোদিনই ভাবিনি আমি। এতদিনে ভাবছি, আর ভাবতে গিয়ে আবারও মনে হচ্ছে, তিনি যে শিশু-কিশোরদের জন্যও লিখেছেন, এ খবর বোধকরি খুব কম পড়ুয়াই জানেন। আবার যারা জানেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই আস্বাদনের অভিজ্ঞতা শুধু ‘কুশল ও চিক্কোর মারন চাবুক’। যদিও, বাস্তবত, তার শিশুসাহিত্যের জগৎ আরও বিস্তৃত। টের পাই, অদ্ভুত সরল, হয়তো দুঃখে ঠাসা-এমন সব কাহিনীই আকৃষ্ট করেছে তাকে। তিনি নির্মাণ করেছেন নিজের আনন্দময়তা দিয়ে। সে রকম একটা গল্প বহুদিন মনে ছিল আমার, এত দিন পর আবার একটু-একটু মনে করতে পারি-নীল আকাশের রাজ্য থেকে এক পরী নেমে এসেছিল সাগর-পারের গহীন বনের ভেতর। ভারী হিংসুটে সেই পরী সুন্দর সুন্দর ফুল ছিঁড়েছিল তার আঁচল ভরে। তার পর সে গাছের আর সব ফুল ছিঁড়তে শুরু করেছিল, যাতে আর কোনো পরী এসে এসব সুন্দর ফুল নিতে না পারে। তখন বিরাট অশত্থ গাছের তলায় বসে ধ্যান করতে থাকা দরবেশটির ধ্যান ভেঙে গিয়েছিল। আর ফুল ছিঁড়ে ফেলা পরীটাকে তিনি শাস্তি দিয়েছিলেন-একটা গাছ হয়ে গিয়েছিল সে, সুন্দর লাল টুকটুকে ফলও ধরতে শুরু করে তার। তবে ফলের ভেতরটা ভারী নোংরা-ঠিক যেমন নোংরা সেই পরীর মন। সেই ফলটাকেই আমরা ডাকি মাকাল নামে।

তখন তো শৈশব, হয়তো তার কোনো গল্প পড়ে হেসেছি, হয়তো তৃপ্তিতে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছি বুকের পত্রিকাটিকে শুইয়ে দিয়ে। হয়তো কখনো কেঁদেও ফেলেছি, তেমন গল্পও তো ছোটদের জন্যে অনেক-অনেকগুলো লিখেছেন তিনি। আর কান্নাকে আমরা যত উপহাসই করি না কেন, কাঁদতে পারা কি অতই সহজ? জন্মের পর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের কেবলই হাসতে শেখানো হয়। আমাদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় হাসতে পারা। কিন্তু কান্নার মতো প্রবল অনুভূতি কী আর আছে! তার মতো হতভাগ্য আর কে আছে, যার জীবনে কখনো আনন্দে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলার কোনো ক্ষণ আসেনি! আজ সচেতনভাবে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখছি, চারপাশের যে দানবিকতা প্রতিনিয়ত আমাকেও যে দানব করে তুলতে চায়, হয়তো কখনো তাতে খানিকটা সফলও হতে শুরু করে, আবার পরক্ষণেই যে সেই দানব পরাজিত হয়, মানবিকতা আর মনুষ্যত্ববোধ জেগে ওঠে- সেসবকে খুঁজে নিতে, আলাদাভাবে লালন করতে, ধারণ করতে তিনিই শিখিয়েছিলেন। অথচ কী আশ্চর্য, শৈশবের একজন পাঠক হিসেবে আমার কাছে লেখকের নাম তত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তখন গুরুত্ব ছিল পাঠের আনন্দ।

সমাজে যে শ্রেণি আছে, সমাজে যে বৈষম্য আছে, আছে নিপীড়ন আর তার হাত থেকে নিষ্পাপ শিশুরও রেহাই নেই-এই সত্য সেই শৈশবে মাহমুদুল হক ছাড়া আর কেউই শেখাননি আমাদের। সবাই চেয়েছেন মুখটায় হাসি ফোটাতে। কিন্তু তিনি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন বাস্তবের সামনে, রূঢ়তার সামনে, দারিদ্র্য আর নিপীড়নের সামনে। এমন নয় যে তিনি আমাদের মুখে হাসি দেখতে চাননি; তিনিও চেয়েছেন, আর চেয়েছেন বলেই জানাতে চেয়েছেন, কতটা পথ হাঁটতে হাঁটতে কতটা রক্ত ঝরে মুখে হাসি ফোটাতে। ‘সম্রাট’ নামে একটি কিশোরোপযোগী গল্প রয়েছে তার। এ গল্প কি শুধু একটি পরিবারের ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ার গল্প? দারিদ্র্যে আক্রান্ত হওয়ার গল্প? না, তা তো নয়-একইসঙ্গে তা ধরে রেখেছে মানুষের মৃত্যু হওয়ার পরও মানবের বেঁচে থাকার কাহিনীকে।

আরেকটি গল্প-‘রং বেরং’-তাতে অবশ্য এত দারিদ্র্য নেই, এমন পারিবারিক ভাঙনও নেই, বরং দারিদ্র্যের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার বিষয়টিই আমাদের সামনে চলে আসে তাতে; আসে আরও একটি ব্যাপারও বটে-তা ছোটবেলায় নিশ্চয়ই চোখে পড়েনি, এখন বড় হয়ে পড়তে গিয়ে ধরতে পারিÑউঠতি মধ্যবিত্তের আলাদা হয়ে পড়ার ব্যাপার সেটা। শাড়ির বদলে ডেকচি সেলিনা শুধু এ কারণে নেয় না যে, সংসারে ডেকচিটাই ওই শাড়ির চেয়ে বেশি দরকারি; বরং আরও একটি কারণও থাকে তাতে। আর তা হলো সাতসকালে সে দেখতে পেয়েছে, একই রকম শাড়ি পরে এক মেথরানী ড্রেন পরিষ্কার করছে। অতএব নতুন শাড়ি তো কী হয়েছে? সেটি দিয়ে একটি ডেকচি নিতে একটুও দ্বিধা করছে না সে।

এমন একটি সময় গেছে-কত নির্জন দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে, কত এলোমেলো কথা মনে হচ্ছে আর সেসব এলোমেলো কথার ভিড়ে ঢেউ তুলছে মাহমুদুল হকের ‘দুই দুষ্টুর দুপুর’। পাক্ষিক সেতারায়, না কি মাসিক আলাপনীতে পড়া এই গল্পে দুপুর হতেই এ বাড়ির দরজা খুলে এক বালক বেরিয়ে এসে ‘ম্যাঁও’ বলে ডেকে ওঠে। তখন ও বাড়ির দরজা খুলেও বেরিয়ে আসে আরেক বালক। দুই বালকের খুনসুটি আর স্বপ্নময়তায় ভরা দুপুর, একটি দুপুর। বাড়ি থেকে কড়া হুকুম জারি করা আছে তাদের ওপর। ও বাড়ির বাবুলকে তার মা বলেছে, খোকনটা বড় হয়ে নির্ঘাত চোর হবে, খবরদার, ওর সঙ্গে মিশলে পিঠের ছাল তুলে ফেলা হবে। এ বাড়ির খোকনকে তার মা বলেছে, বাবুলটা বড় হয়ে একটা ডাকাত হবে। অতএব ওর সঙ্গে মিশলে ভাত না দিয়ে ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হবে। কিন্তু তারা তো একজন আরেকজনের সঙ্গে না মিশে থাকতে পারবে না। গল্পের শেষে দেখি, বাড়ির মধ্যে ফিরে যাওয়ার আগে খোকন হঠাৎই বাবলুর মাথায় একটা ঠুল দিয়ে চলে গেল-এইবার সে নিশ্চিত, কালকেও বাড়ি থেকে বের হতেই হবে বাবলুকে। আর বের না হলে তাকে সে আরেকটা ঠুল দেবে না। তখন নির্ঘাত একটা বিরাট শিং বের হবে ওর মাথা থেকে। বন্ধুতার কী নির্দোষ কুসংস্কার!

তখন বোধহয় ২০০৪ সাল ফুরিয়ে আসছে। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে ছোটগল্প নিয়ে একটা গদ্য লিখেছিলাম কোনো এক বৃহস্পতিবার। তাতে প্রসঙ্গত মাহমুদুল হকের শিশু-কিশোরোপযোগী গল্পের কথাও লিখেছিলাম। একদিন আবু হেনা মোস্তফা এনাম শাহবাগের আজিজ মার্কেটে দেখা হওয়ার পর জানতে চাইলেন, মাহমুদুল হকের ছোটদের লেখা আমি কোন কোন পত্রিকায় পড়েছি। তাকে ‘আলাপনী’র কথা বলি, ‘সেতারা’ ‘শাহীনের’ কথা বলি। বলি পুরনো সব শিশু পত্রিকাতেই বোধকরি লিখতেন তিনি। প্রসঙ্গত এ-ও জানাই, এসব পত্রিকা নিশ্চয়ই বাংলা একাডেমি কিংবা আর্কাইভে থাকবে।

এখন আমার ভাবতে অবাক লাগে, অবাক হতে হতে আবেগের শ্বাসরুদ্ধকর বুদ বুদও জমে ওঠে একথা ভেবে, কী পরম মমত্ব ও ভালোবাসায় এনাম দিনের পর দিন খেটে মাহমুদুল হকের সেসব গল্প উদ্ধার করেছেন। তখন লাইব্রেরি থেকে কোনো বইপত্র ফটোকপি করা ছিল মহাঝক্কির কাজ (এখনো তাই বটে)। অন্যদিকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন গুটি কয়েক হাতেগোনা মানুষ; তার ওপর সেসব ফোনও অত স্মার্ট ছিল না যে প্রচুর ছবি তুলে ফোনেই সংরক্ষণ করা যাবে। কিন্তু কোনো প্রতিবন্ধকতাই এনামকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি সময় পেলেই বাংলা একাডেমিতে যেতেন-পুরনো পত্রিকা থেকে মাহমুদুল হকের শুধু ছোটদের জন্য লেখা গল্প নয়-যে কোনো লেখাই খুঁজে বের করে ধৈর্য ধরে কপি করতেন হাতে লিখে। ততদিনে মাহমুদুল হক লেখক হিসেবে শীতনিদ্রায় চলে গেছেন। কিন্তু তাতে কী? যা তিনি লিখে গেছেন, তাও তো ঐশ্বর্য, সেই ঐশ্বর্য কি চাপা পড়ে থাকবে গহিন অতলে? এনাম তা কিছুতেই হতে দেবেন না। তিনি তাই সেগুলো এইভাবে কপি করে পুনরুদ্ধার করেন গভীর একাগ্রতা নিয়ে। কেউ কেউ তাকে জিজ্ঞেস করতেন, মাহমুদুল হক কি তাকে এগুলো কপি করতে বলেছেন? না কি কেউ তার রচনা সংগ্রহ ছাপাবে? কোনো প্রকাশনীর কেউ? এ কাজের জন্য কত টাকা পাবেন তিনি? যখন তারা শুনতেন, এনাম কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই নিজের সংগ্রহে রাখার জন্য এগুলো কপি করছেন, তখন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বক্র হাসি ছড়িয়ে চলে যেতেন তারা। হয়তো আড়ালে হাসাহাসিও করতেন। এনাম তাদের সেই অবিশ্বাস, উপহাস বুঝতে পারতেন। তিনি নিষ্পৃহভাবে আবারও কপি করায় মন দিতেন।

অনেককেই মাঝেমধ্যে বলতে শুনি, মাহমুদুল হক উপেক্ষিত। কিন্তু যখন এনামের কথা মনে হয়, তখন আপনা আপনিই এই ভাবনাও চলে আসে, হাজার হাজার পাঠক না থাকুক, যার এমন একজন মাত্র পাঠক আছে, বিস্মরণের এমন কী শক্তি আছে যে সেই লেখককে মহাকালের অন্ধকারে ঠেলে দেবে? নতুন নতুন শৈশব, নতুন নতুন কৈশোর বারবার জাগিয়ে তুলবে তাকে। সূর্যের মতো ফুটে উঠবেন তিনি অন্ধকার ঠেলে।

 
Electronic Paper