হালের কালের চরণ ধরে
সাদ্দাম হুসাইন
🕐 ১:৪৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ০১, ২০১৯
ধরুন, একজন তাপস বছরটাকে সমানে দুটি ভাগ করে প্রথম ছমাস একটা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় তপস্যা করবেন এবং পরের ছয় মাস ভিন্নভাবনায় ভিন্নকিছুর জন্য তপস্যা করবেন। তাহলে ভাবুন তার তপস্যার জন্য যে নির্ধারিত সময়, সেই সময়টাকে তার কীভাবে ব্যয় করতে হবে। স্থান নির্বাচন, সেখানে গমন, তারপর তপস্যাপোযোগী আসন নির্মাণ, এ ছাড়া তো তার মৌলিক কাজকর্ম আছেই- সবকিছু সামাল দিয়ে তাকে সেই পূর্ণপ্রাপ্তির প্রান্তে পৌঁছাতে হবে প্রাধ্যয়নকে প্রধান করে। কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন এবং কষ্টসাধ্য। আর পথটাও সুন্দর নয়, বরং বন্ধুর! আবার তপস্যা সফল হবে কি না, তাও বলা মুশকিল। চিহ্ন এ ক্ষেত্রে এমন এক তাপসের ভূমিকায় অবতীর্ণ, যা সত্যিই বিস্ময়কর এবং অবাক করে দেওয়ার মতো। কালের কলেবরে পা রেখে পায়ের পরে পা ফেলে চিহ্ন এখন উনিশ বছরে পদার্পণ করেছে। সংখ্যার পরিসংখ্যানে ৩৬তম (ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) প্রকাশ। সদ্যপ্রয়াত ‘রোদ্দুরের কবি’ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে (১৯২৪-২০১৮) স্মরণ করা হয়েছে সংখ্যাটিতে।
যারা নিয়মিত চিহ্ন-পাঠ করেন বা চিহ্নর খোঁজখবর রাখেন, তারা নিশ্চয় জানেন ২৫তম সংখ্যা থেকে চিহ্ন প্রকাশ করছে ‘ক্রোড়পত্র’ নামে বিশেষ সংযোজন। ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’, ‘কথাশিল্পের কারুকার্য’, ‘শতবর্ষে সবুজপত্র’, ‘বাঙালি মুসলমানের চিন্তা-চর্চার দর্শন’, ‘ঢাকা চন্দ্রিকা’, ‘কবি ও কবিতার বিশেষ চিহ্ন’, ‘গল্প ও গল্পধারার ঐতিহ্য’, ‘সাহিত্যে দর্শন দর্শনে সাহিত্য’, ‘মহাভারতের পুনর্পাঠ’, ‘উপন্যাস নিয়ে’-এমন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে চিহ্ন আমাদের উপহার দিয়েছে সমৃদ্ধ ক্রোড়পত্রের ‘চিহ্ন’। ৩৬-এর ক্রোড়পত্রের ক্রোড়ে যুক্ত হয়েছে ‘পোস্টমডার্নিজম’। পোস্টমডার্নিজম একটি জটিল বিষয়। এ বিষয়ে এত রকমের আলোচনা হয়েছে, এর সংজ্ঞা ফ্রেমের আঁটোসাঁটো বাঁধনে বেঁধে দেওয়া বিস্তর কঠিন! জন বার্থ, ডিক হেবিগ, মার্গারেট রোজ, জেনক্স, জেমসন, মার্টিন ট্রেভার্স বেকেট, জয়েস প্রমুখ যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা বিস্তর এবং বহুতর। সবার ক্ষেত্রে পোস্টমডার্ন বৈশিষ্ট্যের আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে অনির্ণেয়তা, আপেক্ষিকতা, সংকরত্ব, মহাআখ্যানের প্রতি বিরূপতা।
জাঁ-ফ্রাসোয়ালিও তার পোস্টমডার্নিজমের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মহাআখ্যানের প্রতি বিরূপতাকে পোস্টমডার্নিজমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বাস্তব এবং তার অনুভূতির মধ্যে যে বিস্তর ব্যবধান বহুদিন মানা হয়েছে, তার বিলুপ্তিকে পোস্টমডার্ন-এ সময়ের আর একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জেমসন দেখিয়েছেন যে বাহ্যিকরূপ এবং অন্তর্গত তাৎপর্যেও সম্পর্কে বিশ্বাস বিশ শতকে পাশ্চাত্য ভাবনা জগতে প্রভাবশালী হয়ে থেকেছে। মার্কসবাদ, মনোবিশ্লেষণ, চেতনাপ্রবাহ, অস্তিত্ববাদ-দাঁড়িয়ে আছে ভিত্তি ও অভিব্যক্তির উপস্থিতি মেনে এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্কের উন্মোচন-সম্ভাবনায় বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে, কিন্তু পোস্টমডার্ন এমন কোনো পার্থক্যের উপস্থিতিতে অবিশ্বাসী। সবমিলিয়ে পোস্টমডার্ন শিল্প অনিঃশেষভাবে অনির্ণেয়তার অনুসন্ধানী। পোস্টমডার্নিজমের এমনসব বিদঘুটে, বহুমাত্রিক ও বিমূর্ত ধারণাকে খোলাসা করতে চেয়েছে চিহ্ন তার ক্রোড়ে ঠাঁই করা নতুন-পুরাতন, পক্ষে-বিপক্ষে প্রায় কুড়িটি লেখা দিয়ে। হামীম কামরুল হক, শিমুল মাহমুদ, কামরুল ইসলাম, শরীফ আতিক-উজ-জামান, শেখ নাহিদ হাসান, স্বামী শাস্ত্রজানন্দ, ইমানুল হক, আহমেদ মাওলা, মোজাফ্ফর হোসেন, রামকৃষ্ণ মণ্ডল, দেবেশ রায়, সমীর রায়চৌধুরী, প্রভাত চৌধুরী, পবিত্র সরকার, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, তপোধীর ভট্টাচার্য এবং এজাজ ইউসুফী ‘পোস্টমডার্নিজম’ সম্পর্কে তুলে ধরেছেন পাশ্চাত্য ধারণা ও প্রাচ্যপ্রয়োগ, পোস্টমডার্নিজমের যোগসূত্র, সাহিত্যে এর উপযোগিতা, পোস্টমডার্নিজমের ভিত্তি-দর্শন, পোশাক-পরিচ্ছদ, সুবিধা-অসুবিধা, মার্কসবাদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও বিরোধ, উত্তর-আধুনিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক অবস্থান, তৃতীয় বিশ্বে উত্তর-আধুনিকতা বিষয়ে নিজেদের তাত্ত্বিক ও তাথ্যিক প্রতিক্রিয়া।
পাঠানুরাগী পাঠক পাঠনিবেশ করলে পদচ্যুত হবেন না, বরং পেয়ে যাবেন পদচ্ছায়া, পোস্টমডার্নিজন সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসিত জিজ্ঞাসা এবং আরও জানার জিঘাৎসা। ক্রোড়পত্রেই পরেই রয়েছে চিহ্নর নিয়মিত বিভাগ। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, বিশেষ গদ্য, কী লিখি কেন লিখি, অনুবাদ, সাক্ষাৎকার এবং বিজ্ঞানের সহজ পাঠ নিয়ে সাজানো হয়েছে এ বিভাগ। বিশেষ রচনা হিসেবে রয়েছে শাহ্যাদ ফিরদাউস রচিত লালন ফকিরের জীবনভিত্তিক চিত্রনাট্য। ধারাবাহিক রচনার পরে শেষ পাতার আহ্বান দিয়েই বোধ ও বোধির সমন্বয়ে শেষ হয়েছে ৫১২ পৃষ্ঠার পত্রিকার মেদহীন সুঠাম শরীর। চিহ্ন তপস্যা করে কিন্তু সেই তপস্যার ফল/বর/সুফলের ভোক্তা চিহ্নপাঠক। আসুন, চিহ্ন পাঠ করুন, এবং ফল/বর/সুফলের ভোক্তা হোন।