ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ইউরোপের শব্দসমর

মহীবুল আজিজ
🕐 ২:৩২ অপরাহ্ণ, মার্চ ০১, ২০১৯

এরিখ হবসবম্ তার আত্মজীবনী ইন্টারেস্টিং টাইমস্-এর এক স্থানে ভিয়েনা শহরের এক বিকাল বেলার (২৮ জুন ১৯১৪) একটি ঘটনার কথা লিখেছেন। এক পত্রিকা-হকার শশব্যস্ত ঘোষণা দিতে দিতে পত্রিকা বিক্রি করছিল, অস্ট্রিয়ার রাজকুমার আর্কডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড নিহত হয়েছেন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে- হত্যাকারী একজন সার্বীয়। শুনে ইহুদি ধর্মাবলম্বী লোকেরা হাঁফছাড়া মন্তব্য করে, গোটলোব কাইন জুড! মানে-ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, হত্যাকারী লোকটা ইহুদি না!

হলে কী হতো তা আর বলার দরকার পড়ে না। হবসবমের ওই বইতেই আমরা দেখি, ১৮৯০-এর দিকেই অস্ট্রিয়া-জার্মানিতে ‘অ্যান্টি-সেমিটিজমের’ অংকুর গজাতে শুরু করেছে। শত-হাজার বছর ধরে প্রজন্ম-পরম্পরায় জার্মানি-অস্ট্রিয়া- পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া-লাটভিয়া-ইউক্রেনে বসবাস করেও ইহুদিরা জাতিসত্তার পরিবর্তে ধর্মীয় পরিচয়েই চিহ্নিত থেকে গেছে। ইহুদিরা ভুলে গেলেও ওইসব দেশের লোকেরা ভোলে না যে তারা ইহুদি। আমি আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কথা বলছি। তবে সন-তারিখ মুছে দিলে এই ঘটনাটাকে কোনো না কোনোভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উদ্দেশ্য-কার্যকারণ সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেক পরিষ্কার ও স্পষ্ট। পক্ষ-প্রতিপক্ষতা সেখানে সরাসরি-হিটলারের আক্রোশ আর নৃশংসতার শিকার ষাট লাখ ইহুদি মানুষ যাদের জীবনের সমস্ত সম্ভাবনা অপচিত হয়েছে অকালে। কিন্তু সে তুলনায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কার্যকারণ অধিক জটিলতাপূর্ণ। জার্মানি অস্ট্রিয়া সার্বিয়া রাশিয়া তুরস্ক ফ্রান্স ইংল্যান্ড হয়ে একটি একক গোলার্ধ থেকে ক্রমশ স্ফীতি নিয়ে সেই যুদ্ধ অঞ্চল থেকে বিশ্বরূপ পরিগ্রহ করে। এক কোণের যুদ্ধ হয়ে যায় সারা পৃথিবীর যুদ্ধ। আর এসবের মধ্যে জটিল-অস্টাবক্র ইতিহাসের এক অবিরল জলভ্রমি চলতে থাকে। এমন সব দেশের মানুষের জীবন যন্ত্রণা-দুর্ভোগ-বেদনার আঁধারে পরিণত হয় যাদের সঙ্গে যুদ্ধোৎপত্তির কোনোই সম্পর্ক ছিল না। পুঁজি-ব্যবসা, জাতিত্বের জবরদস্তি কিংবা সাম্রাজ্যবাদের নখদন্তের বিকাশ ইতিহাসের পাতায় রেখে গেল চিরকালের ছাপ। প্রাচীন ঔপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিতন্ত্র এবং আগ্রাসনেরই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটতে লাগল-পার্থক্য কেবল কালগত।


ইতিহাসের সামনে দাঁড়ালে এমন যুদ্ধ-আদল অনেকই আমাদের চোখে পড়ে। ষোড়শ শতক থেকে এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশ-বিস্তার। একেও আবার আগের ইতিহাসেরই পুনরাভিনয় বলা চলে। দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে দৌর্দ- প্রতাপশালী রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল আর্মেনিয়া থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত। ত্রয়োদশ শতকে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা জয় করেছিল মধ্যপ্রাচ্য এবং চীন। চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত মেক্সিকোতে আজটেকরা তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করায় অন্যদের হটিয়ে দিয়ে। একইভাবে ইনকারাও তাদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে অন্য জাতিসত্তাদের পরাজিত করে। পঞ্চদশ শতকে দক্ষিণ ভারতে বিশাল সাম্রাজ্য বিজয়নগর এবং অটোমান সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয়। পরে এই অটোমান সাম্রাজ্যই ইসলাম ধর্মাশ্রয়ে তুরস্কের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে এশিয়া মাইনরের সিংহভাগ এবং বলকান অঞ্চলে পরিব্যাপ্ত হয়। অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকে এই সাম্রাজ্য ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃতি পায়। যাকে ক্রুসেড বলা হচ্ছে কিংবা স্পেনে মুরীয়দের আগ্রাসন তাও এক অর্থে সাম্রাজ্যবাদের ভিন্ন সংস্করণ। কাজেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতারও এক অর্থে পুরনোর নবাবির্ভাব। পুঁজি, বিজ্ঞানের ওপর নিয়ন্ত্রণ, অতীত ঔপনিবেশের খোঁয়ারি এবং আধুনিক সমরাস্ত্র-প্রস্তুতি এখনকার বাস্তবতাকে আরও জটিল ও বহুমাত্রিক করে তুলল।

১৯১৩ সালে জার্মান জেনারেল বার্নহাডির কণ্ঠে যেন প্রতিধ্বনিত হলো মোঙ্গল চেঙ্গিস খানের কথা। তিনি বলছেন, ‘যুদ্ধ একটি জীববিদ্যাগত প্রয়োজনীয়তা। দুর্বলের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার এটা একটা উপযোগী পথ।’ (ভম হিউটিগেন ক্রিগ বা আজকের যুদ্ধ) শুধু যুদ্ধবাজ-জঙ্গি নয় জার্মানির শিক্ষক, সাংবাদিক এবং রাজনীতিবিদরা পর্যন্ত এক থাকে সায় দিতে একটুখানি লজ্জা বোধ করেনি। সেই বছরের গ্রীষ্মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনের বন্ধু এডওয়ার্ড এম হাউস বার্লিন সফরে যান। সেখানে সামরিক বাহিনীর প্রচ- তৎপরতায় তিনি ভীষণ আতঙ্কিত বোধ করেন। ফিরে গিয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট উইলসনকে বলেন, পুরো ইউরোপে বিদ্যুৎ-প্রবাহ বইছে। কোনোভাবে একটা স্ফুলিঙ্গ পেলেই হয়, ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডে পরিণত হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল মূলত, একটি ইউরোপীয় ব্যাপার। ১৯১৩-তে জেনারেল বার্নহাডির মন্তব্যের সময়টাতে তা ক্রমঘনীভূত রূপে বিদ্যমান এবং প্রেসিডেন্ট উইলসনের বন্ধু হাউসের প্রত্যাবর্তনের পরেই বেজে ওঠে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধদামামা। যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলকে ঐতিহ্যগতভাবে খানিকটা সামরিকায়নবিরোধী বলে ধরে নেওয়া হয় এবং যে দলটি ৭৫% ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে, দেখা গেল রাতারাতি তারাই সামরিক খাতে খরচ বাড়িয়ে ফেলেছে বহুগুণ আর তাতে অভাব নেই জনসমর্থনেরও। ভেতরে ভেতরে জার্মান পুঁজি বিস্ফোরিত হওয়ার পথ খুঁজছিল। সেই সময়টাতে তুরস্ক সরকারকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সামরিক বাহিনী পাঠায় জার্মানি। সার্বিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক তখন মধুর। এমনও বলা হয়, অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় যুবরাজ ফার্ডিনান্ডকে হত্যা করবার আয়োজন করা হয়েছিল সার্বীয় সরকারেরই নজরদারিতে। জার্মানি যেসব জাতিকে ছাড়িয়ে নিজেদের শক্তিকে প্রকাশের জন্য প্রস্তুত তার প্রমাণ পাওয়া গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ১৯১৩ সাল ছিল জার্মান সম্রাট উইলহেমের সিংহাসনারোহণের পঞ্চাশতম বছর। আনন্দ-উল্লাসের জন্য বছরটা ছিল খুব উপযোগী। নাইটক্লাব আর ক্যাবারেগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। আনন্দ-আবহে অশনী বয়ে আনে বলকান অঞ্চলে যুদ্ধের ঘনঘটা-ম্যাসিডোনিয়া নিয়ে সার্ব ও বুলগেরীয়দের সংঘাত। স্বদেশে বিরোধিতা সত্ত্বেও উইলহেম অস্ট্রিয়াকে চাপ দেন যাতে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত আলবেনিয়া থেকে সার্বীয়রা সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। জার্মানির সঙ্গে ইংল্যান্ডের সম্পর্ক তখন যথেষ্ট ভালো। কিন্তু তুরস্কে সামরিক মহড়ার ঘটনাটাকে একদিকে রাশিয়া নিল অন্য ইঙ্গিতে-তারা আত্মরক্ষার কৌশলে নিজেদের সামরিকায়নের প্রস্তুতি বাড়িয়ে দেয়। আবার ইংল্যান্ডও এটাকে দেখল কুনজরে। সিংহাসনে আরোহণের পঞ্চাশতম বছরে গর্জে ওঠার একটা সুযোগ পেলেন সম্রাট উইলহেম-‘রুশো-প্রুশিয় সম্পর্ক চিরদিনের জন্য সমাধিস্থ হয়েছে। আমরা এখন থেকে পরস্পরের শত্রু।’

জুন মাসে নিহত হলেন অস্ট্রীয় যুবরাজ। জুলাই মাসে লোকেদের বার্লিন শহর ছাড়ার বিজ্ঞপ্তি জারি করল সরকার। আগস্ট মাসে ঘোঘিত হয়ে গেল যুদ্ধ। ইতিহাসাভিজ্ঞ পরিসংখ্যান বলছে, বারো লাখ জার্মান সৈন্য তখন রণে নামবার জন্য তৈরি। বিশ্বখ্যাত জার্মান অভিনেত্রী টিলা ডুরিউক্স তার ডায়েরিতে তখনকার অবস্থা সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘সৈন্যরা মার্চ করে যাচ্ছে। তাদের ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে পুষ্পের বন্যায়। প্রতিটি মুখ সুখী। কী মজা, যুদ্ধ হবে! সবাই যুদ্ধের মহড়া আর বাজনায় দারুণ মনোযোগী। টেবিলে খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, মগের বিয়ার গরম হয়ে উঠছে। কুছ পরোয়া নেই! যুদ্ধ হবে, কী মজা! কিছুর অভাব নেই- খাবার-দাবার, চকোলেট সবই মজুদ রয়েছে। সবই রয়েছে বেশি-বেশি-লোকজন, খবার-দাবার এবং আশাবাদ।’

বোঝাই যাচ্ছে, টিলা ডুরিয়ুক্স জার্মান সম্রাট উইলহেম আর তদীয় জঙ্গিদের প্রচারণায় বেশ ভালো রকমেই প্রভাবিত হয়েছিলেন। বস্তুত কেবল টিলাইি নয় সমস্ত জার্মান নাগরিককেই তখন এমন আশাবাদে উজ্জীবিত মনে হতো যেন অঞ্চলটিতে জার্মানির সর্বময় কর্তৃত্ব-প্রতিষ্ঠা শুধু সময়ের ব্যাপার। অথচ যুদ্ধ-পরিপ্রেক্ষিত পাল্টে দিল সবকিছু। বারো লাখ সৈন্য হয়তো বারোশ রকমের অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত কিন্তু অগণিত মানুষের ওপর দিয়ে যুদ্ধের যে ঝড় বয়ে যায় তার খবর যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রের রাখবার দরকার পড়ে না। ইতিহাসকার (অ্যান্থনি রিড ও ডেভিড ফিশার সম্পাদিত বার্লিন : দ্য বায়োগ্রাফি অব এ সিটি) জানাচ্ছেন এবং সে ভাষ্য তাদের নিজেদের নয়, সমকালীন জার্মান পত্রপত্রিকার সহায়তায় আমরা তার কাছে জানতে পারি, মানুষ এমন অবর্ণনীয় দুঃখের দিনের মুখোমুখি হয়নি বহুকাল। অস্তিত্ব বিপন্ন ও বিলীন হওয়ার শঙ্কায় জর্জরিত পুঁজি-ধারক শক্তিমান দেশের মানবম-লী। রাষ্ট্র হুঙ্কার দিয়েই চলেছে। কারখানাগুলোতে যন্ত্রের অবিরাম ঘষটানো-তৈরি হচ্ছে মারণাস্ত্র। যুদ্ধ এসবের ধার না ধেরে তার নিজস্ব নিয়মে ঘা রেখে যেতে থাকে দগদগে। নিত্যকার প্রয়োজন সামাল দিতে গিয়ে নাভিশ্বাস ওঠে মানুষের। পত্রিকা লেখে, মাংস, আলু, চিনি, সাবান রেশনে দেওয়া আরম্ভ হয়েছে। দুধ পাবে কেবল ৬ বছরের নিচের বাচ্চারা কিংবা ডাক্তারি সার্টিফিকেট থাকলে রুগ্ন লোকেরা। রুগ্ন লোকেদের সংখ্যাও ঊর্ধ্বমুখী। অবস্থা সীমা ছাড়িয়ে যায়। ১৯১৫-এর গ্রীষ্মে বার্লিন শহরে রাইখস্টাগ-এর কার্যালয়ের সামনে ৫০০ জন গৃহিণী একটি প্রতিবাদ-মিছিল বের করে। মিছিলে তারা শাপশাপান্ত করতে থাকে যুদ্ধের।

সগর্জনে বলতে থাকে তারা, ‘আমাদের পুরুষদের ফিরিয়ে আনো! আমরা যুদ্ধ চাই না।’ কে কাকে ফেরায়-চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। ১৯১৬-এর অক্টোবর মাসে ২৭ বছর বয়সী হিটলার পায়ের চিকিৎসা করতে গিয়েছিলেন বেলিৎজ-এর একটি হাসপাতালে। সেখানে সংঘবদ্ধ যুদ্ধবিরোধী শান্তিবাদীদের দেখে ভীষণ ক্রুদ্ধ হন তিনি। কেউ যুদ্ধ ছাড়া অনন্যোপায়, আবার অনেকেই যুদ্ধের কবল থেকে মুক্তি পেতে আর্তনাদ করে মরে। যেসব দেশ যুদ্ধে মদদ জোগায়, যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সভ্যতা-মানবতা বিধ্বংসে যারা নির্বিকার তাদের দেশের মানুষেরাই আবার যুদ্ধের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছিল ক্ষোভ-প্রতিবাদ। তা-ও যুদ্ধ হয়ে চলেছিল। সৃজনশীল কবি-কথাকার-নাট্যকার-চিত্রনির্মাতা সবাই এমন বিধ্বংসী আয়োজনের বিরুদ্ধে নিজেদের বহিঃপ্রকাশের স্বাক্ষর রেখে গেছেন কিন্তু যুদ্ধ তার নিজস্ব নিয়মে এগিয়ে গেছে এবং একসময়ে যুদ্ধের অবসানও ঘটেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে যে বিশ্বে যুদ্ধ হয়নি এমন নয় বরং বহু দেশ ও বহু জাতি বহু প্রকারের যুদ্ধের সাক্ষী। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধই সেই প্রথম যুদ্ধ যেখানে বিচিত্র রাজনীতি, বিচিত্র স্বার্থ এবং বিচিত্র জাতি বহুবিধভাবে যুদ্ধের ভাষা উচ্চারণ করেছিল। এর মারণযজ্ঞে সভ্যতা এবং মানবতা বিপন্ন হয়েছিল ভয়ানকভাবে। যুদ্ধবাজ দেশের লোকেরাই যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজেদের অভিপ্রকাশের নানা ছাপ রেখে গেছেন এই পৃথিবীতে। আর যুদ্ধবাজদের অপতৎপরতার শিকার হয়েছিল যেসব দেশ সেসব দেশেও রচিত হয়েছে যুদ্ধসংক্রান্ত সাহিত্য ও শিল্প। যুদ্ধের শত বছর পরেও আমরা সেসব দৃষ্টান্ত স্মরণ-অনুসরণ করি। বর্তমান লেখায় আমরা চকিত পর্যবেক্ষণে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিফলন ও প্রতিক্রিয়াসম্পন্ন কথাসাহিত্যের কিছু নিদর্শন নিয়ে আলোচনা করব। এসব রচনায় যুদ্ধদিনের বাস্তবতা বিধৃত। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা স্থল-নৌ-বিমানপথের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সৈনিকদের অনেকের যুদ্ধাশ্রিত সাহিত্যও রয়েছে এসব নিদর্শনের মধ্যে।

স্বয়ং আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যে অস্ট্রেলিয় কথাশিল্পীকে তার যুদ্ধনির্ভর রচনার জন্য প্রশংসা করেন তিনি ফ্রেডেরিক ম্যানিং (১৮৮৭-১৯৩৫)। ছিলেন শহরের মেয়রের সন্তান কিন্ত ১৯১৪-এর যুদ্ধে তিনি পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে এবং চার-চারটি বছর কাটান যুদ্ধের ময়দানে। রণাঙ্গনে যুদ্ধরত সৈন্য দলের ভেতরকার জটিল সামাজিকতার চিত্র উন্মোচনে ম্যানিং সিদ্ধহস্ত ছিলেন। বলা যায়, চেক লেখক জারোস্লাভ হ্যাসেক (১৮৮৩-১৯২৩)-এর দ্য গুড সোলজার অব সোয়াইক উপন্যাসের কথা। ব্যঙ্গবিদ্রূপ আর হাস্যরসের চেতনা দিয়ে বাস্তবকে ফুটিয়ে তোলেন হ্যাসেক।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শতবর্ষ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমরা যখন এসব যুদ্ধবিষয়ক সৃজনশীল সাহিত্য মেলে ধরি তখন এসব মূক শব্দের শক্তি আমাদের বিস্মিত করে। ঘটে যাওয়া এক ভয়ঙ্কর কালিক বৃত্তকে একমাত্রিক শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করা এবং ধরে রাখার দুরূহ কাজ করে যান এসব দায়বদ্ধ রচয়িতারা। শব্দের শক্তি জেনেই প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা জানি রুশ লেখক নিকোলাস অস্ত্রোভস্কি রচনা করেছিলেন ইস্পাত। অন্ধ অস্ত্রোভস্কি বিশেষভাবে তৈরি করা রুলটানা লোহার ফ্রেমকে ব্যবহার করেছিলেন সাদা পৃষ্ঠার মধ্যে পঙ্ক্তিকে সোজা রাখবার জন্য। সেই ফ্রেমটাকে কারাগারে ঢোকানোটাও ছিল এক ধরনের সংগ্রাম। কিংবা আমরা স্মরণ করতে পারি মিসরীয় নারীবাদী লেখক নাওয়াল এল সাদাওয়ির কথা যিনি কারান্তরীণ অবস্থায় কারাগারের টয়লেট-টিস্যুতে রচনা করেছিলেন তার অসাধারণ আত্মজীবনী মেমোয়ার্স ফ্রম দ্য উওম্যান্স প্রিজন। যুদ্ধের ইতিহাস আমাদের মনের মধ্যে যে বিমূর্ততার ভাব তৈরি করে তারই প্রত্যক্ষ এবং নিখুঁত বিবরণ আমরা পাই যুদ্ধনির্ভর সাহিত্যকর্মের মধ্যে। যুদ্ধের ইতিহাসে যুদ্ধের ইতিহাস, রাজনীতি, পক্ষ-প্রতিপক্ষতা, প্রামাণিকতা প্রভৃতি অনেককিছুই নিহিত থাকে কিন্তু থাকে না মানবিকতা এবং সংঘবদ্ধ মানুষের জীবন। যুদ্ধের শতবর্ষ কাল পরেও যুদ্ধসাহিত্যের সামনে দাঁড়ালে যুদ্ধখচিত শব্দরাজি থেকে উচ্ছৃত ধ্বনি আমরা শুনতে পাই-আর যুদ্ধ নয়! ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসের শিরোনামে হয়তো তোলস্তোয় চিরকালের শিরোনামই এঁকে দেন-ওয়র এ্যান্ড পীস (যুদ্ধ নয় শান্তি)। তবুও বারবার যুদ্ধ হয়েছে পৃথিবীতে, হয়তো হবে সামনের দিনেও। তথাপি যুদ্ধাশ্রিত এসব সাহিত্যকর্মের মূল্য কোনোদিনই কমবে না।

 
Electronic Paper