এক অন্তর্দহনের গহীন গল্প
আদিত্য অন্তর
🕐 ১২:৫৮ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯
বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য একুশে বইমেলা এক অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করেছে। পাঠক-লেখক-প্রকাশকদের মাঝে নতুন উন্মাদনা সৃষ্টি করে বইমেলা। একথা সবারই জানা। কিন্তু কার মেলা কীভাবে কাটে, সেটা কয়জনই বা জানে! একজন লেখক হয়তো বই বের করতে না পেরে অন্তর্দহে ভুগছেন, একজন প্রকাশক হয়তো ভালো বই প্রকাশ না করতে পেরে আক্ষেপে মেলা কাটাচ্ছেন জীবনের সবকিছু ত্যাগ করে জড়িয়ে আছেন বইয়ের মায়াজলে, একজন পাঠক হয়তো তার চাহিদামতো বই না পেয়ে হতাশ হয়ে চলে যাচ্ছেন। কে রাখে কার খবর! কেউ বলে আবার কেউ বলে না। একজন লেখক হয়তো একসময়ে লিখে প্রকাশ করতে পারেন, একজন পাঠকও সুযোগ পেলে লিখতে পারেন, বলতে পারেন। কিন্তু একজন প্রকাশক? যার ভেতরে অনেক অনেক খা-বদহন, যন্ত্রণা, পোড়া সে খবর কেউ কি রাখে? বা সেকি আদৌতে বলার সুযোগ পায়? এভাবেই কত প্রকাশক হারিয়ে যান কত প্রকাশক কত স্বপ্ন নিয়ে আসেন! কে জানে!
আমাকে যখন বলা হয়েছিল, ‘প্রকাশকের মেলা’ এ বিষয়বস্তুর ওপর লিখতে হবে। আমি রাজি হলাম, তবে লিখবো কি! প্রকাশকের কাজ তো বই প্রকাশ করা, তাই তো করি। এর বাইরে আর কি লিখব! কিন্তু লিখতে বসেই টের পেলাম, বুকের ভেতরে কাঁপন উঠল কত ঝরঝাপটা পেরিয়ে এখানে এসেছি, কত হাহাকার ঘিরে ধরেছিল, কত বাধা, কত চিৎকার দূরে ঠেলে দিয়ে এখানে এসেছি, এসব ভাবনায় আসতে মনে হলো একজন প্রকাশক এতটা অন্তর্দহে ভুগতে পারে? একটা ছোট কাগজ (ইত্যাদি) থেকে শুরু আমাদের স্বপ্নযাত্রা। আমরা দুই বন্ধু আমি আর জুয়েল (জহিরুল আবেদিন জুয়েল) বাংলা বাজার থেকে শুরু করি। সালটা ২০০৩। ওমর আলীর ‘রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ছিলাম নয় মাস’ এবং তানভীর আহমেদ হৃদয়ের ‘পদচিহ্ন’ দিয়ে প্রকাশনার জগতে পথচলা শুরু।
স্বপ্ন ছিল দেশের বড় প্রকাশনীর মালিক হব, বইমেলায় স্টল থাকবে, আমরা লিখবো, বন্ধুরা লিখবে। সবার সহযোগিতায় হলোও তাই। ২০০৪ সাল থেকেই মেলায় অংশগ্রহণ করি। কিন্তু এসবই কি এত সহজ ছিল? না। মেলা নিয়েই বলি।
যেহেতু আমি টুকটাক কবিতা লিখি, তাই মেলায় আমার উদ্দেশ্য থাকে কবিতার বই সংগ্রহ করার। বিশেষ করে তরুণদের। মেলা চলাকালে খুব একটা সময় পাই না। এই যাই বাংলা বাজার, এই আসি স্টলে, এই যাই লেখকের কাছে সবমিলিয়ে সময় বের করতে পারি খুবই কম। মেলা যখন শেষদিকে তখন লিটলম্যাগ কর্নার থেকে কবিতার বই কিনি এ ছাড়া আরও কিছু প্রকাশনা আছে যারা তরুণদের কবিতার বই প্রকাশ করে সেখান থেকে কিনি। কিন্তু ভিন্নধারার কোনো কিছু খুঁজতে গেলেই আর পাই না।
আন্তর্জাতিক মানের বই পাই না। আমরা সত্যিই ব্যর্থ এখানে। মেলা একসময়ে বাংলা একাডেমিতে ছিল, এখন তো উদ্যান এবং একাডেমি প্রাঙ্গণ দুই জায়গায় হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি, মেলাটা এক জায়গায় চলে আসুক। যাতে করে লেখক-প্রকাশক-পাঠক সবাই আরও কাছে আসতে পারে। প্রকাশকদের ওপর এমনিতেই অনেক চাপ দেওয়া হয়। যেমন এবার ২০-২০ ফুটের একটা প্যাভিলিয়নের জন্য প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। অথচ মেলার স্পন্সর বিকাশ নামে প্রতিষ্ঠান আছে। উদ্যানের ভাড়াও দিতে হয় না। এত টাকা নেওয়ার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে পাইনি। মেলার নীতিমালাও প্রকাশকবান্ধব নয়।
আমরা ইচ্ছা করলেই বিশেষ কোনো কিছুর আয়োজন করতে পারি না। অথচ ‘বিকাশ’ মেলাতে যা ইচ্ছে করে যাচ্ছে, ঢুকতেই দর্শনার্থীদের জ্বালাচ্ছে। এটা কেমন সিস্টেম হলো! তবে এবারের মেলার কিছু কিছু দিক ভালো লেগেছে। ব্যবস্থাপনা ও ডিজাইনে কিছু পরিবর্তনের কারণে। একটা কথা না বললেই নয়, মেলা চলাকালে লেখক-প্রকাশক-পাঠক সম্পর্ক। যেটা এখনো বৈরিতার মতো। এ সময় লেখক প্রকাশকের অভিযোগ আমাকে কষ্ট দেয়।
আমি দেখি, এ সমস্যা হয় শৌখিন প্রকাশকের কারণে। এরকম প্রকাশকরা সিজনাল হয়ে থাকেন। শুধু বইমেলাকেন্দ্রিক কিছু বই করে সমস্যার সৃষ্টি করে। এতে করে আমাদের মতো প্রকাশকরা বিব্রত হন। এ থেকে উতরিয়ে যেতে হবে আমাদের। অনেকে বলে থাকেন একজন প্রকাশক থেকে যেহেতু এ বইমেলার উৎপত্তি সেহেতু মেলার আয়োজক প্রকাশকদরেই হওয়া উচিত। কিন্তু আমার মনে হয়, বাংলা একাডেমিই ভালো। কারণ, দ্বিতীয় পক্ষ এ মেলা আয়োজন করার কারণে তেমন সমস্যা হয় না। নিরাপত্তা, ব্যবস্থাপনার দায়ভার সবকিছু অন্যত্র চলে যায়, যার সঙ্গে সরকারও সংশ্লিষ্ট।
আর যদি মেলার আয়োজক প্রকাশকরা হন, তাহলে আরও বেশি বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। স্টল, ম্যানেজম্যান্ট, আর্থিক লেনদেন সবকিছুর ভেতর ঝামেলা চলে আসবে। তবে মেলার নীতিমালা পরিবর্তন করা দরকার।
প্রকাশক : ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ