আমার আক্ষেপ ও বইমেলা
খন্দকার মনিরুল ইসলাম
🕐 ১২:৪৮ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯
একটা হতাশা দিয়েই শুরু করা যাক। আমাদের প্রাণের মেলার শুরু একজন প্রকাশক দ্বারা এবং পরবর্তীতে তার বিশালাকার সৃষ্টি হয় প্রকাশকদের দ্বারাই। কিন্তু আজ মেলা প্রকাশকদের হাতে নেই। আমরা জিম্মি বাংলা একাডেমির কাছে। প্রকাশকবান্ধব মেলার আয়োজন সবার আগে জরুরি, কারণ একজন প্রকাশক বা একটা প্রকাশনাই জানে পাঠকের চাহিদা কি, পাঠক কি পড়তে ভালোবাসে, যেটা বাংলা একাডেমি জানে না। কিন্তু আমরা যদি কলকাতা বা পৃথিবীর অন্য অর্থাৎ একজন প্রকাশকই জানে তার মেলা কীভাবে আয়োজন করলে কীভাবে প্রচার করলে আরও পাঠকবান্ধব হয়।
আদতে একুশে বইমেলা এখন বাংলা একাডেমিরও নয়, প্রকাশকদেরও নয়, মেলা হয়ে গেছে বাংলা সংস্কৃতির অংশ-ঐতিহ্য। যার কারণে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে লেখক-শিল্পী-পাঠক এমনকি গণমানুষও যার যার অবস্থান থেকে প্রচার-প্রচারণা করে। আমি বলতে চেয়েছি প্রকাশকবান্ধব মেলা এখনো হয়ে ওঠেনি। মেলা উপলক্ষে যে ৩০ জনের কমিটি থাকে সেখানে মাত্র প্রকাশকদের দুই সমিতির দুইজন করে মোট চারজন প্রতিনিধি থাকে, যা খুবই সংকীর্ণ।
যাই হোক, এবার আমার নিজের কথায় আসি, সবার আগে আমি একজন পাঠক, একজন বইপ্রেমী, প্রকাশক পরে। এই পাঠকের জায়গা থেকে মেলা নিয়ে খুব আগ্রহে থাকি কখন কীভাবে বইয়ের ঘ্রাণ নিব, কিনবো, ঘুরবো, লেখক-পাঠকদের সঙ্গে আড্ডা দিব। কিন্তু একজন প্রকাশকের সবক্ষেত্রে সব হয়ে ওঠে না। ভালো বই খুঁজে পাই না।
গতানুগতিক বইয়ে ঠাসা। দেখা যাচ্ছে, এক হাসান আজিজুল হকেরই গল্পসমগ্র, নির্বাচিত গল্প, গল্পসংগ্রহ ইত্যাদি নামে বই বের হয়। যার কোনো ভিত্তি নেই। হাসান আজিজুল হকের একশ গল্পই এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে, যার যার মতো, কোনো গবেষণা ছাড়াই এসব বের করে। তেমনি সেলিনা হোসেন, হুমায়ূন আহমেদ সবার ক্ষেত্রেই। এতে করে পাঠকরা বিভ্রান্ত হয়। পাঠকদের ঠকানো হয়।
এরপর যদি আমি একটু ভিন্নধারার বই খুঁজতে চাই, তাও পাই না। এই উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এর বাইরে বইমেলায় বই পাওয়া দুষ্কর। বইয়ের কোনো ভেরিয়েশন নাই। তাই মেলা নিয়ে আমি বরাবরই হতাশ বনে যাই। অথচ কলকাতার বইমেলা! সম্পূর্ণ উল্টো।
এ সমস্যা বইমেলার না। লেখক এবং প্রকাশকেরই। আমাদের এখানে একজন প্রকাশকের পড়াশোনা নাই, এখানে একজন বাইন্ডার প্রকাশক হয়ে যায়, এখানে একজন ডিজাইনার প্রকাশক হয়ে যায়, এখানে একজন ব্যবসায়ী প্রকাশক হয়ে যায়। অথচ আমার ভাষাচিত্র এ ক্ষেত্রে অনন্য। এভাবে বলাও ঠিক না, তবে আমি গর্ব করি। সিনেমার বই করি, গানের বই করি, খেলাধুলার বই, গণমাধ্যম নিয়ে বই, চিত্রকলার বই করি অর্থাৎ সৃজনশীল বুদ্ধিবৃত্তিক বই করার চিন্তা থাকে। আমরা গুরুত্ব দেই টেক্সটকে, ছোট এবং বড় লেখক এ ধরনের কোনো চিন্তা মাথায় রাখা হয় না। তরুণদের গুরুত্ব দিতে গিয়ে। আমাদের তরুণ লেখকরা পড়তে রাজি না, গবেষণা করতে রাজি না, নিজের শিকড় চিনতে রাজি না। তারা শুধু লিখতে চায় আর জনপ্রিয় হতে চায়। যার কারণে এবার আমরা শাহাদাত হুসাইনের বই করিনি। সে চেয়েছিল তার একটা পোস্টার টাঙানো হোক, তাকে নিয়ে স্টল করা হোক, এসব আমি চাইনি। ভাষাচিত্রের আদর্শের সঙ্গে যায় না এসব।
প্রচুর বই খুঁজি আমি। পরিশ্রমের বই। শেকড়ের বই। শেকড়ের বই বলতে এরকম হতে পারে, কেউ একজন একটা উপন্যাস লিখল যার ভিত্তি ভাওয়াল রাজ্যের কোনো চরিত্র, কিংবা সিরাজউদৌলাকে নিয়ে, কিংবা লোক উপাখ্যানকে নতুন করে দেখা এসব। তাই মেলা, বই, টেক্সট সবকিছু নিয়ে আমি মোটামুটি হতাশ।
আরেকটি কথা না বললেই নয়, মেলা আসলেই লেখক-প্রকাশক বৈরিতা শুরু হয়। লেখকের বিরুদ্ধে প্রকাশকের অভিযোগ আবার প্রকাশকের বিরুদ্ধে লেখকের অভিযোগ। অথচ তা হওয়ার কথা ছিল না। লেখক-প্রকাশক এমনকি পাঠকও এ তিন সূত্র একত্র হয়েই একটা প্রকাশক পরিবার। যেখানে লেখক জানবে প্রকাশকের দুর্বলতা, সফলতা, ব্যর্থতা এবং সমস্যা। তেমনি প্রকাশককেও অবগত থাকতে হবে লেখক সম্পর্কে।
একে-অন্যের শিল্প সহযোগী না হলে প্রকাশনা গড়ে ওঠে না। নাটকের যেমন শুধু অভিনেতাই সব না, এখানে নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, মেকাপম্যান, লেখক, দর্শক সর্বোপরি একটা পারফেক্ট সেট না হলে সার্থক নাটক হয় না। প্রকাশনার ক্ষেত্রেও তেমন। তাহলে কারও ওপর কারও অভিযোগ থাকে না। একজন প্রকাশক একজন লেখকের অভিভাবকও।
প্রকাশক : ভাষাচিত্র প্রকাশনী