অনু দেখা করে গেল
সাদ কামালী
🕐 ১:১৪ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৯
বাতাস আর বৃষ্টি দেখে মনে হয় না এখনো মাঘ মাস। যদিও বাতাসে শীতের কামড় মনে করিয়ে দেয় মাঘ মাস বুড়িয়ে গেলেও ফুরিয়ে যায়নি। বন্ধ জানালা-দরজার ফাঁকফোকরে বাতাসের গোঙানি মানুষের আর্তনাদের মতো, প্রকৃতি কী শোকে দুঃখে প্রলাপ করছে! বড় বিষন্ন বড় অস্থির। মেঘ বৃষ্টি কখনো এমন করুণ করে তোলেনি আগে।
যদিও মেঘ বৃষ্টিতে এক ধরনের রোমান্টিক বিষন্ন তার অনুভূতির অভিজ্ঞতা সংবেদী বাঙালিদের কাছে নতুন নয়। সেদিনকার উপলব্ধি ছিল ভিন্ন, মনের মধ্যে বাতাস-গোঙানির চাপা কষ্ট এড়াতে পারছি না। বসার ঘরে বসে আছি, টেলিভিশন চলছে কিন্তু কান-মন অন্য কোথাও! কেন এমন লাগছে, অফিসেও যাওয়া হলো না, ১৯ মাঘ, পয়লা ফেব্রুয়ারি কী বিশেষ কোনোদিন! মনে পড়ছে না। হঠা? কলিং বেল, দরজা খুলতে খুলতে কয়েকবার বেল বাজল, সব এত অস্থির কেন! দরজা খুলে দেখি অনু, বন্ধু অনু হোসেন, হাতে একটা বই- বানানের রবীন্দ্রনাথ। মনটা খুশিতে ভরে গেল। হঠাৎ মনে হলো গতকাল রাতে এই বই আমার বিছানার ওপর ছিল না!
বলি কী ব্যাপার এই সময়ে আপনি, তাড়াতাড়ি বসেন টাওয়েল আনছি। কিন্তু না ও এক দম শুকনো, অফিসে যাওয়ার পথে গাড়িতে আসছে হয়তো। কিন্তু ওর শরীর তো খুব খারাপ, অফিস করার কথা নয়। আকাশি রঙের ফুল শার্ট, অব হোয়াইট ড্রেস প্যান্ট, কালো জুতা, পাতলা চুলেও চিরুনির সেবা বাদ পড়েনি। ছয় ফুটের বেশি লম্বা অনু সব সময় যেন খুব ফরমাল, এমনি আমাদের চিরকালের ফিটফাট অনু। বলি গ্রিন টি করে আনি। অনু বলে না না আমি এখনি উঠব, শুধু বলতে আসছি রবীন্দ্রনাথ কখনো সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের বিরোধিতা করেননি বরং বানান ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মসিদ্ধ হতে বলেছেন, ওই সব শব্দের ক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সুযোগে কিছু বলতে গিয়ে দেখি অনু দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে।
কথা বন্ধ করে ওর হাতে পানির গেলাস তুলে দেই, আচ্ছা পরে কথা হবে, পানি খেয়ে নেন। অনুর ঠোঁট চোখ ঘিরে মায়াময় হাসি ফোটে। একটা হাত আমার হাতের ওপর রাখে, ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শে আমার ভেতরটা কেঁপে যায়। বলে, কাল হাসপাতালে আপনাকে দেখলাম না। তাই বুঝি দেখা করতে এলেন!
বানান বিষয়ে আমাদের যে কথা হচ্ছিল। অনু থেমে যায়, হাঁপিয়ে ওঠাটা আড়াল করতেই থেমে নেওয়া। বলি, পরে কথা হবে কর্নেল, এখন নীরবতা, কিন্তু অনু বলবেই, ভুলের ছোট-বড় নেই, ভুল ভুলই, আমি চোখ ফেরাই না ওর ওপর থেকে, শান্ত ধীর কিন্তু কী গভীর প্রত্যয় ওর কণ্ঠে! নির্ভুল শুদ্ধ পরিচ্ছন্ন এবং সময়ানুবর্তিতায় অনু অবিচল।
বাতাসে বৃষ্টির প্রকোপ আরও বাড়ে, বেডরুমে আমার ফোন বেজে চলছে। বলি, ফোনটা ধরি। অনু খোলা চোখে তাকায়, দৃষ্টিতে কেমন বিহ্বলতা, ফোন বন্ধ হয়ে আবার বাজছে, এবার সত্যিই উঠে বেডরুমে যাই, কে এত ফোন করছে! তখন বাতাসের ঝাপটায় বসার ঘরের জানালা খুলে যায়, তবু আগে ফোন ধরি, বিছানার ওপর বানানের রবীন্দ্রনাথ বইটি নেই! ফোনের ওপারে সরকার আমিনের শান্ত কণ্ঠ, আজ ভোর ৫টা ২২ মিনিটে আমাদের অনু চির শান্তির ঘরে চলে গেছে হাত থেকে ফোনটা ফেলে বসার ঘরে ছুটে আসি।
ঘরে কেউ নেই, শুধু খোলা জানালা দিয়ে কাঁঠালবাগানের বাতাস বৃষ্টির ছাঁট আমার ঘর ভিজিয়ে দিচ্ছে!