শক্তি ও সুনীলের সাক্ষ্য
হাংরি জেনারেশন
সংগ্রহ ও ভূমিকা মলয় রায়চৌধুরী
🕐 ১২:১৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৮, ২০১৯
হাংরি জেনারেশন যখন আদালত পর্যন্ত গড়ায় তখন কেউ পক্ষে ছিল, কেউ বিপক্ষে ছিল। সবাইয়ের সাক্ষ্য ছিল বেশ মজাদার, যাকে বলে কোর্টরুম ড্রামা। তেরোটা আদালতঘরের মধ্যে আমার মকদ্দমাটা ছিল নয় নম্বর এজলাসে। অনেকেই আমার পক্ষে-বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সুনীলকে দাদা অনুরোধ করার পর রাজি হন। কিন্তু তরুণ সান্যাল ও জ্যোতির্ময় দত্ত স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছিলেন আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে। মামলার সময়ে কলকাতায় রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। সুবিমল বসাকের স্যাকরা জ্যাঠামশায়ের দোকানে রাতে আশ্রয় নিতুম আর শেয়ালদায় গিয়ে দূরপাল্লার ট্রেনে হাগতুম। সকলের সাক্ষ্য এখানে তুলে দিলে পাঠকের পড়ার ধৈর্য থাকবে না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যিনি চব্বিশে জুন ১৯৬৫ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যিনি পাঁচুই নভেম্বর সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।
কয়েকজন মিলে আন্দোলনটা আরম্ভ করি
পেশকার : এই নিন, গীতার ওপর হার হাত রাখুন। বলুন, যা বলব ধর্মত সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না, কিছু গোপন করব না।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : যা বলব, ধর্মত সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না, কিছু গোপন করব না।
পেশকার : নাম বলুন।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
বিচারক অমল মিত্র : আপনি কী করেন?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : আজ্ঞে, লিখি।
বিচারক অমল মিত্র : কী কাজ করেন তাই বলুন। হোয়াট ইজ ইয়োর লাইভলিহুড?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : লেখালিখিই করি। এটাই জীবিকা।
পাবলিক প্রসিকিউটার : আচ্ছা মিস্টার চ্যাটার্জি, আপনি তো একজন বিএ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : হ্যাঁ, পরীক্ষা দিয়েছিলাম।
বিচারক অমল মিত্র : আপনি বিএ কি না তাই বলুন। আপনি কি একজন স্নাতক?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : আজ্ঞে না।
পাবলিক প্রসিকিউটার : আপনি তো প্রথম থেকে হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই না?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : ছিলাম।
পাবলিক প্রসিকিউটার : কীভাবে ছিলেন সেটা ইয়োর অনারকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : সমীরের ছোট ভাই মলয় ইংরেজ কবি চসার আর জার্মান ফিলোসফার অসওয়াল্ড স্পেংলারের আইডিয়া থেকে একটা নন্দনতত্ত্ব দিয়েছিল। সেই আইডিয়া ফলো করে আমরা কয়েকজন মিলে আন্দোলনটা আরম্ভ করি।
পাবলিক প্রসিকিউটার : আসামি মলয় রায়চৌধুরীকে তাহলে চেনেন? কবে থেকে চেনেন?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : হ্যাঁ চিনি। অনেক কাল থেকে।
পাবলিক প্রসিকিউটার : কীভাবে জানাশোনা হলো?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : ওর বড় ভাই সমীর আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সমীরের চাইবাসার বাড়িতে থাকার সময়ে আমি প্রচুর লিখতাম। সেই সূত্রে মলয়ের সঙ্গে ওদের পাটনার বাড়িতে পরিচয়।
পাবলিক প্রসিকিউটার : কারা কারা এই হাংরি জেনারেশন আন্দোলন আরম্ভ করেন?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরী ওর বড় ভাই সমীর রায়চৌধুরী হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়, উৎপলকুমার বসু আর আমি। ছাপা-টাপার খরচ প্রথম থেকে ওরা দুই ভাইই দিয়েছে। পরে আরও অনেকে যোগ দিয়েছিলেন, তাদের নাম বলব কি?
পাবলিক প্রসিকিউটার : তা আপনি যখন পায়োনিয়ারদের একজন, তখন এই আন্দোলনের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখলেন না কেন?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : এমনিই। এখন আমার লেখার কাজ অনেক বেড়ে গেছে।
বিচারক অমল মিত্র : ইউ মিন দেয়ার ওয়াজ এ ক্ল্যাশ অব ওপিনিয়ন? নট ক্ল্যাশ অব ইগো আই সাপোজ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : আজ্ঞে হ্যাঁ। তা ছাড়া এখন আর সময় পাই না।
পাবলিক প্রসিকিউটার : কত দিন হলো আপনি হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে যুক্ত নন?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : প্রায় দেড় বছর।
পাবলিক প্রসিকিউটার : দেখুন তো হাংরি জেনারেশনের এ সংখ্যাটা পড়েছেন কি না?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : পড়েছি। কবিতা পেলেই পড়ি।
পাবলিক প্রসিকিউটার : ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা পড়েছেন কি?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : হ্যাঁ, কবিতাটা আমি পড়েছি।
পাবলিক প্রসিকিউটার : পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : ভালো লাগেনি।
পাবলিক প্রসিকিউটার : ভালো লাগেনি বলতে আপনি অবসিন...
ডিফেন্স কাউনসেল : আই অবজেক্ট টু ইট ইয়োর অনার। হি কান্ট আস্ক লিডিং কোয়েশ্চেন্স ইন সাচ আ ওয়ে।
পাবলিক প্রসিকিউটার : ওয়েল, আই অ্যাম রিফ্রেজিং দি কোয়েশ্চেন। আচ্ছা মিস্টার চ্যাটার্জি, ভালো লাগেনি বলতে আপনি কী বলতে চাইছেন?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : ভালো লাগেনি মানে জাস্ট ভালো লাগেনি। কোনো-কোনো কবিতা পড়তে ভালো লাগে, আবার কোনো-কোনো কবিতা আমার ভালো লাগে না।
বিচারক অমল মিত্র : সো দি ডিফারেন্স অব ওপিনিয়ন ওয়াজ বেসড অন লাইকস অ্যান্ড ডিসলাইকস। হেয়ার ইউ মিন দি পোয়েম ডিডন্ট অ্যাপিল টু ইয়োর ইসথেটিক সেনসেস?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : ইয়েস স্যার।
পাবলিক প্রসিকিউটার : দ্যাটস অল।
ডিফেন্স কাউনসেল : ক্রসিং হবে না।
আন্দোলন সম্পর্কে প্রথম থেকেই জানি
পেশকার : এই বইটার ওপর হাত রাখুন এবং বলুন, যা বলব সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : যা বলব সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না।
পেশকার : আপনার নাম?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
ডিফেন্স কাউনসেল : আপনি কী করেন?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : আমি আনন্দবাজার পত্রিকায় ফিচার লিখি।
ডিফেন্স কাউনসেল : শিক্ষা?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষায় এমএ।
ডিফেন্স কাউন্সেল : আপনার লেখা কোথায় প্রকাশিত হয়?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : আমি দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, পূর্বাশা এবং আরও অনেক পত্রিকায় লিখি। পূর্বাশায় আর প্রকাশিত হয় না। আমার অনেকগুলো বই আছে, তার মধ্যে একটার নাম ‘বরণীয় মানুষের স্মরণীয় বিচার’। আমি অনেক কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস লিখেছি।
ডিফেন্স কাউনসেল : আপনি মলয়ের কবিতাটা পড়েছেন?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : হ্যাঁ, অনেকবার।
বিচারক অমল মিত্র : আরেকবার পড়ুন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : জোরে-জোরে পড়ব না মনে-মনে?
বিচারক অমল মিত্র : না-না, মনে-মনে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : হ্যাঁ, পড়ে নিলুম।
ডিফেন্স কাউনসেল : পড়ে কি অশ্লীল মনে হচ্ছে?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : কই না তো। আমার তো বেশ ভালো লাগছে পড়ে। বেশ ভালো লিখেছে।
ডিফেন্স কাউনসেল : আপনার শরীরে বা মনে খারাপ কিছু ঘটছে?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : না, তা কেন হবে? কবিতা পড়লে সেসব হয় না।
ডিফেন্স কাউনসেল : দ্যাটস অল ইয়োর অনার।
পাবলিক প্রসিকিউটার : আপনি এই ম্যাগাজিনের বিষয়ে কবে থেকে জানেন?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : ওদের আন্দোলন সম্পর্কে আমি প্রথম থেকেই জানি।
পাবলিক প্রসিকিউটার : আপনি ওই জার্নালে লিখেছেন?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : না, লিখিনি কখনো।
পাবলিক প্রসিকিউটার : আপনি ওরকম কবিতা লেখেন?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : পৃথিবীর কোনো দুজন কবি একই রকম লেখেন না, আর একই রকম ভাবেন না।
পাবলিক প্রসিকিউটার : কবিতাটা কি অবসিন?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : না। ইট কনটেইনস নো অবসিনিটি। ইট ইজ অ্যান এক্সপ্রেশান অব অ্যান ইমপর্ট্যান্ট পোয়েট।