স্পার্ক জেনারেশনের স্ফুলিঙ্গ
শিশির দত্ত
🕐 ১১:৪৪ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৮, ২০১৯
স্পার্ক জেনারেশন স্বাধীন বাংলাদেশের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। কেননা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে প্রথম যে সাহিত্য আন্দোলন হয়েছিল সেটাই স্পার্ক জেনারেশন। যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল আমাদের ভাবনা-চিন্তাকে প্রকাশ করা এবং প্রথাগত যে রীতিতে পরিচালিত হচ্ছে বিশেষ করে গল্প কবিতায় যে ধারা তার মধ্যে বিশেষ একটা পরিবর্তন নিয়ে আসা। কবিতাকেই জোর দিয়েছিলাম প্রথমে। পরে সাহিত্যের সব শাখায় জোর দেই। আমরা বিট, হাংরি এমনকি স্যাড জেনারেশনকেও অনুকরণ করিনি। আমাদের চাওয়া ছিল, নতুন দেশের জন্য নতুন সাহিত্য।
চট্টগ্রামের স্পার্ক জেনারেশনের পরে এবং সেটার প্রভাবে দেশের অঞ্চলগুলোতেও প্রভাব পড়ে। কুমিল্লা, বরিশালে থেকেও আমাদের সাথে অনেকেই যোগাযোগ রেখেছেন। এমনকি সেখানেও তারা সংঘবদ্ধ হয়েছিল। তার মানে একটা পজেটিভ জায়গায় আমরা পৌঁছাতে পেরেছিলাম। স্বপন দত্ত এখান থেকে ‘ইঁদুর’র মতো কবিতা লিখেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আমরা আমাদের আন্দোলনের মাধ্যমে সামাজিক সাংস্কৃতিক জায়গাগুলোকে প্রাণ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।
হেনা ইসলাম, স্বপন দত্ত, আমি, শহীদ ইকবাল মিলে প্রথমে এটা শুরু করার চিন্তা করেছিলাম। এরপর যুক্ত হলেন- কাজী রফিক, শেখ খুরশিদা সামাদসহ অনেকে। তখন আমরা চোখের সামনে পাচ্ছি সব ট্র্যাডিশনাল লোকদের। শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা তুমি কিংবা গুণের হুলিয়া কবিতা আমাদের অণুপ্রাণিত করেছো। কিন্তু আমরা চাচ্ছিলাম স্বাধীনতার পরে নতুন করে কিছু সৃষ্টি করা, নতুন সাহিত্য, নতুন সংস্কৃতি, নতুন ভাবনা। এবং সেটার প্রভাব কোনো না কোনোভাবে আমরা রেখেছি।
অনেকে আমাদের বলতো, আমরা কেন স্পার্ক। নাম করার উদ্দেশ্যটা ছিল এমন, আমাদের আন্দোলনটা যেন বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা যারা এ আন্দোলন শুরু করেছি সবার বয়স ছিল ২০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে। একেবারে তাগড়া তরুণ আর কি। এসব তরুণরা তাদের সমকালীন বিভিন্ন মতাদর্শ থেকে এসে এই সাহিত্য আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। এদের কেউ ছিলেন বামপন্থী মতাদর্শ অনুসারী, কেউ ছিলেন ছাত্রলীগের অনুসারী বা কর্মী, কেউবা ছিলেন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি যে পুরাতন এস্টাবলিশমেন্ট ভূতের মতো দাঁড়িয়েছিল তখন আমাদের মনে তাকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে তোলার স্পৃহা প্রবলভাবে জেগে উঠেছিল। নেতা, রাষ্ট্র, ভাষা ও দেশকে একই সাথে মুক্ত দেখতে পেয়ে আমাদের মধ্যে সমুদ্রের জোয়ারের মতো উৎসাহ জেগেছিল।
ময়ূখ চৌধুরীও আমাদের সাথে থাকার কথা ছিল কিন্তু আসেনি। ওদের একটা পৃথক আড্ডা ছিল। ওরা আসতো-আমরাও যেতাম। কিন্তু আমাদের মধ্যে কোন ধরনের বৈরিতা ছিল না। প্রথম যখন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আমরা একটা অনুষ্ঠান করি। তখন আমাদের অনুষ্ঠানের সভাপতির আসন খালি ছিল। কারণ আমরা তখন সেই অনুষ্ঠানে সভাপতি বানানোর মতো কাউকে খুঁজে পাইনি। আমরা চাইছিলাম পরবর্তীতে কেউ এসে সেটার নেতৃত্ব দেক। কিন্তু সেটা আর পরে হয়ে উঠলো না।
আমাদের কিছু ইশতেহার ছিল। এবং আমরা নিয়মিত পুস্তিকা বের করতাম। আমাদের জেনারেশনকে ‘ক্রাস জেনারেশন’ বলে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক শক্তি আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারও করেছিল। এবং আমাদের কেউ কেউ আক্রমণেরও শিকার হয়েছিল।
চট্টগ্রামে তখনো খণ্ড খণ্ডভাবে সাহিত্য সংগঠন ছিল। তাদের সমালোচনায় কখনো পড়িনি। আমরা সবাইকে লেখার সুযোগ করে দিতাম। আমাদের যে পত্রিকা ছিল সেটাতে রফিক আজাদ, কামাল চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী সবাই লিখতেন এবং আমাদের প্রচুর সহযোগিতাও করতেন। মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণও।
প্রশাসনিকভাবে আমরা তেমন কোন বাধার সম্মুখীন হইনি। তবে আমাদের কার্যক্রমের উপর একটা নজরদারি ছিল। কারণ আমাদের আন্দোলনটা স্পার্কের মতোই দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। এবং সংঘবদ্ধ হচ্ছিলাম।
১৯৭৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় স্পার্ক জেনারেশন নামের প্রথম সাহিত্য সাময়িকীটির প্রথম সংখ্যা। এতে কবিতা ও সাহিত্যবিষয়ক লেখা মুদ্রিত হওয়ার পাশাপাশি এই আন্দোলনের মেনিফেস্টো হিসেবে ৭টি ঘোষণাও ছাপা হয়। এটি প্রকাশিত হওয়ার পর শুধু চট্টগ্রামে নয়, আলোচনার ঝড় ওঠে সদ্যস্বাধীন পুরো বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে। এতে প্রকাশিত হয়েছিল ৭টি ঘোষণা। এর মধ্যে- ‘আমরা ঈশ্বরের ভাষায় কথা বলি।/জ্ঞানপাপীরা নিপাত যাক।’ ‘দুঃখ যন্ত্রণা অবক্ষয় ক্ষুধা থেকে/সকলকে আমরা মুক্তি দেবো।/’‘আমরা আত্মার ক্রন্দনকে প্রতিফলিত/ করছি কোরবো।’ ন্যতম ছিল।