ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ঢাকাইয়া সংগীত

ছাদ পেটানো গান

শিমুল জাবালি
🕐 ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১৮, ২০১৯

মুঘলপূর্ব যুগ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার সংস্কৃতি চর্চায় এক ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। এ এক অন্যরকম, কিছুটা গ্রামীণ কিছুটা শহুরে ভাবধারার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল একটি স্বতন্ত্র ঢাকাই সংস্কৃতি।

আদি ঢাকাই বাসিন্দারা প্রাক মুঘল আমল থেকেই পুঁথি ও কেচ্ছা পাঠ, মুর্শিদি গান, বন্দনা সংগীত, কীর্তন, বিয়ের গান, শোক ও বিচ্ছেদের গান, ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবাদিতে পালাগান ও জারিগান পরিবেশনের মাধ্যমে নিজেদের অগোচরে গড়ে তুলেছিল এক মৌলিক ঢাকাই সংস্কৃতি।

নগর সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠল যাত্রাপালা, বাইজী ও হিজড়াদের নাচ এবং থিয়েটার। এর পাশাপাশি ঢাকায় গড়ে উঠেছিল সংগীতের এক চমকপ্রদ ধারা। ছাদের উপর জলছাদ নির্মাণের উপলক্ষে সৃষ্টি হয়েছিল নতুন এক পেশাদার শ্রেণি। আর এদের হাত ধরেই গড়ে উঠে ঢাকাই সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ ধারা ‘ছাদ পেটানো গান’।

১৬১০ সালে যখন ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানী হয় তখন ব্যাপকহারে দিল্লি থেকে নতুন বহিরাগতের দল এসে বসতি গড়ে তোলে। শুধু দিল্লি নয় অন্যান্য অঞ্চল থেকেও আগমন ঘটে বহিরাগতদের। লাখ লাখ ভিনদেশি মানুষ ভাগ্যান্বেষণের আশায় ঢাকায় এসে নিজেদের বাস খুঁজে নেয়। যার ফলে ঐ আমলে ঢাকা পরিণত হয় বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে। যার প্রমাণ মিলে ১৬৫০ সালে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নগরীর তালিকায় ঢাকার ২৮ তম-তে চলে আসা যা ১৭০০ সালে ১২ তম-তে এসে ঠেকে।

অধিক গুরুত্বের কারণে মুঘল আমল থেকে ঢাকায় ব্যাপকহারে ইমারত, দেউড়ি, কাটারা, খানকা, মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও ঈদগাহ গড়ে ওঠে। জাফরি ইট, চুন আর সুরকির মিশ্রণ গাঁথুনি ও দেয়াল এবং কাঠ ও লোহার সাতিরের উপর জাফরি ইট বিছিয়ে তার উপর সুরকির গুঁড়া ও চুনের মিশ্রণে যে আস্তরণ তৈরি করা হতো সেটি আবার ছাদের উপর ঢালাই দেওয়া হতো। এটাকে বলা হতো জলছাদ। তখনো পর্যন্ত দালানকোঠা নির্মাণে সিমেন্টের প্রচলন হয়নি। এই জলছাদ নির্মাণের জন্য ঢাকায় আবির্ভাব হয় এক নতুন পেশাদার শ্রেণির। যাদের মধ্যে যেমন ছিল কিশোর থেকে বৃদ্ধ বয়সী লোক আবার তেমন ছিল নারী ও কিছু তৃতীয় লিঙ্গ। জলছাদ নির্মাণে যাতে কোন একঘেয়েমি না আসে এবং কাজের মনোযোগ রক্ষার্থে সারিবদ্ধভাবে এসব শ্রমিকরা এক সর্দারের নেতৃত্বে গানের আসর বসাত। কাঠের মুগুর দিয়ে সারা দিন পিটিয়ে সেই জলছাদ শক্ত করত তারা। এ সময় দেখা যেত দলের নেতা থুঁতনির কাছে একটি বেহালা নিয়ে নানা ধরনের গান ধরছে আর ছাদ পেটানো দলের বাকি সদস্যরা গানের সুরে তালে তালে ছাদ পেটাচ্ছে। কাজে ক্লান্তি অবসাদের দাওয়াই হিসেবে ছাদ পেটানো গান ছিল যথোপযুক্ত হাতিয়ার। ছাদ পেটানোর শব্দের সাথে অদ্ভুত কিসিমের ছন্দ আর কথার মারপ্যাঁচে অপার্থিব এক ধ্বনির সূচনা হতো।

কিছু ছাদ পেটানো গানের কথা ছিল অশ্লীল নয়তো সাধারণ প্রেমের গানের মতো। এসব গানে না ছিল কোন জটিলতা না ছিল কোন ধরনের ভাবগাম্ভীর্যতা। কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না এসব গানের আসরে, ছিল না কোন পেশাদার শিল্পী। ছাদ পেটানো গানের শিল্পীই ছিল শ্রমিক আর সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ যারা কিনা তখনো পর্যন্ত জানেনি তারা গোড়াপত্তন করে বসে আছে বাংলা সংগীতের এক অনন্য ধারা।

বাংলা চলচ্চিত্র চৌরঙ্গী-তে ছাদ পেটানো গানের কথা কাজী নজরুল ইসলাম উল্লেখ করেছেন। তার লেখা গানটি এই, ‘সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ গো/সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ।/পাত ভরে ভাত পাই না, ধরে আসে হাত গো।/ সারাদিন পিটি কার দালানের ছাদ।’

গায়ক সর্দার যখন গান ধরত তখন পরের কোরাস গাওয়ার জন্য দলের সদস্যদের আহ্বান করত। নিজের কণ্ঠ যখন নীরব হয়ে যেত ঠিক তখনই ছাদ পেটানো বালকের দল ছাদ পেটানোর সাথে সাথে গানের অবশিষ্ট অংশ সমস্বরে গেয়ে উঠত। ছাদ পেটানো শব্দের সাথে ছাদ পেটানো গান শুনতে উৎসুক জনতা প্রায়ই নির্মাণাধীন ইমারতের আশপাশে ভিড় জমাতো। গানের রচয়িতার ব্যক্তিগণ সুখ-দুঃখ প্রায়ই ছাদ পেটানো গানে ফুটে উঠত। লোকবিজ্ঞানী আশরাফ উদ্দিনের মতে, অনেকসময় ছাদ পেটানো গানে ইতিহাসের চুম্বক ঘটনার সন্ধান মিলত। একটি ছাদ পেটানো গানের লাইন এরকম, ‘বিয়া না দিলে দাদা দেশে যামু না/কসম খাই তোর জরুরে নজর দিমু না,/দাদায় শোয় টিনের ঘরে/আমি শুই সনের ঘরে/দাদার ঘরে খচমচ করে/মন তো মানে না;/বিয়া না দিলে দাদা দেশে যামু না।’
অনেক সময় গানে হাসি তামাশা প্রধান হয়ে উঠত। এ সময় দেখা যেত ছাদ পেটানো দলের মধ্যে অন্য ধরনের উদ্যম কাজ করছে। একটি গান এ রকম, ‘জজ সাহেবের টেরি মাইয়া পেখম মেইলাছে,/মহব্বতের রশির টানে/উধাও হইয়াছে।/কেলাস নাইনের ছাত্রী আছিল,/গতর-শোভা ভালাই আছিল।/কেম্বে কমু হগল কথা/সরম অইতাছে।/জজ সাহেবের টেরি মাইয়া/পেখম মেইলাছে।’ সারাদিন ক্লান্তিকর পরিশ্রম শেষে যখন ছাদ পেটানো দলকে তাদের মজুরি প্রদান করা হত তখন শেষতক আনন্দে আরো কিছু গান হয়ে যেত। টাকা প্রাপ্তির পর কিংবা মালিকপক্ষ থেকে অতিরিক্ত উপহারাদি পেলে আরো জোরসে বাজত ছাদ পেটানো গানের প্রতিটি সদস্যের গলা।

ছাদ পেটানো গানের বিলুপ্তি
সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল, নতুন সংস্কৃতির তোপে চাপা পড়ে যাবে পুরনো সংস্কৃতি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তৈরি হবে, ভেঙে যাবে ঐতিহ্য, নবাগত সংস্কৃতিকে গ্রহণই হয়ে উঠবে অবশ্যম্ভাবী।
এমন সব নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়ে ইমারত নির্মাণে ঢাকায় আবির্ভাব হয় অধিকতর নতুন কাঁচামাল সিমেন্টের। আর তারই সাথে আবেদন কমে যায় ছাদ পেটানো দলের। সাথে করে হারিয়ে যায় বাংলা গানের এক ধ্রুপদী ধারা ছাদ পেটানো গান।

 
Electronic Paper