ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মগ্নতার পাঠ

চার দেশের রাজনীতি

হামিদ কায়সার
🕐 ১২:২৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১১, ২০১৯

আজকাল মাঝেমধ্যেই ফেসবুকে ভেসে উঠছে ইয়েমেনের জীর্ণকঙ্কালসার মৃতপ্রায় মানুষের ছবি, মুখ, ভগ্নদশা। পড়শি দেশ সৌদি আরবের বিষোদগারের কারণেই যে দেশটির আজ অর্থনৈতিক চরম দুরবস্থা, তা জানতে বাকি নেই কারো! কিন্তু কবে থেকে এ সংকটের শুরু, কীভাবে এই প্রতিবেশী দেশ দুটি শত্রুভাবাপন্ন হলো-এসব খবর আমরা কি কেউ জানি? জানলেও কতটুকু!

আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগে নাদিরা মজুমদারের একমেরু বনাম বহুমেরু বইটি পড়ে, যতটুকু না মুগ্ধ হয়েছি চমকিত হয়েছি তার চেয়ে বেশি। কেননা এ বইটি পড়ার পর ইয়েমেন সম্পর্কে এমন সব নতুন তথ্য জানতে পারলাম, সেই সুবাদে সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলসহ পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্কের মেরুকরণের খবর, যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। বইটিতে যে শুধু ইয়েমেনকে ঘিরে বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট আলোচনা হয়েছে তা নয়, ইয়েমেনের সঙ্গে সঙ্গে আলোকপাত হয়েছে ইউক্রেন, ইরান ও সিরিয়ার ঘটনাক্রম। ফলে বইটি পড়ে শুধু ওই চারটি নির্দিষ্ট দেশ নয়-বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কেও সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।

একটা সময় বিশ্বের রাজনীতি ছিল দুটি শিবিরে বিভক্ত-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হিসেবে একদিকে শক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে পরাক্রমশালী সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুটি দেশই ছিল পারমাণবিক শক্তিতে সমান বলীয়ান। কে মহাকাশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, কে বিশ্বের অন্য দেশে নিজের প্রভাব বজায় রাখতে পারছে মূলত সেসব বিষয় নিয়েই ছিল তাদের ঠাণ্ডা লড়াই। কিন্তু কম্যুনিজমের ভরাডুবির কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর একক শক্তি হিসেবে আবির্ভাব ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। বদলে যায় বিশ্বরাজনীতিরও খোলনলচে। দুই পরাশক্তির উত্তেজনা প্রশমিত হলেও তৈরি হয় ভিন্নতর অরাজকতা ও সংকট। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।

আপাতদৃষ্টিতে ওপর থেকে মনে হতে পারে, কম্যুনিজমের পতনের পর এবার বুঝি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামের বিরুদ্ধাচরণে নেমেছে, আসলে যে ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে অন্য কারণ, সেটিই গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন নাদিরা মজুমদার। লেখক তার চারটি নিবন্ধে ইয়েমেন, ইউক্রেন, ইরান, সিরিয়ার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ইতিহাস ও টানাপড়েন আর সংকটের কাহিনী তুলে ধরে দেখিয়েছেন এর প্রতিটির পেছনেই রয়েছে মোড়ল দেশগুলোর নিজস্ব স্বার্থ, জ্বালানি সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, আধিপত্য বিস্তারের লোলুপতা। আজ বিশ্বের কোথাও এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের যুদ্ধ নেই। ঘোড়া দাবড়িয়ে এক দেশের শাসক যায় না আরেক দেশের রাজকোষাগার লুণ্ঠন করতে। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ানক কী এক অদৃশ্য যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয় মানুষের জীবন-নাদিরা মজুমদার সেই প্রেক্ষাপটকেই দৃশ্যমান করতে চেয়েছেন।

প্রথম নিবন্ধ ‘ইয়েমেনের হালহকিকত’-এর কথাই ধরা যাক। ইয়েমেনের সংকটকে অনুধাবনের জন্য লেখিকা প্রথমেই গল্পের ছলে আমাদের জানান বিস্তৃত তথ্যাদি। যা শুধু প্রাসঙ্গিকই নয়, জরুরিও। ‘৬৩০ সালে হজরত মুহাম্মদ (স.) বিশেষ দূত হিসেবে হজরত আলীকে (রা.) ইয়েমেনে পাঠিয়েছিলেন। বর্তমানে কমবেশি ছাব্বিশ মিলিয়ন জনসংখ্যার আধুনিক ইয়েমেন, মধ্যপ্রাচ্যের দরিদ্রতম ও ঘনজনবসতিপূর্ণ দেশ। এককালের আল-কায়েদাশূন্য দেশটি বর্তমানে পৃথিবীর সহিংসতম দেশের দলে পড়েছে।’ নাদিরা মজুমদার ইয়েমেনের ভৌগোলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাস তুলে ধরে দেখিয়েছেন কীভাবে প্রতিবেশী দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো এবং কীভাবে ইয়েমেন জড়িয়ে পড়ল আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কূটচক্রে।

সৌদি আরবের সঙ্গে ইয়েমেনের রাজনৈতিক ও সামরিক সংকটের সূচনা হয় ১৯৩২ সালে সৌদি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর। শুরু থেকেই দুটি দেশের মধ্যে সীমানা নিয়ে ঝামেলা ছিল। সীমানার কিছু অংশ নির্ধারণ করা হয়ে উঠেনি নানা জটিলতায়। পরে যখন ইয়েমেনের এই সীমান্ত অংশে তেল আবিষ্কৃত হয়-সৌদি আরব এই অংশ দাবি করে বসলো, সংকট হলো আরো ঘন। এই সংকট জিইয়ে থাকে উত্তর ইয়েমেন এবং দক্ষিণ ইয়েমেনের পরস্পর দন্ধ এবং সংঘাতের কারণে। দুই ইয়েমেনকে ঘিরে দেখা যায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে আলাদা বলয়। পরে যখন দুই ইয়েমেন একীভূত হয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্র সৌদি আরব তা ভালোভাবে নিতে পারেনি।

এরপর, ইরাক যখন কুয়েত আক্রমণ করে বসলো, ইয়েমেন ইরাকের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে নীরবতা পালনের কারণে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের কোপানলে পড়ে। তদুপরি, সৌদি আরব থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তেল রপ্তানির জন্যও প্রয়োজন হয় ইয়েমেনের অঞ্চল; এমনি ধরনের নানা সমীকরণ হিসাব-নিকাশের ঘোর প্যাঁচে সৃষ্ট হয়েছে আজকের অবস্থা।

যা বৈশ্বিক রাষ্ট্রগুলোর আন্তঃসম্পর্ককেও জটিল করেছে। যেমন, ইয়েমেন আক্রমণের জন্য সৌদি বাদশাহ সরাসরি নওয়াজ শরিফের কাছে পাকিস্তানি সৈন্য চাইলে, সে সৈন্য না দেওয়াতে দুটি দেশের সম্পর্কে তৈরি হয় টানাপড়েন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তেল সরবরাহের জন্য ইরান পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে পাইপ লাইন নির্মাণ করতে গেলে বাধা দিয়ে ওঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইয়েমেনের রাজনৈতিক সংকট শেষ পর্যন্ত কেবল নিজের দেশের থাকে না, মধ্যপ্রাচ্য থেকে তা বৈশ্বিক সংকটে রূপ পায়। ইয়েমেনকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি যে কত জটিলতর নাদিরা মজুমদারের লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি, ‘ইয়েমেনি গৃহযুদ্ধের সময় (১৯৯৪ সাল) রিপাবলিকানপন্থীদের বিরুদ্ধে সৌদিরা যখন হস্তক্ষেপ করে, ইসরায়েল তখন সামরিক সাহায্য, উপদেষ্টা, অপারেটিভ এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সৌদিদের সাহায্য করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং পাকিস্তানও সে সময় সৌদি আর ইসরায়েলের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছে।’

‘ইরান, ইরানি-চুক্তি ও ভূরাজনীতির কৌশল’ এবং ‘সিরিয়া সংকট’ নিবন্ধ দুটিও বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহী পাঠককে চিন্তার খোরাক জোগাবে। যারা সাম্প্রতিক বিশ্বের রাজনীতির গতিপ্রবণতা ও লক্ষণগুলো সুবিস্তৃতভাবে জেনে নিতে চান তাদের জন্য ‘একমেরু বনাম বহুমেরু’ তথ্যের বিশাল আকরই। নাদিরা মজুমদারের ভাষা প্রাঞ্জল। বর্ণনা বেশ গতিময়। কখনো কখনো তো এসে গেছে ওয়েস্টার্ন ধাঁচও। বইটির প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স।

 
Electronic Paper