মধ্যযুগের চট্টগ্রাম দখলের লড়াই
সাইদ রহমান
🕐 ১২:১৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১১, ২০১৯
চট্টগ্রাম। ইতিহাসের পাতায় বাংলার প্রবেশদ্বার যাকে বলা হয়। প্রায় সকল ঔপনিবেশ এ চট্টগ্রাম দিয়েই বাংলা তথা ভারতবর্ষে এসেছে। কেউ কেউ রাজত্ব কায়েম করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। আবার কেউ কেউ থেকে গেছে। মিশে গেছে মাটির সাথে। ১৫৩৮ সাল। বাংলায় শুরু হয়েছিল পাঠান আফগানদের রাজত্ব। আফগান নেতা শের খান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহকে যুদ্ধে পরাজিত করে প্রথম গৌড় দখল করেন।
১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ পর্যন্ত মুঘলদের কাছে পরাজিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দাউদ খান কররানী ছিলেন বাংলার শেষ আফগান শাসক। এ সময় আফগানদের রাজ্যসীমা দক্ষিণ চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৫৭৬ সালে মুঘল সেনাপতি খান জাহানের কাছে দাউদ খান পরাজিত হলে পুরো চট্টগ্রাম ত্রিপুরা এবং আরাকান রাজদের লোলুপদৃষ্টিতে পড়ে। আর এরই সাথে শুরু হয় চট্টগ্রাম দখলের চোর-পুলিশ খেলা। গোলমাল বাঁধে ত্রিপুরা এবং আরাকান রাজ্যদ্বয়ের মধ্যে। শুরু হয় চট্টগ্রাম দখলের লড়াই।
মুঘলদের হাত থেকে বাংলা বেহাত হওয়ার ফলে চট্টগ্রামে যে একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিরক্ষা ছিল তা ভেস্তে যায়। সমসাময়িক সময়ে ত্রিপুরা এবং আরাকান দুই রাজ্যেই পরম সাহসী দুই রাজার উত্থান হয় এবং দুজনেই চট্টগ্রামকে তাদের স্বীয় সাম্রাজ্যভুক্ত করতে পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করতে থাকেন।
১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে অমর মাণিক্য নামে এক রাজা ত্রিপুরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হোন। তিনি ১৫৮৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। রাজমালা থেকে জানা যায়, তিনি তার ছেলে রাজধর নারায়ণকে প্রধান সেনাপতি করে আরাকান দখলে এক অভিযান প্রেরণ করেন। এই অভিযানে রাজধরের ছোট ভাই অমর দুর্লভ নারায়ণ, সেনাপতি চন্দ্রদর্প নারায়ণ এবং ছত্রজিত নাজিরকে প্রধান সেনাপতির সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এ বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল ফিরিঙ্গি সৈন্যরাও। কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে সহজেই নদী পার হয়ে রামু, দেয়াং, উড়িয়া ইত্যাদি অঞ্চল জয় করে নেয় তারা।
এ সংবাদ পাওয়ার পর এক বিশাল আরাকানী বাহিনী ত্রিপুরাদের গতিরোধ করে। এতে ত্রিপুরা বাহিনী ভীত হয়ে পড়ে এবং ফিরিঙ্গিরা যুদ্ধে অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে সহজেই আরাকানীরা তাদের হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
তখন আরাকানের মসনদে ছিলেন রাজা মেং ফলৌং। কথিত আছে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং তার নাম ছিল সিকান্দার শাহ। ত্রিপুরা বাহিনীর সাথে তার রণনৈপুণ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। ওদিকে ত্রিপুরা বাহিনী আরাকানীদের কাছে পরাজিত হলেও তারা যুদ্ধে ক্ষান্ত না দিয়ে নতুন করে যুদ্ধে জড়ানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে।
আরাকানী গোয়েন্দা বাহিনী খবর পায়, ত্রিপুরা বাহিনী পর্যাপ্ত রসদ না নিয়েই এ যুদ্ধে এসেছে। এ তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে ত্রিপুরা বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে এবং আরাকানীদের প্রথম আক্রমণেই দিশেহারা হয়ে যায়। আরাকানী সৈন্যরা ত্রিপুরাদের তাড়িয়ে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নিয়ে আসে। এ সময় ত্রিপুরাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়, অনেক সৈন্য মারা যায়। আরাকানী বাহিনী নদী পার হয়ে উত্তর চট্টগ্রাম পর্যন্ত ত্রিপুরাদের ধাওয়া দিয়ে আসে। এরপরও ত্রিপুরা বাহিনী দমে না গিয়ে আবারও সুশৃঙ্খল বাহিনী তৈরি করা হয়।
কিছুদিন পরই পাল্টা আঘাত এনে আরাকানী বাহিনীকে পরাজিত করে ত্রিপুরা বাহিনী। এ পাল্টা আঘাতে অনেক আরাকানী সৈন্য নিহত হয়। এ পরাজয়ে ধূর্ত আরাকান রাজ মেং ফলৌং (সিকান্দার শাহ) তার অধীনস্থ উড়িয়া রাজাকে সন্ধির প্রস্তাব টানেন। ত্রিপুরারাজও ছিলেন ক্লান্ত, তিনি নিজেও মনে মনে চেয়েছিলেন যুদ্ধবিরতির। তাই রাজা অমর মাণিক্য তার সেনাপতি রাজধর মাণিক্যকে যুদ্ধ বন্ধ করে ত্রিপুরায় ফিরে আসার নির্দেশ দেন। প্রকৃতপক্ষে আরাকান রাজ মেং ফলৌং সন্ধির ফাঁকে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকেন এবং ফিরিঙ্গিদের (পর্তুগিজ) সাথে হাত মিলিয়ে পরবর্তী আঘাতের দিনগণনা করতে থাকেন।
ওদিকে ত্রিপুরারাজ এই খবর জানতে পেরে তার ছেলে যুবরাজ রাজধর মাণিক্যকে প্রধান সেনাপতি বানিয়ে আরাকানীদের বিরুদ্ধে এক অভিযান প্রেরণ করেন। ত্রিপুরার বাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে চতুর আরাকানরাজ মেং ফলৌং স্বর্ণখচিত হাতির দাঁতের টোপর ও একটা চিঠিসহ দুজন দূতকে ত্রিপুরা শিবিরে পাঠান। রাজধর নারায়ণ মুকুট এবং তার ছোট ভাই রাজদুর্লভ পান চিঠি। রাজদুর্লভ মুকুট না পেয়ে খুবই রাগান্বিত হোন এবং শপথ নেন, মগদের শৃগালের মতো হত্যা করে হাজার টোপর ছিনিয়ে নিয়ে আসনেব। দূত ফিরে গিয়ে একথা আরাকান শিবিরে জানালে রাজা মেং ফলৌং ত্রিপুরা শিবিরে হানা দিতে তার সেনাপতিকে নির্দেশ দেন। এবং আবার ত্রিপুরা-আরাকান নতুন আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের শুরুতেই রাজদুর্লভ হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যান। সেনাপতি শেলের আঘাতে আহত হন। আর এতে করেই ত্রিপুরা বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এবং পরাজয় বরণ করে।
ফের যুদ্ধ এবং আরাকানীদের চট্টগ্রাম বিজয়
আরাকানীদের হাতে ছিল তখন রামু। রামুর শাসনকর্তা ছিলেন আদম শাহ। আরাকানীদের সাথে বিরোধের জের ধরে আদম শাহ পালিয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নেন। আদম শাহকে ফিরিয়ে দিতে ত্রিপুরার রাজা অমর মাণিক্যের কাছে আরাকান রাজ আবেদন করলে তা প্রত্যাখ্যান করেন অমর মাণিক্য। যার ফলে আবার আরেকটি যুদ্ধের দামামা বাজতে থাকে। চূড়ান্ত এ যুদ্ধে ত্রিপুরা রাজ্যের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। রাজা অমর মাণিক্য স্বয়ং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেন। আর ত্রিপুরার উদয়পুর পর্যন্ত আরাকানীরা দখল করে নেয়। রামুর শাসনকর্তা আদম শাহের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা অবশ্য জানা যায়নি। ব্রিটিশ পর্যটক রাল্ফ রিচ তার এক বিবরণীতে বলেছেন, ১৫৮৬ সাল রামু ও চট্টগ্রাম আরাকানীদের অধীনে ছিল। সুনীতিভূষণ কানুনগো মনে করেন, ১৫৮০ সালের আগেই আরাকানীরা চূড়ান্তভাবে চট্টগ্রাম বিজয় করে।