ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভিখারি

মোহিত কামাল
🕐 ৫:২৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ০৪, ২০১৯

বেশ পুরু চশমার কাচ, দেখেই বোঝা যায় গুরুতর কোনো চোখের সমস্যা রয়েছে, উপরের দিকে চোখ তুলে তাকালেও, নিরিখ করে দেখলে বোঝা যাবে, কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। সামনে উপস্থিত কারও মুখের দিকে তাকালেও যেন দেখতে পান না, মাথাটা ঠেলে আরও একটু আগ বাড়িয়ে খুব কাছ থেকে দেখলে অস্পষ্ট দেখতে পান মানুষের মুখ, চেনা চেনা লাগে, তবুও চিনতে পারেন না-এমন একটি অভিব্যক্তি ফুটে থাকে তার মুখে।

তার সামনে ভিক্ষের জন্য কোনো থালাবাটি নেই। হাঁটুগেড়ে এমনভাবে বসে থাকেন, হাঁটুর ওপর ডান হাত মুঠি করে রাখেন, কেউ দান করতে চাইলে হাত না সরিয়ে কেবল  মাত্র মুঠি খুলে এমনভাবে ধরেন, কিছু না কিছু দেবেনই কেউ। ডান হাতের মুঠি ভরে গেলে, বাঁ হাতে সব চালান করে দিয়ে দাঁতহীন মাড়িটায় কয়েকবার ঢেউ তোলেন। ভেতরের তৃপ্তির বাইরে প্রকাশ এমন নান্দনিক রূপ প্রতিদিন লক্ষ করে লেকের পাড়ে হাঁটুরে কিংবা মসজিদগামী নামাজিরা। মুখের ত্বকের ভাঁজ থেকে যে ঢেউ বেরোয় তার সঙ্গে পুকুরের কোমল ঢেউয়ের তুলনা করতে পারে হায়াত। তাই প্রতি শুক্রবার এ প্রশান্তির ঢেউ দেখার জন্য জুমার নামাজ শেষে ঘরে ফেরার সময় টুপ করে পাঁচশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত সরে আসে সে সামনে থেকে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে এই বৃদ্ধার অভিব্যক্তি।
টাকা চিনতে ভুল করলেন না বৃদ্ধা। টাকাটা চোখের সামনে তুলে ধরে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। ত্বকের ভাঁজে ঢেউ উঠল না, বরং মুখের পেশির নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল। অপলক চেয়ে রইলেন নোটটির দিকে। দনহবেলা পেরিয়ে দুঃখিনীর স্নেহশীলা বুভুক্ষু মনে মোচড় খেয়ে টাকা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালেন প্রথম। তারপর মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন বাঁয়ে, ডানেও তাকালেন। দেখতে পেলেন না দানকারীকে। দূর থেকে হায়াত দেখল দৃশ্যটি। টাকাটা বাঁ হাতে চালান করে দিয়ে তিনি দুই হাত তুলে; বাঁ হাত মুঠি ভরা ডান হাত প্রসারিত করে দোয়া করলেন। দোয়া শেষে চোখ তুলে তাকালেন উপরের দিকে। গাছের শুকনো পাতারা হু হু করে ঝরে যাচ্ছে। বসন্তের দ্বিতীয় দিনে গাছে গাছে গজাচ্ছে রঙিন সব পাতা, আর পাতা। সড়কে জমা হচ্ছে ঝরা পাতার স্তূপ।
পাতার ওপর দিয়ে কেউ হেঁটে আসছে। মচমচ শব্দ হচ্ছে। বৃদ্ধা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন লেকের পাড়ের নারী গার্ডরা লাঠি হাতে এগিয়ে আসছে। ফকির-মিসকিন যারা মসজিদে যাওয়া-আসার সড়কের দুপাশজুড়ে হাত বাড়িয়ে বসে থাকে তাদের ওপর খবরদারি করে। ভিক্ষুকদের চোখে তারা সন্ত্রাসী। আর নারী গার্ডদের চোখে ভিক্ষুকরা হচ্ছে চোর-বাটপার, লেকের সৌন্দর্য বিনাশকারী। এসব গার্ডরা প্রতিদিন দাবড়িয়ে বেড়ায় ভিক্ষুকদের। দাবড়ানি খেয়ে তারা পালিয়ে যায় না আবার এসে বসে নিজ জায়গায়।
দুই
জুমার নামাজের সময় হয়ে গেছে। বাসা থেকে মসজিদে ছুটে যেতে লাগবে পাঁচ মিনিট। আর হেলেদুলে বাঁকা পথে যেতে দশ মিনিট। এতটুকুন সময় হাতে নেই। সপ্তাহ বাদে আজ নামাজ ধরার জন্য কি ছুটেই সোজা পথে হায়াত হাজির হলো মসজিদে। ভেতরে পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল সেই বৃদ্ধা-ভিক্ষুকের কথা। প্রতি শুক্রবার দুবার করে দেখা হতো। দেখার সুযোগ হয়। মূল পথ ধরে এলে আসার সময় তাকে দেখার সুযোগ ঘটত। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো বৃদ্ধাকে দেখে মসজিদে ঢুকলে মনোযোগে প্রশান্তি নামে। মসজিদ বিল্ডিংয়ের চারপাশ ঘিরে যে খেজুর গাছ, শিলকড়ই গাছ আর সুপারি গাছের ঝাড় রয়েছে তার ছায়ার ফাঁক দিয়ে নেমে আসে প্রশান্তির অন্যরকম ঢেউ। মনটা এত অস্থির লাগছে কেন? ব্যাখ্যা জানা নেই হায়াতের। তবুও মসজিদে ঢুকে জানালার পাশে বসে তাকাল একবার বাহির পানে। কী আশ্চর্য লেকের ওই কোণাটা দেখা যাচ্ছে। যেখানে বৃদ্ধা বসে থাকেন, পুরো অংশটি চোখে পড়ছে। অথচ নেই তিনি। আপনা আপনি হায়াতের মনে উৎকণ্ঠার ঝড় শুরু হলো। নামাজ শুরু হয়ে গেলেও সে ঝড় থামল না। ঝড় মোকাবেলা করে নামাজ শেষ করল সে। সুন্নত নামাজ পড়ার জন্য অপেক্ষা না করে কী এক অদৃশ্য টানে বেরিয়ে এলো মসজিদের জরুরি গেট দিয়ে।
জরুরি গেট পেরুলেই বাগান। নানা জাতের গাছগাছালির চারা বপন করা হয়েছে বাগানে। এ বাগান পেরিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে বেরোনোর সময় থমকে দাঁড়াতে হতো। দেখার মতো করে দুই চোখ মেলে তাকাতেই হতো চারপাশে। সবুজ অরণ্যের বুকের ঘরেও জেগে উঠত চোখ জুড়ানো সজীব অনুভূতির ঢেউ। আজ কিছুই জাগলো না। কোনো দিকে তাকানোর ফুরসত পেল না হায়াত। গোপন টানে ছুটে চলল সে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে। কাক্সিক্ষত মোড়ে গিয়ে দেখল আজ সেখান থেকে একটু দূরে আসন নিয়েছে ভিক্ষুকের দল। আর লাঠি হাতে মুখে পান চিবোতে থাকা অন্য এক নারী গার্ড চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
পই পই করে খুঁজে দেখল সে। অসংখ্য ভিক্ষুকের ভিড়ে সেখানে রয়েছে আরও কয়েকজন বুড়োবুড়ির দলও, কাক্সিক্ষত মুখটি নেই! হাহাকার করে উঠল বুক! বিষয়টা কি? এমন কষ্ট লাগছে কেন?
কষ্টের অনুভব ছড়িয়ে যেতে লাগল চোখের মণিতে। হঠাৎ হায়াত দেখল অন্যরকম দ্যুতিময় আলো এগিয়ে আসছে পাশে নতুন বিল্ডিং তৈরির কাজে ব্যবহারযোগ্য স্তূপকৃত ইটের আড়াল থেকে। লাঠিতে ভর দিয়ে শরীর কুঁজো করে এগিয়ে এসে তিনি বসলেন সবার থেকে একটু দূরে।
প্রচণ্ড একটা নাড়া খেল হায়াত। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে দেহের অণু-পরমাণু ভেদ করে যেন বেরিয়ে এলো শান্তি! আর শান্তি। পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢোকাল টাকার জন্য। পাঁচশ টাকার নতুন নোটটি পকেটে পুরে নিয়ে এসেছিল বৃদ্ধাকে দেয়ার জন্য। এ মুহূর্তে পকেটের ভেতর দিয়ে হাতটা চালান হয়ে গেছে। পকেট কাটা। টাকা নেই। মোবাইল সেটও নেই। দ্রিম করে একটা ধাক্কা খেল সে বুকের ঘরে। মোবাইল কিংবা টাকার জন্য নয়, বৃদ্ধাকে আজ টাকাটা দিতে পারল না সে কারণেই হতাশা জেগে উঠল হায়াতের মনে। হঠাৎ খেয়াল হলো ভিড় ঠেলে মসজিদে ঢোকার সময় গায়ে বেশ জোরেই ধাক্কা দিয়েছিল একজন পাশ থেকে। তখনই কি ঘটে গেছে অপকর্মটি? মসজিদের মতো পবিত্র স্পটেও ঘটতে পারে এমন ঘৃণ্যতম কাজ!
উদ্বিগ্ন মুহূর্তটি কীভাবে পার করল, টের পেল না হায়াত। হঠাৎ দেখল কুঁজো দেহ কিছুটা সোজা করে বৃদ্ধা এসে দাঁড়িয়েছে তার মুখোমুখি। পুরো চশমার কাচের আড়াল থেকে তার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে বলল, ‘কী? এমন করছেন কেন?’
‘না। কিছু করছি না। পকেট কাটা গেছে!’
‘ওঃ! পকেটমাররা মসজিদেও ঢোকে?’
‘হ্যাঁ। তাই তো মনে হচ্ছে।’
‘খারাপ লাগছে, তাই?’
‘না। এখন আর খারাপ লাগছে না।’
‘ভালো। খারাপ না লাগলেই ভালো। ভালো থাকার জন্য খারাপটা মাটিচাপা দিতে হয়।’
‘আপনার এ মুহূর্তের কথায় খারাপ লাগার অনুভূতিটা মাটিচাপা খেয়ে গেছে। ভালো লাগছে তাই।’
মমতার দৃষ্টিতে বৃদ্ধা আবার চোখ তুলে তাকালেন হায়াতের মুখের দিকে। মায়ার রেণু ছড়িয়ে গেল ওর দেহে।
‘প্রতি শুক্রবার আপনি আমার হাতে পাঁচশ টাকা গুঁজে দেন! কেন? এত টাকা একসঙ্গে কেন দিতে ইচ্ছা করে?’
‘কেন’র জবাব নেই আমার বোধে। এটুকু বুঝি, দিলে ভালো লাগে, দিতে ইচ্ছা করে।’ বলল হায়াত।
‘নিন, পাঁচশ টাকার নোট, আপনার দেয়া, হাতে নিন।’ বলেই কোমরের ভাঁজ থেকে একটা নোট বের করে দিলেন বৃদ্ধা। ‘ফিরিয়ে দিচ্ছেন?’
‘না। ফিরিয়ে দিচ্ছি না। আবার দিন আমার হাতে। আপনার মনটা ভালো হোক-চাই আমি। নিন। আবার দিন আমার হাতে।’
হায়াত স্তব্ধ হয়ে গেল।
বৃদ্ধা আবার বললেন, ‘আপনার সমান বয়সী আমার একমাত্র ছেলেটিকে মেরে ফেলেছে শত্রুরা। ও রাজনীতি করত। নিজের দলের বিদ্রোহী গ্রুপ নেতৃত্বের লোভে খুন করেছে তাকে। স্বামীকে হারিয়েছি বহু বছর আগে। আর ছেলেকে কয়েক বছর আগে। আপনাকে প্রতি শুক্রবার যখন দেখি, ছেলের কথা মনে হয়। মায়া লাগে। আপনার দেওয়া পাঁচশ টাকার চেয়েও বড় উপহার আমি পেয়ে যাই, মায়ার উপহার সে উপহারের মূল্য পাঁচ কোটি টাকা।’
‘সেকি’ আমি তো ভেবেছিলাম চশমার পুরু কাচ ভেদ করে আপনি আমার মুখ দেখতে পান না, ঝাপসাভাবে দেখলেও চিনতে পারেন না!’
‘চোখের জ্যোতি কমেছে ঠিক। মনের জ্যোতি কমেনি। রত্ন দেখতে ভুল করিনি আমি। মনের কাচে অনেক স্বচ্ছ আপনার মুখ। সে মুখ কি ভোলা যায়?’
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল হায়াত।
‘বৃদ্ধা আবার বলতে লাগলেন, ‘আমি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলাম। শিশুদের মন দেখার অভিজ্ঞতা আছে। আর নিজের সন্তান, হায়াতের মুখও দেখেছি। তার মুখ বসে আছে আপনার মুখে।’
‘আপনার ছেলের নাম হায়াত?’
‘হ্যাঁ। এমন চমকে উঠলেন কেন আমার ছেলের নাম শুনে?’
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিস্ময়ের ঝাঁকি খেয়ে হায়াত ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনার নাম কি?’
‘আমার নাম দিয়ে কী হবে বাবা?’
‘বাবা’ শব্দটাও ভূকম্পন তুলল হায়াতের বোধে। অস্থির হয়ে আবার প্রশ্ন করল, বেশ জোরালোভাবেই, ‘আপনার নাম কি? বলুন প্লিজ।’
‘হালিমা খাতুন।’
উত্তর শুনে দ্যুলোক-ভুলোক ভেদ করে চন্দ্র-সূর্য গ্রহ-তারা ছেড়ে যেন উড়ে চলে গেল হায়াত মহাশূন্যে-তার মায়ের নাম হালিমা খাতুন। প্রায় পনেরো বছর হলো তিনি ছেড়ে গেছেন জগৎ-সংসার।

 
Electronic Paper