মুগ্ধতার সিনেমা
তারে জামিন পার
হামিদ কায়সার
🕐 ৪:৫৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ০৪, ২০১৯
আমাদের স্কুলগুলোর প্রতিটি শিক্ষকই যদি রাম শংকরের মতো হতেন! হাসি-আনন্দ আর গানে ভরপুর! অকারণেই মুখের মধ্যে অদ্ভুত গাম্ভীর্য ধরে রাখতেন না! ছাত্রদের শুধু মনে করতেন না মার আর ধমকানোর বস্তুবিশেষ! মনে করতেন সন্তানবৎ!
এমন একটা চাওয়া আমার মনে হঠাৎ করেই উসকে উঠলো, গত এক সপ্তাহ বাইরে কাটিয়ে দেশে ফিরেই-যখন জানতে পারলাম, অরিত্রী অধিকারী নামে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির একজন ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যার কারণ ওর বাবাকে অপমান করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ, তার আগে পরীক্ষা কক্ষে মোবাইল সেট নেওয়ার মাধ্যমে নকলের অভিযোগে ওকে বহিষ্কারের হুমকি দেন শিক্ষিকা। নিজের অপমান তবু ও সহ্য করেছিল, কিন্তু ওর কারণে বাবা স্কুল কর্তৃপক্ষের দ্বারা অপমান হলো, সেটা আর কিছুতেই মেনে নিতে পারল না হতভাগী।
এমন ঘটনা নতুন নয়। হরহামেশাই ঘটছে। গত বছর তিনেক আগে নকলের অভিযোগ আনায় আর তা ঘটা করে বাপ-মাকে জানানোয়, মানারাত স্কুলের ছাত্রী নায়ক ওয়াসিমের মেয়ে ক্লাসরুম থেকেই লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। শুধু যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, তা নয়, মাঝেমধ্যেই স্কুল এবং মাদ্রাসায় পাঠরত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকদের ঘটানো এমনসব অমানবিক খবর কানে আসে যে বা ভিজুয়ালি দেখি, যা হতাশায় স্তব্ধ করে। বাবা-মা যাদের কাছে কোমলমতি সন্তানদের তুলে দেন মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য, সেই তাদের কাছ থেকেই যদি শিকার হতে হয় পশুবৎ আচরণের, তাহলে আর ওদের আশ্রয়ের জায়গা থাকলো কোথায়?
এবার আসুন জানা যাক, কে এই রাম শংকর? রাম শংকর আমির খান প্রযোজিত ও পরিচালিত সাড়াজাগানো চলচ্চিত্র তারে জমিন পার সিনেমার দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র। যার রূপারূপ করেছেন স্বয়ং আমির খান নিজে। আর ছবিটির প্রধান চরিত্র হলো আট-নয় বছরের স্কুলছাত্র ঈশান আয়াস্তি। ছবিটি শুরু হওয়ার পর থেকেই আমরা দেখি এক অসহায় স্কুল বাচ্চাকে। যে ক্লাসে পড়া দিতে পারে না, জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরে, যাকে শিক্ষকরা মারে, বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখে, শেষে স্কুল থেকেও বহিষ্কার করে দেয়। বাড়িতেও ওর জীবনটা কুসুমশয্যা নয়, বিষাক্ত। বাবা-মা ওকে বুঝতে পারে না। বড় ভাই উহান যখন সব বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বাড়ি ফেরে, ঈশানের রেজাল্ট শিট তখন কুকুরের মুখে ঘোরে, পড়শি বালকের কাছে মার খেয়ে এসে বাড়িতে উল্টো নালিশ আসায় ওকে বাবার কাছেও মার খেতে হয়।
এমনই এক প্রেক্ষাপট, বাবা-মা স্বভাবতই ঈশানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়। ওর মনের বিরুদ্ধেই ওকে জোর করে রেখে আসে বোর্ডিং স্কুলে। এ স্কুলে এসেও কি এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পায় ঈশান? শিক্ষকদের বর্বর আচরণে ওর জীবন বিষিয়ে উঠতে থাকে। অবশেষে এই বোর্ডিং স্কুলেই বদলি শিক্ষক হিসেবে আবির্ভাব ঘটে একটি প্রতিবন্ধী স্কুলের শিক্ষক রাম শংকরের, যে কি না চারু ও কারুকলায় পাঠদান করেন। রাম শংকর কিন্তু অন্য শিক্ষকদের মতো রুদ্র কঠিন আচরণে মেতে উঠল না ঈশানের সঙ্গে, ওর দিকে বিরক্তিতে ছুড়েও মারলো না হাতের ডাস্টার। হাসিমুখে এগিয়ে এলো ওর দিকে।
গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে আবিষ্কার করল ঈশান ডিসলেক্সিক নামের একটি রোগে ভুগছে। যে কারণে ও কোনো কিছু পড়তে পারে না, অক্ষরগুলো ওর সামনে নেচে বেড়ায়, মাকড়সার মতো ঘোরে। তারপর? না, তারপর আর আমি বলবো না। যারা ছবিটি দেখেছেন তারা তো জানেনই, যারা দেখেননি, তাদের অবশ্যই দেখতে হবে। কেননা, এ সিনেমা আপন সন্তানদের প্রতি আমাদের মানবিক হতে শেখায়, ওদের প্রকৃতভাবে ভালোবাসার ইন্ধন জোগায়। আর এ ছবি শিক্ষকদের নিজের বিবেকের মুখোমুখি করে তোলে, আত্মদাম্ভিকতা থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরণা দেয়। পুলিশ হলেই হাতে লাঠি রাখতে হবে? শিক্ষক হলেই হাতে ঘোরাতে হবে বেত? মান্ধাতার আমলের এইসব ছাইপাঁশ অন্ধ চক্কর থেকে বেরিয়ে না এলে কীভাবে শিক্ষকরা আশা করেন তারা নির্মাণ করতে পারবে সভ্য সমাজ! আজ তাদের প্রমাণ করার সময় এসেছে, শাসন করা তারই সাজে, ভালোবাসে যে!
এতক্ষণের রিভিউ পড়ে কারো কারো কাছে মনে হতে পারে, তারে জামিন পার বুঝি শিক্ষণীয় বা ভাবগম্ভীর গোছের কোনো ছবি। মোটেও তা নয়, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটা দারুণ উপভোগ্য। কারণ, ছবির ক্যামেরার কাজ অসাধারণ, লোকেশন অনন্য। ঈশান চরিত্রে শিশু অভিনেতা দারশিল যেমন দারুণ অভিনয় করেছে, আমির খানও তার জায়গায় অসাধারণ কাজ করেছেন। মিউজিক কাহিনীকে টানটান এগিয়ে নেয়। গানগুলো চিত্রনাট্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। ছবিটা যতই বক্তব্যধর্মী হোক, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভালোলাগার রেশ ছড়িয়ে দেয়। দেখতে হয় গভীর মগ্ন হয়ে।
২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বলিউডের এ সিনেমাটির কাহিনী অমলে গুপ্তের, যা প্যাট্রিসিয়া পোলাক্কোর বই "Thank You, Mr. Falke" ২০০৭ থেকে অনুপ্রাণিত।
ছবিটির একটি স্লোগান রয়েছে। প্রত্যেক মানুষই স্পেশাল। তার বিশেষ কিছু না কিছু গুণ আছে। আর সেটাই আবিষ্কারের দায়িত্ব শিক্ষকের। যে শিক্ষকরা অরিত্রী অধিকারীদের নকল ধরেই শুরু করে দেন অতি শাসনের তা-বতা, তারা একবারও ভাবেন না, ভালোবাসা দিয়েও ছাত্রছাত্রীদের সুন্দর মূল্যবোধগুলোর বিকাশ ঘটানো সম্ভব। সেই ছাত্রছাত্রীকে ভালো পথের সন্ধান না দিয়ে তাকে বহিষ্কার করে দেওয়াটা তো হলো মাথার ব্যথা সারাতে গিয়ে মাথা কেটে ফেলারই ব্যবস্থা গ্রহণ।
তবে সুখের কথা, রাম শংকরের মতো শিক্ষকের অস্তিত্ব আমাদের সমাজ রাষ্ট্রে অবশ্যই রয়েছে, তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ুক এবং তারা ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করে তুলুক জীবনকে ভালোবাসতে, দীক্ষা দিক শত যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়েও কেউ যেন অরিত্রী অধিকারীর মতো আত্মহত্যার পথ বেছে না নেয়, কেননা আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়।