ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

টিকাটুলির আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

আফসান চৌধুরী
🕐 ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ০৪, ২০১৯

আমি ইতিহাস চর্চার মানুষ। সামাজিক ইতিহাস নিয়েই যেহেতু কাজ করি, সেদিক থেকে আমার জন্মস্থান টিকাটুলীর ইতিহাস আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। একবার আমি কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি বলেছিলাম, একটা পাড়ার ইতিহাস জানতে হলে মানুষকে জানতে হয়, কী করছে তারা। ওই ক্লাসেরই এক ছাত্রীর কাছে জানলাম, তার নানী থাকত টিকাটুলীতে। মজার বিষয় হচ্ছে, তিনি আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। আমরা মূলত, টিকাটুলীর তৈরি। আমাদের বড় হওয়া, আমাদের মানসিকতা তৈরির কারখানা।

আবার আমি টিকাটুলী বলতে বুঝি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্যারের বাসা। স্যার তখন ভাড়া থাকতেন লেখক শওকত আলীর বাসায়। সেখানে আমাদের যাতায়াত ছিল। সেকালে যে মানসিকতা প্রভাব ফেলেছিল আমাদের ওপর, সেটা হচ্ছে বামপন্থী মানসিকতা। সেটি ছিল সত্তর-আশির দশকের মানসিকতা। সেই সময়ের মানসিকতা থেকেই আমার ‘বিশ্বাসঘাতকগণ’ নামের উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল। এরপর আমাকে ভাবা তো, তখনকার মধ্যবিত্তের অবস্থা।

তৎকালীন মধ্যবিত্তের অবস্থা ও টানাপড়েন পুরোটাই তুলে ধরা হয়েছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘মিলির জন্য স্টেনগান’ গল্পে। স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যে যে পরিবর্তন, সেটা এ গল্পে ধরা পড়েছিল। এ গল্পে ভালোভাবেই উঠে এসেছিল মধ্যবিত্তের অবস্থা। কীভাবে তার দুনিয়াটা মিলিয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে ইলিয়াস ভাইয়ের আলাপ হয় আমার এক বছরের সিনিয়র আজিজ ভাইয়ের মাধ্যমে। তিনি ইলিয়াস ভাইয়ের ভাইপো ছিলেন এবং আমাদের বিভাগের খুব ভালো ছাত্র, ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলেন। আজিজ ভাই থাকতেন ইলিয়াস ভাইয়ের বাসায়।

যেহেতু আমি ইতিহাসের বিষয় নিয়ে, বিশেষ করে ঔপনিবেশকালের ইতিহাস নিয়ে গলাবাজি করতাম, আর আজিজ ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন ইলিয়াস ভাইয়ের বাসায়। তখন ইলিয়াস ভাইকে ততটা চিনতাম না। তবে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে কবি রফিক আজাদ আমাকে বলেছিলেন, তার লেখা ‘স্বগত মৃত্যুর পটভূমি’ একটি অসাধারণ সৃষ্টি। তখনো ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ ছোটগল্পের সংকলনটা বের হয়নি বোধহয়। আজিজ ভাইয়ের সঙ্গে টিকাটুলীতে আমার যাওয়া, ১৯৫৭ সালে ছেড়ে আসার পর। আমরা প্রথম দিনেই প্রায় ঘণ্টা সাতেক আড্ডা দিয়েছিলাম। এমনকি চা-পানি খাওয়ার কথাও মনে ছিল না। বস্তুত আমার মনে হয়, যদি আড্ডাবাজ হিসেবে একটা কম্পিটিশন হতো, তাহলে ইলিয়াস ভাই নিঃসন্দেহে ফার্স্ট হতো। আমরা প্রধানত আলাপ করেছিলাম ইতিহাস নিয়ে। অবশ্য অন্যান্য বিষয়ও এসেছিল। তিনি ভীষণ সরসভাবে ব্যঙ্গ করতে পারতেন, এটা ভাবা যায় না। এমনকি বিভিন্ন মানুষের ব্যক্তিগত আচরণ নিয়েও ব্যঙ্গ করতেন, হাসি-ঠাট্টা করতেন। এখন তো ইলিয়াস ভাইকে সবাই মহামানব বানিয়েছে। কিন্তু আড্ডাবাজদের যতগুলো গুণ-দোষ থাকে, তার সব ছিল। ব্যক্তি ইলিয়াসকে অনেক বেশি পছন্দ করি তার সাহিত্যের চেয়ে। ক্রমে এ সম্পর্কটা ব্যাপক হতে লাগল। কারণ তিনি অনেক পড়াশোনা করতেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। ‘শরাফাত’ বলতে যে নিন্দনীয় শব্দটি বাজারে চালু আছে, যার কাছাকাছি মানে দাঁড়ায় ‘আভিজাত্য’, এটা তার মধ্যে ছিল।

ইংরেজি সাহিত্য ভীষণ প্রিয় ছিল ইলিয়াস ভাইয়ের। যেহেতু আমারও এ বিষয়ে পড়াশোনা ছিল, তাই আমাদের আড্ডাটা এত সহজ-সাবলীল হতে পেরেছিল। ইলিয়াস ভাই নব্য মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত ও প্রাচীনপন্থী সবার প্রতি খুব বিরক্ত ছিলেন। তিনি এদের মেকি মনে করতেন। একটা গল্প দিয়ে উদাহরণ দিতেন বারবার। ‘চায়নায় যখন আধুনিকীকরণ শুরু হয়, তখন অনেক রক্ষণশীল এর প্রতিবাদ করে। তেমন এক মানুষ তার এলাকার অনেক গণ্যমান্যদের দাওয়াত করে এবং তার শেষে আধুনিকতার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেয়। তারপর প্রতিবাদস্বরূপ সেই মানুষের দেহরক্ষীরা সাড়ম্বরে তার গর্দানচ্যুত করে। এটাই ছিল তার প্রতিবাদ।’ ইলিয়াস ভাই বলতেন, বাংলাদেশের কোনো রক্ষণশীল মানুষের এ সাহস দেখানোর মতো সাহস হবে না।

এর মধ্যেই তার বই বের হওয়া শুরু হলো এবং প্রায় হঠাৎ করেই যেন মানুষ আবিষ্কার করল, কী অসাধারণ এক লেখক এ দেশে বসবাস করে। তখনকার সময় ‘বিচিত্রা’য় তার ছোটগল্প নিয়ে একটা রিভিউ ছাপা হয়। সেখানে তাকে ‘পুরান ঢাকার রূপকার’ বলা হয়েছিল। ইলিয়াস ভাই কিছুটা দুঃখিত এবং অনেকটা বিরক্ত হয়েছিলেন। তার ধারণা, এ উক্তি মেধাবী শ্রেণির, যাদের বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ আছে, কিন্তু তেমন মেধা নেই। কষ্ট পেলেও কথাটা বলছি, বর্তমান কালের অনেক প্রতিষ্ঠিত মানুষের প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। সেদিক থেকে ইলিয়াস ভাইয়ের সংকটটা ছিল পুরনো মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংকট। যেটা তিনি বারবার বলতেন সেটা হচ্ছে মেধার বাজারে আর কাউকে প্রমাণ করতে হয় না। খ্যাতির পেছনে দৌড়াতে গিয়ে অনেকেই সফল, কিন্তু সেটার প্রতিষ্ঠা যোগ্যতার ভিত্তিতে হয় না। আমার কাছে মনে হয়েছিল, এটা পুরনো টিকাটুলীর মনোভাব। ইলিয়াস ভাই নিজে বগুড়ার মানুষ ছিলেন এবং বনেদি পরিবারের। পঞ্চাশের টিকাটুলীতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কিন্তু সত্তর-আশির দশকের টিকাটুলীতে তাকে মনে হয়েছিল অনেকটাই বিচ্ছিন্ন, কিছুটা একা।

‘চিলেকোঠার সেপাই’ যখন বের হলো, তখন তিনি একজন প্রধান লেখকের মর্যাদা পেলেন। এ মর্যাদা পাওয়ার জন্য যে পরিশ্রমটা করা দরকার, সেটা তিনি করেছেন, হয়তোবা জন্ম থেকে।

নিঃসন্দেহে তিনি নাগরিক সাহিত্যিক ছিলেন। গ্রামীণ নস্টালজিয়ায় ভুগতেন না। নিজের ক্ষমতার ওপর তার আস্থা ছিল এবং বিখ্যাত কিন্তু কম ক্ষমতাসম্পন্ন লেখকদের প্রতি কোনো অবজ্ঞা ছিল না।

সে সময় অনেকেই বলতেন, কোথায় হুমায়ূন আহমেদ আর কোথায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। অর্থাৎ হুমায়ূন ভাই জনপ্রিয় কিন্তু প্রতিভাবান না, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস উল্টোটা। কিন্তু ইলিয়াস ভাইয়ের এ ভাবনা একেবারেই ছিল না। তিনি হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত ছিলেন না। কিন্তু মনে করতেন, একটি সাহিত্যের মানচিত্রে অনেক কিছিমের লেখক থাকে। হুমায়ূন আহমেদও থাকে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও থাকে। কে বড় কে ছোট, এ কূপমণ্ডূকতার প্রতি তার কোনোদিন আগ্রহ লক্ষ করা যায় না।

 

 
Electronic Paper