ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভুবন সোম মৃণাল সেন

মুনিরা মোরশেদ মুন্নী
🕐 ১১:০১ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ০৪, ২০১৯

মৃণাল সেন আমাদের মাঝে নেই, এটুকু আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রতিমুহূর্তে অসংখ্য স্মৃতি স্মরণে আসে। অনেক ভালোবাসতেন আমাকে, আমার পরিবারকে। ঢাকায় যখনই তিনি এসেছেন, আমাদের বাসায় গিয়েছেন, সেখানে অনেকটা সময় কাটাতেন। নানা বিষয়ে আমাদের কথা হতো। আমার হাতের রান্না খুব পছন্দ করতেন। একবেলা আমাদের বাসায় খাবার খেতেনই। তার পছন্দের যত খাবার সব তৈরি করার চেষ্টা করতাম।

মৃণালদা পাটিসাপটা পিঠা খুব পছন্দ করতেন। বৌদি মারা যাওয়ার পর আমরা কলকাতায় গিয়েছিলাম মৃণালদার সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম পাটিসাপটা পিঠা। খেয়ে সে কী প্রশংসা! তিনি উঠতে পারছিলেন না। বিছানায় শুয়ে থাকতেন। তার বেডরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। বিছানায় শুয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

একজন উচ্চশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন মৃণালদা। দূর থেকেই ওনাকে অনেক কঠিন মনের মানুষ মনে হতো। কিন্তু তার মধ্যে যে বিনয়, ভালোবাসা, বন্ধুসুলভ আচরণ তা ভাবাই যায় না। তিনি তরুণদের ভালোবাসতেন। তার সিনেমায় দ্রোহের চেনা মেজাজের মতোই এক ধরনের তারুণ্য ছুঁয়ে থাকত তাকে। একমাত্র ছেলে কুণাল সেন, বাবাকে ‘বন্ধু’ বলে ডাকতেন। সচরাচর কাউকে ‘কাকা-মামা’ বলে ডাকার বাঁ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করারও অনুমতি দিতেন না তিনি।

আমাদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে মোরশেদুল ইসলামের কারণে। ১৯৮৫ সালের কথা। মোরশেদুল ইসলাম তখন তরুণ। ‘আগামী’ ছবি নিয়ে ইতালির উৎসবে যান তিনি। ভারত থেকে একটা বড় দল গিয়েছিল। সেই দলে ছিলেন মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগাল, আদুর গোপালকৃষ্ণন, শাবানা আজমি, কুমার সাহানি, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, মণি কাউল। মোরশেদুল সবার ছোট হবার কারণে তার দিকে সবার মনোযোগ ছিল একটু বেশি। একসময় মোরশেদুল তাদের একজন হয়ে যায়।

তবে মোরশেদুল ইসলামের সাথে মৃণাল সেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ১৯৯১ সালে লন্ডনে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটির সম্মেলনে। ওই সম্মেলনে মৃণাল সেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আর মোরশেদুল এশিয়ান রিজিয়নের সেক্রেটারি। ওই সময়ই মূলত, মৃণাল সেনের সঙ্গে মোরশেদুলের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। মৃণাল সেনের চোখে নিয়মিত ড্রপ দিতে হতো। আর এই ড্রপ দেওয়ার সময় হলেই মৃণাল সেন মোরশেদুলকে ডেকে নিতেন।

১৯৯১ সালে ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই সময় বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম আয়োজন করে ‘দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব’। ওই উৎসবে মৃণাল সেনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ওই বছর তিনি প্রথম বাংলাদেশে আসেন। সঙ্গে তার স্ত্রী অভিনেত্রী গীতা সেন।

পরের বছর মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র নিয়ে উৎসব আয়োজন করা হয় জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে। ৩৫ মিলিমিটার প্রযুক্তিতে তার কয়েকটি ছবি দেখানো হয়। ওই উৎসবে মৃণাল সেনের আসা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। তখন ছিল বিএনপির সরকার। আমরা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করি। তখন তিনি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। মৃণাল সেনকে আসার অনুমতি না দিলে কী সমস্যা হতে পারে, সেটা তাকে বুঝিয়ে বলেন। এরপর প্রয়োজনীয় সব অনুমতি দ্রুত পাওয়া যায়।

১৯২৩ সালের ১৪ মে মৃণাল সেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ফরিদপুরে তিনি মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর তিনি পড়াশোনার জন্য কলকাতায় যান। ১৯৯২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠান শেষ করে তিনি ফরিদপুরে যান, নিজের জন্মভিটা দেখতে। ওই সময় তার সঙ্গে ছিলেন আরেক জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রয়াত তারেক মাসুদ।

১৯৯৮ সালে মৃণালদা শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকায় আসেন। ছিলেন হোটেল সোনারগাঁওয়ে। মৃণালদা মোরশেদুলকে ফোন করে বললেন, ‘হোটেলের খাবার আর খেতে পারছি না, আমাকে এসে নিয়ে যাও, মুন্নীর হাতে রান্না করা খাবার খাব।’ তারপর আমাদের বাসায় খাবার খেয়ে খুব তৃপ্তি পেলেন।

মৃণাল সেনের ৯৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে গত বছর রেট্রোস্পেক্টিভ আয়োজন করা হয়। এই উৎসবে আসার মতো শারীরিক অবস্থা তার ছিল না। শেষে তার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় যাই। তাকে নিয়ে একটি প্রকাশনা বের করেছিলাম। প্রকাশনাটি তার হাতে দিই।

আর তার সিনেমার কথা বলতে গেলে, তার সব সিনেমাই আমার কাছে অনন্য। কোনোটা আগে কোনোটা পেছনে রাখতে পারি না।

তবে নীল আকাশের নীচে, ভুবন সোম, কলকাতা ৭১-এ তিনটি সিনেমাকে অনেকেই এগিয়ে রাখেন, এমনকি মৃণালদাও এ তিনটিকে এগিয়ে রাখতেন। আমি এতকিছু লেখার পরও মনে হলো, তিনি সত্যি বেঁচে আছেন। হয়তো তার দৃশ্যমান রূপ নেই। কিন্তু মৃণাল সেন আমার দাদার মতোই চিরদিন বেঁচে থাকবেন আমার মাঝে।

 
Electronic Paper