ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আমাদের নীরেনদা

সিদ্ধার্থ সিংহ
🕐 ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ০৪, ২০১৯

এক দিন নীরেনদার সঙ্গে কী নিয়ে যেন কথা বলছি, হঠাৎ দেখি সংযুক্তা বিড়বিড় করতে করতে এসে নীরেনদার সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে আচমকা কী মনে পড়তেও, যে দিক দিয়ে এসেছিল, সেদিকেই হাঁটা দিয়েছিল। ওকে যেতে দেখে নীরেনদা বললেন, কী হলো, চলে যাচ্ছ যে!

সংযুক্তা আমাদের বন্ধু। ওর বাবা একটানা আঠারো বছর রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। ওর স্বামী বাংলা ছায়াছবির প্রবাদপ্রতিম শিল্প নির্দেশক-গৌতম বসু। ওর মেয়ে চিকি, মানে অন্নপূর্ণা অন্তত দশটা সফল বাংলা ছায়াছবি বানিয়েছে। কিন্তু ওকে আমরা পাগলী বলেই ডাকি। সেই সংযুক্তা বলল, না, আসলে একটা বানান জানতে এসেছিলাম। আপনার কাছে আসতেই মনে পড়ে গেল।

নীরেনদা বললেন, এসো এসো, বসো। ও নীরেনদার সামনের চেয়ারে বসতেই নীরেনদা বললেন, তোমার আর কোনো বানান জানার থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারো। এই অবকাশে একজন সুন্দরী মহিলা বানানের কৌতূহল মেটানোর সুযোগ তো পাব।

এই হচ্ছেন নীরেনদা। মানে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ছড়াকার, সাংবাদিক, রহস্য রোমাঞ্চকার, গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক, বাংলা ভাষায় প্রথম টিনটিন-এর অনুবাদক এবং অবশ্যই দক্ষ সম্পাদক। তবুও তার মধ্যে ছিল এ রকমই সূক্ষ রসবোধ। বাংলাদেশের ফরিদপুরের চান্দ্রাগ্রামে ১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। মা প্রফুল্লনলিনী দেবী।

আনন্দবাজারে আমি যে ঘরে বসতাম, সে ঘরে আরও তিনজন বসতেন। তিনজনই বিখ্যাত সাহিত্যিক। একজনের নাম দিব্যেন্দু পালিত। অন্য দুজন হলেন রমাপদ চৌধুরী আর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। এদের দুজনের মাঝখানে বসতাম আমি। সেই সুবাদে এদের দুজনের বন্ধুত্ব আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি।

এক দিন হঠাৎ শুনি রমাপদবাবুর দিকে তাকিয়ে নীরেনদা বলছেন, হ্যাঁরে, সুষমা নামের বউগুলো বুঝি খুব ভোগায়, না?

আমার ডানদিকে বসা রমাপদবাবু মাথা নেড়ে নীরেনদাকে ইঙ্গিতে কী বলেছিলেন, আমি দেখিনি। আমি তখন কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তবে উনি কেন রমাপদবাবুকে এটা জিজ্ঞেস করেছিলেন, সেটা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ, আমি জানতাম, নীরেনদার মতো রমাপদবাবুর স্ত্রীর নামও সুষমা। সে সময় নীরেনদার স্ত্রী খুব ভুগছিলেন।

যখন কোনো দুটি মানুষের বন্ধুত্ব একটা ‘জুটি’ হয়ে দাঁড়ায়, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে সেই বন্ধুত্ব অটুট থাকে, তার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকে। আর সব থেকে বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায় অনেকগুলো কাকতালীয় মিল। মিল মানে, তারা যে দুজনেই ঝরনা কলমে লিখতেন, দুজনেরই যে প্রিয় রং ছিল কালো আর লাল কালি, দুজনেই কলম বিগরোলে যে ধর্মতলার মোড়ে ‘পেন হসপিটাল’-এ ছুটতেন, দুজনেই যে একই রকম দক্ষ সম্পাদক ছিলেন, শুধু তা-ই নয়, আমরা যারা এই দুজনকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম বা খুব কাছ থেকে দেখেছি, তারা জানি, দুজনের মধ্যে কত মিল ছিল। সিগারেট খেলে দুজনে একসঙ্গে খেতেন। আগুন লাগার পরে যখন অফিসের মধ্যে ক্যান্টিন তো দূরস্থ, সামান্য দেশলাই বা লাইটার জ্বালানোও নিষিদ্ধ হয়ে গেল, তখনো এই দুজন একসঙ্গে লিফটে করে নিচে নেমে অফিসের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতেন। শুধু একজনকে কেউ কখনো একা একা সিগারেট খেতে দেখেছে বলে আমি কখনো শুনিনি। তবে নিচে নামলে উল্টো দিকের গাছতলার চায়ের দোকান থেকে চা না খেয়ে কেউই ওপরে উঠতেন না। এমনকি, টয়লেটে গেলেও দুজনে একসঙ্গেই যেতেন।

যখন ওরা আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দেন, তখনকার সময়ে প্রায় সমস্ত পত্রপত্রিকাতেই দুজন করে সম্পাদক রাখার একটা রীতি ছিল। সে বিভাগীয় সম্পাদনার ক্ষেত্রেও। একজন অসুস্থ হলে বা ছুটিতে গেলে যাতে অন্যজন চালিয়ে নিতে পারেন। পাকাপাকিভাবে ‘আনন্দমেলা’র সম্পাদক হওয়ার আগে এরা দুজনেই ছিলেন ‘রবিবাসরীয়’র দুই সম্পাদক।

খেলা নিয়ে দুজনেরই ছিল তুমুল উৎসাহ। কখনো কখনো দুজনের মধ্যে তুমুল কথা-কাটাকাটিও হতো। সেই ঝগড়া দেখলে কে বলবে, ওরা ওই পদমর্যাদার দুই দিকপাল কবি আর লেখক। তবে তাদের ঝগড়া কখনো দীর্ঘস্থায়ী তো হতোই না, তিক্ততা পর্যন্তও গড়াত না। পরে বুঝতে পারতাম, ওটা ছিল পুরোটাই কপট ঝগড়া।

সেবার বইমেলায় আমার একটা ছোটদের বই বেরোবে। নাম-মায়া কাজল। নাম শুনেই রমাপদবাবু বললেন, নাম দুটোর মাঝখানে একটা হাইফেন দিয়ে দেবেন।

রমাপদবাবু কথাটা শেষ করেছেন কি করেননি, নীরেনদা ও পাশ থেকে বলে উঠলেন, না না, হাইফেন দিয়ো না। ওটা সবাই দেয়। তুমি বরং ওই দুটো নামের মাঝখানে একটা ‘এস’ বসিয়ে দাও।

আমি তো অবাক। ইংরেজির এস? সে তো সাপের ফণার মতো লাগবে! নীরেনদা বললেন, তুমি যেভাবে ভাবছ, সেভাবে নয়, দেখে যাও, এভাবে ‘এস’টা লিখবে। বলেই ‘মায়া’ লেখার পর ‘কাজল’ লেখার আগেই একটা শোয়ানো এস এঁকে দিলেন। কিন্তু নীরেনদা বললে কী হবে! আমার বস তো রমাপদ চৌধুরী। তাই বাধ্য হয়েই আমি ‘এস’ না লিখে রমাপদবাবুর কথামতো হাইফেনটাই ব্যবহার করেছিলাম। ফলে সে বই দেওয়া তো দূরের কথা, নীরেনদাকে কোনো দিন দেখাতেও পারিনি।

যতই খুনসুঁটি হোক, তাদের কাকতালীয় মিল ছিল অভাবনীয়। নীরেনদার থেকে তার স্ত্রী ছিলেন ঠিক এক বছর আট মাসের বড়। আবার রমাপদবাবুও ছিলেন নীরেনদার থেকে ঠিক ওই এক বছর আট মাসেরই বড়। মানে, নীরেনদার জীবনসঙ্গিনী এবং জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু দুজনেই ছিলেন কাকতালীয়ভাবে একেবারে একই বয়সী।

রমাপদবাবু সারা বছরে মাত্র একটা উপন্যাস লিখতেন। নীরেনদাও লিখতেন খুব কম। এত বছরে লিখেছিলেন মাত্র ২৯টি কবিতার বই। ১৪টি রহস্য কাহিনী। ৬টি আলোচনাগ্রন্থ। ৩টি ভ্রমণ কাহিনী। একটি করে উপন্যাস, আত্মস্মৃতি, কাব্যনাট্য। এ ছাড়া ছোটদের জন্য সতেরোটি ছড়া-কবিতার বই। সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য গোয়েন্দা চরিত্র ডিটেকটিভ ভাদুড়ী মশাই।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু সেটা কোথাও ছাপা হয়নি। ১৬ বছর বয়স থেকে তার লেখা কবিতা সেই যে বেরোনো শুরু হয়, তা ‘নীলনির্জন’ নামে সিগনেট প্রেস থেকে প্রথম বই হয়ে বেরোয় ১৯৫৪ সালে।

তিনি চাকরি করেছেন দৈনিক প্রত্যহ, সত্যযুগ, মাতৃভূমি, স্বরাজ, ভারত, ইউনাইটেড প্রেস অব ইন্ডিয়ায়। ১৯৫১ সালে যোগ দেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। আনন্দমেলার সম্পাদক হন ১৯৭৬ সালে।

একজন দীর্ঘদিনের প্রিয় মানুষ- রমাপদ চৌধুরীর মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারেননি! তাই রমাপদবাবু চলে যাওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মাথাতেই তিনিও চলে গেলেন! কে জানে!

 

 
Electronic Paper