ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কুয়াশা রেখেছে হাত

ফজলুল হক সৈকত
🕐 ১০:২৪ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৮

শীতকে কেউ কেউ ‘নীরবতা ও অন্ধকারের অনুভূতি’ বলে প্রকাশ করতে চান। বাঙালি জীবনে শীতকাল যেন এক প্রতীক্ষার প্রহররাজি। লেপের ওমে আমরা একটুখানি জিরিয়ে নিতে চাই। ক্লান্তিমোচনের কাল এই শীত কেবল জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে, তা নয় এর ব্যাপ্তি ছড়িয়েছে সাহিত্যে ও শিল্পে। আর কেবল বাঙালি জীবনে কেন? সারা দুনিয়ায় আমরা পাই শীতের বন্দনার হাজারো উদাহরণ। শীতের দেশে আইস ছিটিয়ে শিশু-কিশোরদের খেলা কিংবা আইস কেটে স্থাপত্যকলার নির্মাণশৈলীর কথাও আমাদের মনে পড়ে। আর আছে তুষার ঝড়ের বাড়াবাড়ি। শীতকাল এমন একসময়, যখন সারা পৃথিবী সম্ভবত ঘুমের ঘোরে প্রবেশ করে। ঠাণ্ডা বাতাস, শক্ত মাটি আর মৃতপ্রায় গাছ-গাছালিতে আচ্ছন্ন এই সময়ে যেন তেমন কিছুই করার থাকে না।

তবে শীত আমাদের এমন কিছু ভাবতে অনুপ্রাণিত করে, যা আমরা এত দিন অবহেলায় পেছনে ফেলে রেখেছিলাম। সৃজনশীলতার বিকাশ এবং কল্পনার ক্ষতিপূরণেরও সময় এটি। পৃথিবীজুড়ে কবিরা শীতকাল নিয়ে যে সাহিত্য রচনা করেছেন, তাতে পাওয়া যায় মানুষের সম্পর্কের প্রতি বিশেষ মনোযোগ বা সম্পর্ক নবায়নের বিভিন্ন প্রসঙ্গ ও মাত্রা। শীতের স্বপ্ন আছে; আছে প্রসন্নতা-বিষণ্ণতার আবহ। শীতের সংগীত উৎসব, গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালা কিংবা শীতকালে সিনেমা দেখার আনন্দও সারা পৃথিবীতে মানুষকে আনন্দ দিয়ে আসছে। শীত আমাদের ক্লান্তির, অসহায়তার এবং বিপন্নতার বিপরীতে এক আলো-তাপানোর প্রহর! কবি মাইকেল রিয়ান মনে করেন, শীতকালে প্রেম এবং আলো পূর্ণতা পায়।

জেমস থমসন শীতকে ভেবেছেন দুঃখ-বেদনার সময়, তবে তিনি শীতকে অভিনন্দন জানাতে ভুল করেননি। কবি মার্ক ভেনভোল্ট শীতকালে নতুন করে শিক্ষা নেওয়ার, নতুন করে কল্পনা সাজানোর সময় বলে ভাবতে পছন্দ করতেন। শীতের নানান প্রহরে তিনি বরফ আর পাখির গানও শুনতে পেয়েছেন।

‘এক মাঘে শীত যায় না’ বাঙালির এ প্রবাদের খবর অনেকেরই জানা। এখানে শীত বিপদের অনুষঙ্গ। আবার বিপরীত ভাবের প্রবচনও আছে ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’। জানালার কাচে কুয়াশার ছোঁয়া কিংবা পথে ও ঘাসে শিশিরের মেলা দেখে কে না আনন্দ পায়? শীতকালে মাঝেমধ্যে সূর্যিমামা তো দেখাই দেন না। কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকে যেন পুরো গ্রাম-শহর-মানুষ আর মানুষের মন! খেজুরের রস, পাটালি গুড়, কোঁচাভর্তি মুড়ি-মুড়কি, পিঠা-পায়েশ, খড়-পাতার আগুন তাপানো, গমের ক্ষেতে পাখি-তাড়ানো, লেপ-কম্বলের উত্তাপ, কুয়াশা ঢাকা ভোরে ও সন্ধ্যায় আনন্দ-কষ্টের মিশেল নিয়ে আমাদের জীবনে শীতকাল হাজির হয়।

শীতের মিঠে রোদ, কুয়াশার চাদর, উঠোনের কোণে মাটির চুলায় রান্না, চুলার পাশে বসে বসে হাতের তালু গরম করে নেওয়া, পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর উদাম শরীর শরীরের শির শির কাঁপুনি, চায়ের কাপের শাদাটে ধোঁয়া, হলুদ সর্ষের মাঠ এইসব ছবি আর ছবির পেছনের গল্প আমাদের কাছে খুব বেশি চেনা। আর আছে গ্রামের স্কুলমাঠে যাত্রা-সার্কাস-অপেরার মাতেয়ারা সব রাত। হিম হাওয়ায় ঠাণ্ডা-কাশি তো আছেই। শীতকে কেউ ভেবেছেন উৎসব, কেউবা মৃত্যু। অনেকে হতাশা ও আশাহীনতার কাল হিসেবে বিবেচনা করেছেন শীতকে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে ‘এক শীত পেরোলে আরেক জীবনের সম্ভাবনা’কে বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়।

কবিরা শীতের বন্দনা করেছেন বেশুমার। আমেরিকান-ইংরেজ কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন, ‘Stopping by woods on a snowing evening’. সোভিয়েত লেখক চেখভ বলেছেন, ‘মানুষ সুখী হলে জানতে চায় না এটি শীত না বসন্ত’। বাংলা কবিতায় শীত প্রবেশ করেছে মধ্যযুগে বিশেষ করে মঙ্গলকাব্যে নায়িকার বারো মাসের কষ্ট-বর্ণনার অনিবার্য-পরিসরে। ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বলেছেন, ‘পউষের প্রবল শীত সুখী যেজন।/তুলি পাড়ি আছারি শীতের নিবারণ॥/ফুলরার কত আছে কর্মের বিপাক।/মাঘ মাসে কাননে তুলিতে নাহি শাক ॥’

পরবর্তীকালে আধুনিক কবিরাও শীতকালের বন্দনা কিংবা বর্ণনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘শীতের হাওয়া হঠাৎ ছুটে এল।/গানের হাওয়া শেষ না হতে।/মনে কথা ছড়িয়ে এলোমেলো।/ভাসিয়ে দিল শুকনো পাতার স্রোতে।’ শীতের শেষে বসন্তের শুরুকে আবাহন করেছেন বোধকরি কবি। অন্যত্র তিনি লিখছেন, ‘এসেছে শীত গাহিতে গীত বসন্তেরই জয়’। শীতকে তিনি মৃত্যুর প্রতীকেও প্রয়োগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ‘শীতের প্রবেশ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘শীত, যদি তুমি মোরে দাও ডাক দাঁড়ায়ে দ্বারে।/সেই নিমেষেই যাবো নির্বাক অজানার পারে।’ জসীমউদ্দীনের কবিতায় শীতকে আমরা পাই আমাদের নিজস্ব ঋতুরূপে।

শীতকালের প্রবল ও আন্তরিক বর্ণনা তার কবিতায় যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে, বাংলা সাহিত্যে আর কোনো কবির রচনায় তেমনটা হয়নি। ‘রাখাল ছেলে’ কবিতা থেকে খানিকটা পাঠ নেওয়া যেতে পারে ‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,/সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।/আমার সাথে করতো খেলা প্রভাত হাওয়া, ভাই,/সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।/চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দুখান পা,/বলছে ডেকে, ‘গায়ের রাখাল একটু খেলে যা!’... সরষে বালা নুইয়ে গলা হল্দে হাওয়ার সুখে,/মটর বোনের ঘোমটা খুলে চুমু দিয়ে যায় মুখে!/ঝাউয়ের ঝাড়ে বাজায় বাঁশী পউষ-পাগল বুড়ী,/আমরা সেথা চষতে লাঙল মুর্শিদা গান জুড়ি।’ তার ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় আছে শীতের অনুষঙ্গ ‘তুমি যদি যাও দেখিবে সেখানে মটর-লতার সনে,/সীম আর সীম হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেইখানে।/তুমি যদি যাও সে-সব কুড়ায়ে,/নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,/ খাব আর যত গেঁয়ো চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,/হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব জনে জনে।’ রূপসী বাংলার রূপকার প্রকৃতির কবি, জীবনানন্দ দাশ ‘শীতরাত’ কবিতায় লিখেছেন, ‘এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;/ বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা।’

তার কবিতায় ঘুরে ঘুরে আসে ‘পউষের ভেজা ভোর’, ‘নোনাফল’, ‘আতাবন’, ‘ঝরিছে শিশির’, ‘পউষের শেষরাতে নিমপেঁচাটি’। ‘এইসব ভালো লাগে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে/আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়, আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল/এই নিয়ে খেলা করে: জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল/পৃবিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালবেসে,/পউষের শেষরাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে/ফিরে এল; রং তার কেমন তা জানে ওই টসটসে ভিজে জামরুল,/নরম জামের মতো চুল তার, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল।’

কবিতা লেখা আর শীতরাতের হিম-প্রখরতা যেন জীবনানন্দের ভাবনায় একাকার হয়ে আছে। জানাচ্ছেন সে কথা: ‘এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি ব’সে নিজ মনে একা;/ চালতার পাতা থেকে টুপ্ টুপ্ জ্যোৎস্নায় ঝরেছে শিশির;/কুয়াশায় স্থির হয়ে ছিল ম্লান ধানসিঁড়ি নদীটির তীর;/বাদুড় আঁধার ডানা মেলে হিম জ্যোৎস্নায় কাটিয়াছে রেখা/ আকাক্সক্ষার; নিভু দীপ আগলায়ে মনোরমা দিয়ে গেছে দেখা/সঙ্গে তার কবেকার মৌমাছির...কিশোরীর ভিড়/আমের বউল দিল শীতরাতে; আনিল আতার হিম ক্ষীর;/মলিন আলোয় আমি তাহাদের দেখিলাম,’শীতের সাথের শরীরের ওমের যে সম্পর্ক, তাও ভুলে যাননি জীবনানন্দ। লিখেছেন সে কথা‘হিমের রাতে শরীর ‘উম্’ রাখবার জন্য দেশোয়ালীরা/সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে।’

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দের ‘দুজন’ কবিতার একটি অংশ উদ্ধৃত করে বর্তমান আলোচনাটি শেষ করতে চাই। তিনি লিখেছেন, ‘হলুদরঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছে, এলোমেলো অঘ্রানের খড়/চারিদিকে শূন্য থেকে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর;/চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;।’ হ্যাঁ, এখন তো শিশির ঝরছে।

মাঘের শেষে বসন্তের প্রথম প্রহরে ফাল্গুনের আগুনমেলায় হয়তো ‘কুয়াশা রবে না আর’। হয়তো সময়ের গায়ে গায়ে মিশে যাবে সব মাধুরী ও হতাশা। ঠিকই চলে যাবে অনন্তের পারে আরো এক প্রজন্মের স্বপ্ন। কিন্তু শীতের হিমেল হাওয়ার মায়া হয়তো কিছুটা রয়ে যাবে মানুষের মনে, মানুষীর মনে।

 

 
Electronic Paper