শীত শিখিয়েছে কষ্ট দ্রোহ
হাসান আজিজুল হক
🕐 ১০:১৬ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ০৭, ২০১৮
আমার জন্ম বর্ধমান জেলার একটি অজপাড়াগাঁয়ে। জন্মগ্রহণের পর আমার বয়স প্রায় ৮০ বছরে চলে আসছে। ফলে স্মৃতি যা আছে তার অনেক ভুলে গেছি। আমার স্মৃতি যে গ্রামটার বিবরণ দেবে ঠিক সে গ্রামটা এখন আছে কি না, আমি জানি না। হয়তো ভূগোল খুব বদলাবে না। আমি মাঝে মাঝে এখনো যাই, দেখি সামান্য যে রদবদল হয়েছে তাতে গ্রামের চেহারাটা আমার কাছে অন্যরকম মনে হচ্ছে। একেবারে অনেক দূরে শহর থেকে গ্রাম, তখনকার দিনে মনে হতো, অনেক দূরে, এখন এরকম মনে হয় না।
এখন আধুনিক সময়, বিদ্যুৎ, টেলিফোন সবই আছে। আমাদের গ্রাম থেকে পাকা রাস্তা বয়ে গেছে বর্ধমান পর্যন্ত। এখন আর সেই খেয়াঘাট নেই। সেই ধুলোমাখা বর্ধমান, সেই সাদা মাটির দেশ, কাদামাটির দেশ আর নেই। তখনকার দিনে বিশেষ করে বর্ষাকালে প্রায় গৃহবন্দি থাকতাম। আর শীতকাল! তা ছিলো মধুর সময়।
তখন সবকয়টা ঋতু বোঝা যেত। একটা ঋতু থেকে আরেকটা ঋতুর পালাবদল বোঝা যেত। এবং প্রত্যেকটা ঋতুর আলাদা আলাদা তাৎপর্য ছিলো গ্রামের মানুষের কাছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এ ছয় ঋতু ছয় রকম পরিবেশ-আবহ নিয়ে আসতো। তার মধ্যে কষ্টকর হয়ে উঠতো বর্ষা ঋতুটা। প্রায় দিনক্ষণ হিসাব করেই বোঝা যেত। বর্ষা শুরু হলে সবাই বলতো, ‘আষারের বাধ’ যা জ্যৈষ্ঠ মাসের ১১ তারিখ ছিল। আষাড়ে বাঁধ মানে বাঁধ ভাঙা, জমিতে রস আসা।
আর শীতকাল নিয়ে আমাদের খুব উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিলো। শীত আমার অন্তরের দ্রোহ হয়ে আছে। শীতকালকে আমাদের ঐদিকে বলা হতো ‘জারকাল’। ‘জারকাল’ মানে জার অর্থাৎ ঠাণ্ডা। সে অর্থে শীতকাল মানে ‘জারকাল’। এখানে মানুষবে জবুথবু হয়ে থাকতে হয়। হাতও মেলা যায় না, কাপড়ের ভেতর মুড়িয়ে রাখতে হয়। জার মানে মানুষকে জড় পদার্থে পরিণত করে। এসব কারণেই শীতকালের নাম ছিল ‘জারকাল’। আমরা কখনোই শীতকাল বলতাম না, বলতাম জারকাল।
জারকাল নিয়ে খুব পরিষ্কার কিছু স্মৃতি আছে। বর্ষাকাল নিয়েও কিছু আছে। বসন্ত আর গ্রীষ্ম প্রায় মিশে যেত। জারকালে প্রচণ্ড শীত পড়তো। তখন তো আর শীতের মাত্রা কি জিনিস কেউ জানত না। তাপমাত্রা কত উঠবে কত নামবে কোনোটাই জানা যেত না। সবটাই প্রকৃতির কাছ থেকে নিতাম। কখনো আরাম, কখনো কষ্ট।
শীতকালে শীত নিবারণের জন্য বস্ত্র-কাঁথা, ল্যাপ-তোশক আমাদের বাড়িতে ছিল। দেখা যেত আমি সারাক্ষণই ল্যাপের ভেতর গুটিশুটি হয়ে থাকতাম। ল্যাপ যখন পুরনো হয়ে যেত তখন গুটি গুটি হয়ে যেত। ‘ধুনড়ি’ বলে এক ধরনের পেশার লোক পাওয়া যেত যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ল্যাপ ধুনে যেত। আবার বাড়িতে তুলো রেখে দিলে তারাই ল্যাপ বানিয়ে দিত। তুলোধুনোর দৃশ্য দেখে আশ্চর্য লাগতো তখন। ধুনড়িদের তো আজকাল চোখেই পড়ে না।
শীতকালের একটা উৎসব খুব আনন্দ দিত। যেমন গ্রামের অনেককেই তখন মুসলমানি করানো হতো। এবং সেকি আনন্দ সবার। আজ এ বাড়িতে তো কাল ওই বাড়িতে। সবাই খাওয়া-দাওয়ার আমেজে থাকতো।
এক ফকির সম্প্রদায় ছিল, সাত-আটজন মিলে আসতো। বাড়ি বাড়ি ঘুরতো। তাও ভোর রাতে। ঘুরে ঘুরে তারা গান করতো। কত মধুর লাগত সে গান!
গানের কথাতে খুব একটা গাম্ভীর্য থাকত না, এমনকি সুরেও। একেবারে গ্রাম্য সুর, মাটির সুর। দেখা গেল গানের সুর শুনতে শুনতেই ভোরের আলো দেখতাম। এরপর প্রায় সকালের দিকে একজন বাউল আসতেন। সে ছিল স্বভাবকবি। সে নিজেই কবিতা লিখত। বাইরে বাইরে ঘুরতো। হাতে শুধু খঞ্জনী থাকতো। খঞ্জনী বাজিয়ে বিশেষ করে ভৈরবী গান গেয়ে গেয়ে চলে যেত। হরি দিনত গেল, রাত্রি গেল, ভজহরি এসব গান গাইতেন। বিনিময়ে কিছুই চাইতেন না। পয়সাও না।
তখনকার শীতে গ্রামের কিশোরীরাও ভোরবেলায় উঠে গান গাইতো, ছড়া কাটতো। ৪-৫ জন কিশোরী একসাথে গেয়ে উঠত ‘সুয্যি মামা সুয্যি মামা জেগে ওঠ রে, তোর ভাগ্নে জারে মরলো রে।’ কিশোরীদের গায়ে জড়ানো থাকতো ছেঁড়া শাড়ি। এ ছিল এক কষ্টের জীবন।
মোট কথা, আদিম যুগের অনেক কিছুই তখন প্রত্যক্ষ করতাম। ঠিকমতো খাবার জুটতো না। আমাদের সচ্ছল পরিবার থেকে অনেকেই খাবার নিতে আসতো। দুপুরবেলায় শুধু ভাত আর ডাল হলেই তারা খুশি থাকতো। অনেককে দেখতাম ভাতের মাড় খেয়ে থাকতে।
শীত তো শস্যের ঋতু। বর্ধমানে প্রচুর ধান হতো। সারা বাংলার মধ্যে বর্ধমানে সবচেয়ে বেশি ধান ফলতো। যেহেতু আর অন্য কোনো ফসল তেমন নেই সেহেতু যা কিছু করা লাগতো সবটাই ধান বিক্রি করে করতো। আর হতো চাল বিক্রি। শীতে দেখতাম আধুলি, দোয়ানি, তিনআনি, চারআনির বিনিময়ে ধান বিক্রি হতো। অর্থনীতি বলতে এই ছিলো। আমাদের গ্রামের একটা লোকেরও ব্যাংক একাউন্ট ছিল না। তবে শীতে আমাদের গ্রামের অর্থনীতি চাঙ্গা হতো।
গ্রামে মহাজন ছিল। মহাজনকে গ্রামের লোক শকুনের সাথে তুলনা করতো। একবার যদি টাকা ধার দিত, কি কীভাবে যেন কি করত, সুদই শেষ হতো না।
যে বছর খরা থাকত, সে বছর শীত যে কত কষ্ট নিয়ে আসত তার সীমা থাকত না।
শীত আমার কাছে জীবনের আয়না হয়ে আছে। শীত থেকে শিখতে পেরেছি কষ্ট-দ্রোহ কাকে বলে। শীত আমাকে ভাঙায় আবার গড়ায়।